অদম্য সংগ্রামী: রানি না হয়েও পরিবারের ‘মহারানি’ ভিক্টোরিয়া

ছেলের পরিবারের প্রথম কন্যাসন্তান তাই আদর করে মহারানি ভিক্টোরিয়ার নামের সাথে মিলিয়ে দাদি আলেয়া বেগম অনেক আদর করে নাম রাখেন ‘ভিক্টোরিয়া’। এর কয়েকবছর পরই আরেক ফুটফুটে কন্যা জন্ম নেয় বাবা মহব্বত বিশ্বাস ও মা নাজমা বেগমের ঘর আলো করে। এবার বাবা উচ্ছ্বল নায়েগ্রা জলপ্রপাতের সাথে মিলিয়ে মেজ মেয়ের নাম রাখেন ‘নাইগেরিয়া’। ঐতিহাসিক এসব নামের সঙ্গে মিল রেখে ছোট সন্তানের নাম রাখা হয় ‘এলিজাবেথ’। জন্মের পর থেকেই রানিদের মতো জীবনযাপন করা হয়নি ঐতিহাসিক নামধারী এই তিনকন্যার। উল্টো ভূমিহীন বাবার সংসারে অভাব আর অনটনের মধ্যে দিয়ে তাদের দিন কেটেছে। তবু হাল ছাড়েনি অদম্য তিন কন্যা। অনেক কষ্টে পড়ালেখা চালিয়ে বাবার পরিবারে সুখ আনতে ব্যস্ত বড় কন্যা ভিক্টোরিয়া।

পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে চাকুরিরত মায়ের একমাত্র সন্তান মহব্বত। মায়ের চাকরি আর পৈত্রিক জমিজমা এসব দিয়ে বেশ স্বচ্ছলতার সাথেই কেট যেত তার। কবিয়াল বিজয় সরকার ভক্ত মহব্বত হোসেন নিজের আনন্দে গান গেয়ে বেড়াতেন বিভিন্ন স্থানে, সংসারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে বেশি একটা ভাবতেন না তিনি। তবু এর মধ্যে দিয়ে বড় মেয়ে ভিক্টোরিয়াকে বাড়িতে গানের শিক্ষক রেখে গান শেখাতে কুণ্ঠা বোধ করেননি। সংসার বড় হবার সাথে সাথে দিঘলিয়া বাজারে রাখী মালের (স্টক বিজনেস) কারবার শুরু করেন মহব্বত বিশ্বাস। কিন্তু ধীরে ধীরে পৈত্রিক জমিজমা ভূমিদস্যুদের হাতে চলে যাওয়ায় সংসার চালানো খুবই কষ্টকর হয়ে পড়ে।

একেবারেই বেকার হয়ে পড়েন তিনি। এরপর ২০১৫ সালের প্রথম দিকে হঠাৎ করে ব্রেইনস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মহব্বত বিশ্বাস স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন।
এরপর থেকেই নিজ পরিবারের হাল ধরতে বড় মেয়ে ভিক্টোরিয়া। রানির মতোই জীবনযুদ্ধে নেমে পড়েন। বাবার পরিবারের হাল ধরতে গিয়ে অনার্স পড়া বাদ দিয়ে পাসকোর্সে ভর্তি হন নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজে। ২০১৫ সালের মার্চ মাসে বিএ পড়াকালীন ঢাকার একটি বেসরকারি কম্পানিতে চাকরি নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়েন, কিন্তু বিধাতার নির্মম পরিহাস চাকরির মাত্র তিন মাসের মাথায় এক প্রতারকের খপ্পরে পড়ে চাকরি ছেড়ে আবার গ্রামে ফিরে আসেন।

এবার নিজ উদ্যোগেই কিছু করার চেষ্টা করেন। এক সন্ধ্যায় পরিবারের সবাই মিলে আয়ের পথ খুঁজতে থাকেন। একজন আত্মীয়র মাধ্যমে জানতে পারেন মিষ্টির প্যাকেট তৈরির কাজ সম্পর্কে। দিঘলিয়া বাজারে কয়েকটি মিষ্টির দোকানে গিয়ে কাগজের তৈরি মিষ্টির প্যাকেটের চাহিদার ব্যাপারে খোঁজ নেন এবং স্থির করেন মিষ্টির প্যাকেট তৈরির কাজ করবেন তিনি।

প্রথমে শুরু করেন হাতে তৈরি কাগজের শপিং ব্যাগ দিয়ে, এরপর মিষ্টির প্যাকেট তৈরির কাজ। খুলনা থেকে ছাপানো প্যাকেট আর উপকরণ কেনার পর বাড়িতে প্যাকেট তৈরি করেন তারা। ভিক্টোরিয়ার বাবা দিঘলিয়াসহ স্থানীয় বাজারগুলোতে ভ্যানযোগে মিষ্টির প্যাকেট সরবরাহ করেন। একটি মিষ্টির প্যাকেট তৈরিতে খরচ পাঁচ টাকা, আর তা বিক্রি হয় ছয় টাকায়। প্রতিদিন গড়ে ৩ শ থেকে ৪ শ প্যাকেট তৈরি হলে মাসে গড়ে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় হয় তাদের। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় দুই লাখ টাকা ঋণ নিয়ে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া এলাকায় নিজেদের ছোট্ট ঘরে গড়ে তুলেছেন প্যাকেট তৈরির ছোট একটি কারখানা। বাঁশঝাড়ের তলে অন্ধকারাচ্ছন্ন এই ঘরে আলো জোগাতে প্রতিদিন প্যাকেট তৈরি করেন ভিক্টোরিয়া আক্তার। এই কাজে ভিক্টোরিয়াকে সহযোগিতা করেন তার তার মা আর ছোট দুই বোন। এ সামান্য আয় থেকে তিন বোনের লেখাপড়ার খরচসহ সংসার চলছে।

পরিবারের স্বচ্ছলতার জন্য এখানেই থেমে নেই ২৩ বছরের এই কন্যা। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বাড়িতে প্রাইভেট পড়ানোর কাজ করছেন তিনি। চতুর্থ আর পঞ্চম শ্রেণির প্রায় ১০ জন ছাত্রকে পড়িয়ে আরো কিছু টাকা আয় করেন। এই আয়ের টাকা দিয়ে ছোট বোন নাইগেরিয়াকে ও গানের শিক্ষক রেখে গান শেখাচ্ছেন। সে এবার উপজেলা পর্যায়ে লোকগানে পুরস্কার পেয়েছে। আর নিজের ছোটবেলার শেখা গানের বিদ্যার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ২০১৬ সালের ১ এপ্রিলে বাড়ির বারান্দায় প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘ভিক্টোরিয়া সংগীত নিকেতন’ নামের ছোট্ট একটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে ১২ জন শিশু-কিশোরকে নামমাত্র ফি এর বিনিময়ে প্রতি শুক্রবারে গান, আবৃত্তি, হাতের সুন্দর লেখা ও উপস্থাপনা শেখানোর পাশাপাশি আদর্শ মানুষ করে গড়ে তোলার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই সংগঠনটিকে সমাজসেবার অধীনে নিবন্ধন করতে ইতিমধ্যে আবেদন ও করেছেন তিনি।

বর্তমানে ভিক্টোরিয়া আক্তার নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের বিএ শেষবর্ষের শিক্ষার্থী। অত্যন্ত কর্মঠ এই নারী উচ্চমাধ্যমিক পড়াকালীন গোপালগঞ্জের শেখ ফজিলাতুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের (বিএনসিসি) অধীনে অর্জন করেন ক্যাডেট আন্ডার অফিসার (সিইউও) পদমর্যাদা। তার উদ্যোগেই ২০১৪ সালে নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজে বিএনসিসির মহিলা প্লাটুন খোলা হয়। আবৃত্তি আর উপস্থাপনায় রয়েছে তার দক্ষতা।

স্থানীয় প্রগতি প্রি-ক্যাডেট স্কুলের শিক্ষক কানন পাল বলেন, ভিক্টোরিয়া অত্যন্ত মেধাবী মেয়ে। সে খুব কষ্ট করে পরিবার নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তার কাজে এলাকার সকলেই প্রশংসা করে। তাদের ব্যবসা আরো ভালোমতো করতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। তবে সবাই মিলে উৎসাহ দিলে আরো ভালো করতে পারবে।

প্রতিবেশী বিউটি রানী সাহা বলেন, ভিক্টোরিয়া এই বয়সেই সমাজের সাহসী নারীর উদাহরণ হয়ে গেছে। প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও এগিয়ে যাচ্ছে ভিক্টোরিয়া। ওর জীবনযুদ্ধে আমরা অনুপ্রাণিত হই, গর্ববোধ করি। বাবার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। তবুও পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে তিন বোন। এ রকম মেয়েদের অনেক দূর যেতে হলে সকলের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া দরকার তাতে আমাদের সমাজের মঙ্গল হবে।



মন্তব্য চালু নেই