অদ্ভুত মাথার সন্তান নিয়ে একজন সাহসী মায়ের সংগ্রাম (ভিডিওসহ)

হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগের ওয়ার্ডে পিনপতন নীরবতা। কথা বলার ফিসফিস শব্দ। নার্সরাও ভীত। শারীরিকভাবে বিশেষ এক শিশুর জন্মের সময়ের অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে এভাবেই বলেছিলেন পাকিস্তানের এক মা।

রাবেয়া আজিজ নামের ওই মা বলেন, সি-সেকশেনের পর্দার আড়ালে আমি অস্বস্তি বোধ করছিলাম। নার্সরা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি আপনার সন্তানকে দেখতে চান?’ অ্যাপার্ট সিন্ড্রোমে আক্রান্ত ছোট্ট আলিয়া অদ্ভুত আকৃতির মাথার খুলি, হাত এবং পায়ের আঙ্গুলবিহীন অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে। দূরারোগ্য জেনেটিক ডিজঅর্ডার আক্রান্ত হয়ে জন্মায় আলিয়া। ৬৫ হাজার শিশুর মধ্যে একজন এ রোগে আক্রান্ত হয়।

রাবেয়া বলেন, ‘আপনি জানেন না সেই সময়ের এক একটি রাত ও সময় কীভাবে কাটিয়েছি, স্মরণ করতে চাই না কীভাবে ঘুমিয়েছি। গত তিন বছরে ওই রকম একটি রাত আর আসেনি’।

এ ধরনের রোগে আক্রান্ত শিশুদের শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হয়, রাতে ভালো করে দেখাশুনা না করলে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কেননা আলিয়ার হাত স্বাভাবিক ছিল না, সে বিছানায় নিজেকে এদিক-সেদিকে নড়াচড়া করাতে পারতো না। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আছে। তার ওই হাতের কারণে নিজের পতন ঠেকাতে পারতো না। ওপরে অথবা নিচে নামার জন্য সব সময় সাহায্য প্রয়োজন।

pakistan20160508154625

অ্যাপার্ট সিন্ড্রোমে আক্রান্ত শিশুদের অনেকেই কথা বলতে পারলেও আলিয়া পারতো না। সে এখনো কোনো কথা বলতে পারে না, কোনো ভাষা আয়ত্ত্ব করতে পারেনি। তার কণ্ঠস্বর ক্ষীণ, অপ্রকাশিত। হাতের সহায়তা ও অন্যান্য উপায়ে শরীরের নড়াচড়ার মাধ্যমে যোগাযোগ করে। রাবেয়া পাকিস্তানের জাতীয় দৈনিক ডন নিউজকে বলেন, ‘এটি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক, যখন আপনি বুঝতে পারছেন না সন্তান আপনাকে কী বলছে’।

শারীরিক প্রতিবন্ধতা মোকাবেলায় যদিও যথেষ্ঠ পদক্ষেপ নেই, কিন্তু থেমে নেই রাবেয়ার সংগ্রাম। শুরুতে একজন স্থানীয় চিকিৎসক আলিয়ার শারীরিক উন্নতির সম্ভাবনা নাকচ করে দেন। চিকৎসক বলেন, তাকে (ওই শিশুকে) ভালোবাসা এবং স্নেহ দিন। ‘অবশ্যই আমি তাই করছিলাম। কিন্তু আমার সাধ্যের সবকিছু করতে চাই। তাকে সর্বোচ্চ ভালোবাসা দেওয়ার জন্য এটি চাই’ – বলেন রাবেয়া।

রাবেয়া চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। অনেকেই তার সন্তানকে দেখে নাক ছিটকাতেন। তিনি বলেন, মানুষের এই উপহাস আমাকে আরো শক্তি দিয়েছে। মানুষের এই ভিন্ন দৃষ্টিতে তাকানো তাকে নিরুৎসাহিত করতে পারেনি। এক গাল হেসে রাবেয়া বলেন, এটি সত্যিই মুক্ত বিষয়, যখন অন্যরা আপনাকে নিয়ে কী ভাবছে সেটি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ছেড়ে দেবেন।

pakistan-320160508154653

কীভাবে এই মা তার সন্তানের জন্য অতিরিক্ত ইচ্ছাশক্তি পান? আর ছোট্ট আলিয়া কীভাবে বেড়ে উঠছেন? রাবেয়া তার সন্তানের জন্মের সময়ের কথায় আবারো ফিরে যান। তার স্বামীর কথা এখনো মাথায় গেঁথে রয়েছে। ‘অ্যাপার্ট সিনড্রোম নিয়ে আমাদের সন্তান জন্ম নিয়েছে। এটি স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান ছিল। সে আমাকে বলে- এটি যে রকম আমরা সেভাবেই বলবো’। রাবেয়া বলেন, আমরা কুসংস্কার ভেঙেছি।

রাবেয়া তার সন্তানকে নিয়ে চলাফেরা করতে গিয়ে যে ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন তা ৮০০ শব্দে তুলে ধরেছেন ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে। ‘আমি অন্তরে তীব্র ব্যথা অনুভব করি যখন আমার হৃদয়কে আঘাত করে কেউ কোনো কিছু বলে’।

আলিয়ার শরীরের অভ্যন্তরের সমস্যা নিয়ে কথা বলেন রাবেয়া। এনআইসিইউতে আলিয়ার চিকিৎসা করছি, কেনো তার ক্ষেত্রে এটি, কেনো আমার সন্তান? আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি যেভাবে হোক আমার সন্তানকে যেন আমার মতো স্বাভাবিক করে দেন। আমি স্বার্থপরতা নিয়ে ভীত ছিলাম এবং বেশি ভীত ছিলাম চ্যালেঞ্জ নিয়ে। সন্তানের কাছে থেকে শক্তি সঞ্চয় করছি। ফেসুবকে দেওয়া রাবেয়ার ওই পোস্ট আবেগের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

child-pakistan-220160508154545

‘আলিয়া তোমার বয়স তখন মাত্র দুই মাস। সে সময়ই তুমি আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছো। সমবেদনা, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও বিস্ময়কর ইচ্ছে শিখিয়েছো’। রাবেয়ার আবেগপূর্ণ ওই স্টাটাস ভেসে গেছে শত শত লাইক, কমেন্ট ও শেয়ারে। মানুষের এই ভালোবাসায় মুগ্ধ রাবেয়া। তিনি আলিয়ার বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা নিয়ে খুব শিগগিরই ব্লগ লেখা শুরু করবেন।

আলিয়ার শরীরে প্রথম সার্জারির বেশ কিছু ছবি শেয়ার করেছেন রাবেয়া। যেখানে চিকিৎসকরা তার হাত ও পায়ের আঙুলের অপারেশন করেছেন। একটি বিশেষ শিশুর জীবন কীভাবে সুন্দর হতে পারে তার জ্বলজ্বলে উদাহরণ আলিয়া। সে তার বাবা-মার সঙ্গে কেনাকাটা করতে মলে যাচ্ছে, হ্যালোউইন পোশাক পড়ছে। রাবেয়ার এই ছোট্ট যুদ্ধে অনলাইন ও বাস্তব জীবনে উৎসাহ দিচ্ছেন শত শত মানুষ।

ভিডিও :



মন্তব্য চালু নেই