অন্যরকম ও অভিনব এক চোরের কাহিনী…

শীতে জবুথবু। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে। আমার গায়ে ফোমের জ্যাকেট। মনে হয় লেপ গায়ে দিয়ে হাঁটছি। লেপের আবার হুডি আছে। হুডিতে কান-মাথা শক্ত করে আটকানো। ওয়েস্ট ইলিং ব্রডওয়ের রাস্তা পার হচ্ছি। হঠাত্ ঘোঁত্ করে একটি লাল রংয়ের চকচকে দ্বিতল বাস এসে আমার ডানদিকে ব্রেক কষল।

আর একটু হলেই বিলেতের রাস্তায় থেঁতলে যেতাম। লেপ গায়ে দিয়ে হাঁটার এই হলো সমস্যা। কান বন্ধ থাকায় গাড়ি-ঘোড়ার শব্দ পাওয়া যায় না। শীতের অত্যাচারে আলস্য এমনভাবে জেঁকে বসেছে, ঘাড় ঘুরিয়ে ডানে-বাঁয়ে তাকাতেও ইচ্ছে করছে না। এতবড় একটা দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়ার পরে যে কষে একটা দৌড় লাগাব তা-ও পারছি না। বিলেতের শীত যেন দু’পায়ে এক অদৃশ্য ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে দিয়েছে। ডাণ্ডাবেড়ি পরা আসামি অতি ধীরলয়ে হেঁটে রাস্তা পার হয়ে এলো।

ওয়েস্ট ইলিং ব্রডওয়ে একটি মার্কেটপ্লেস। অনেক সুপার মার্কেট আছে এখানে। কিন্তু আমি সব সময় কুর্দি দোকানটিতেই যাই। মাছ-মাংস, তরিতরকারি থেকে শুরু করে সবকিছুই পাওয়া যায় এই দোকানে। কোনো কোনো জিনিসের দাম একটু বেশি হলেও আমি এই দোকান থেকেই কিনি। এর একটি বিশেষ কারণ আছে। ইরাক, ইরান, তুরস্ক এবং সিরিয়ার সাড়ে তিন লাখ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে বসবাসরত আড়াই কোটি কুর্দি দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীন কুর্দিস্তানের জন্য আন্দোলন করে আসছে। কথাটি মনে হলেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে পড়ে। ওদের প্রতি সরকারের বৈরী আচরণ এবং অত্যাচারের অনেক করুণ কাহিনী আমি জানি। পৃথিবীর আর দশটা স্বাধীনতাকামী ভূ-খণ্ডের মতো কুর্দিস্তানের মানুষেরাও জীবন ও জীবিকার সন্ধানে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। ডেনমার্কেও অনেক প্রবাসী কুর্দিকে ছোট-খাট ব্যবসা করতে দেখেছি, কেউ কেউ ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট এবং কষাইয়ের দোকানে কাজ করছে। ছোট ছোট তরুণকেও দেখেছি খাবারের দোকানে, বুচার শপে কাজ করে। কী করুণ দৃষ্টিতে তাকায় ছেলেগুলো। কোনো এক বিচিত্র কারণে কুর্দিদের আমার খুব আপনজন মনে হয়। হয়তো বুকের ভেতর লাফিয়ে ওঠে একাত্তর।

দোকানের বাইরে প্লাস্টিকের ছাউনির নিচে ফলমূল এবং তরিতরকারির পসরা সাজানো। হঠাত্ নারীকণ্ঠের চিত্কার শুনে আমি সচকিত হই। দোকান থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসি। কেউ কি এক্সিডেন্ট করল? না-কি ভূমিকম্প? এ-কী! একটি ব্যাগের দু’দিক ধরে দু’দল মানুষ টানাটানি করছে। একদিকে দীর্ঘদেহী এক শ্বেতাঙ্গ পুরুষ। পঞ্চাশোর্ধ বয়স, মুখে কাচা-পাকা লম্বা দাড়ি। গায়ে তেমন মোটা জ্যাকেট নেই, সামার জ্যাকেট টাইপের একটি কফি রংয়ের পোশাক, পায়ে বুট জুতো। জ্যাকেটে কাদা লাগানো। লোকটি কি পাগল? ব্যাগের অন্যদিকে এক দম্পতি। গায়ের রং দেখে ভারতীয় মনে হচ্ছে, বাংলাদেশী বা পাকিস্তানিও হতে পারে। ওরাও মধ্যবয়স্ক। এক সময় ব্যাগটা ছিঁড়ে গেল। ওয়েস্ট ইলিংয়ের ফুটপাতে ছড়িয়ে পড়ল আলু, টমেটো, প্রসেসড ফুডের ক্যান, সিগারেটের প্যাকেট, কোকের বোতল—আরও কতকিছু। শ্বেতাঙ্গ লোকটার পিঠে কিল মারতে মারতে ভারতীয় মহিলা চিত্কার করে বলছে, চোর, চোর… আমার কাছে কিন্তু লোকটিকে মোটেও চোর মনে হচ্ছে না।

লন্ডনের রাস্তায় টুকটাক কিছু ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে বটে, তবে প্রকাশ্যে ব্যাগ ধরে টানাটানি করার ঘটনা নিশ্চয়ই ঘটে না। ওরা ছোঁ মেরে ওয়ালেট, ভ্যানিটি ব্যাগ, মোবাইল ফোন এসব নিয়েই ছুটে পালায়। শ্বেতাঙ্গ লোকটি সম্ভবত পোলিশ। পশ্চিম লন্ডনে প্রচুর পোলিশ লোক বসবাস করে। ইইউর সদস্য হওয়ার কারণে পূর্ব ইউরোপের অনেক দরিদ্র দেশের জন্যই এখন পশ্চিমের দুয়ার খোলা। সেই দুয়ার দিয়ে উন্নত জীবনের সন্ধানে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ছে লাখ লাখ পূর্ব ইউরোপীয় মানুষ। ব্যাগটি ছিঁড়ে গেলে দুই প্রতিপক্ষ পুরুষই একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু মহিলাটি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাওয়া জিনিসপত্র কুড়াতে শুরু করেছেন।

চোর পালিয়ে যাচ্ছে না কেন, সেটাই বুঝতে পারছি না। হঠাত্ সে এগিয়ে এসে পথের উপর থেকে সিগারেটের প্যাকেটটি তুলেই ভোঁদৌড়। ভারতীয় ভদ্রলোকের যেন এতক্ষণে হুঁশ ফিরে এসেছে, তিনিও চোরের পেছন পেছন দৌড়াতে লাগলেন এবং ওদের দু’জনের পেছনে আমিও। ওদের দু’জনের দৌড়ের উদ্দেশ্য আছে। কিন্তু আমি দৌড়াচ্ছি কেন? কিছুক্ষণ পর ভারতীয় ভদ্রলোক রণেভঙ্গ দেন। চোর তখনও দৌড়াচ্ছে। আমিও দৌড়াচ্ছি। আমি কি ওদের সিগারেটের প্যাকেট উদ্ধার করতে দৌড়াচ্ছি? জানি না। কেউ আমাকে বলছে দৌড়াও।

একপর্যায়ে আইসল্যান্ড সুপার মার্কেটের বাঁক ঘুরে, পেছন দিকে, নির্জন পার্কিংলটের এক জায়গায় গিয়ে থামল চোর। আমিও ওর পেছন পেছন গিয়ে ওর পাশে দাঁড়ালাম। প্যাকেটটা খুলে এবার ও একটি সিগারেট ধরাল। আমি ওকে কিছুই বলছি না। যেন কিছুই হয়নি, আমরা একটি ফ্রেন্ডলি দৌড় প্রতিযোগিতা করলাম। সিগারেটে টান দিয়ে ও সুর করে বলতে শুরু করেছে, ‘আনরিয়েল সিটি/আনডার দি ব্রাউন ফগ অফ এ উইন্টার ডন/এ ক্রাউড ফ্লোড ওভার লন্ডন ব্রিজ, সো মেনি/আই হেড নট থট ডেথ হেড আনডান সো মেনি।’ কী আশ্চর্য, এই লোক তো টিএস এলিয়ট আবৃত্তি করছে, দি ওয়েস্ট ল্যান্ড। আমি এবার ওর কাছে এগিয়ে যাই। কে আপনি? ও খিক খিক করে হাসতে শুরু করে। তখন ওর মুখ থেকে সিগারেটের কিংবা শীতের ধোঁয়া বের হতে লাগল। ‘আমি তোমার মতোই একজন।’ আমি থমমত খেয়ে যাই। ও কি একজন কবি? আর ও কী করে জানল যে আমিও কবিতা লিখি? নাকি ও বলতে চাইছে, এই লন্ডন শহরে আমিও ওর মতো এক চোর?



মন্তব্য চালু নেই