অফশোর ব্যাংকিং : পাচার ৩৪০ কোটি টাকা

অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয়েছে ৩৪০ কোটি টাকা। ঋণের আড়ালে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সিঙ্গাপুরের চারটি কোম্পানির মাধ্যমে দেশ থেকে বের করা হয়েছে এই অর্থ। এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় আরব বাংলাদেশ (এবি) ব্যাংকের অফশোর ইউনিটকে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে ফেরত আনা হয়েছে পাচারের ১৩১ কোটি টাকা। অবশিষ্ট অর্থ ফেরত আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় চেয়েছে বেসরকারি এবি ব্যাংক। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে বলেছে, অন্যথায় ব্যাংক কোম্পানি আইনে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এদিকে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ পাচারের বিষয়টি আমলে নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এ ব্যাপারে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা জানতে কমিটি চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। এছাড়া এ ঘটনায় জড়িত এবি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আগামীকাল তলব করেছে ওই কমিটি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে পাওয়া গেছে এ তথ্য।

অফশোর ব্যাংকিং হচ্ছে ব্যাংকের ভেতর আলাদাভাবে পরিচালিত একটি ব্যাংকিং। এর মাধ্যমে বিদেশী কোম্পানিকে ঋণ দেয়া ও বিদেশী উৎস থেকে আমানত সংগ্রহের সুযোগ রয়েছে। স্থানীয় মুদ্রার পরিবর্তে বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেন হয়। তবে ব্যাংকের কোনো নিয়ম-নীতিমালা অফশোর ব্যাংকিংয়ে প্রয়োগ হয় না। কেবল মুনাফা ও লোকসানের হিসাব যোগ হয় ব্যাংকের মূল হিসেবে। তবে এই ব্যাংকিং প্রক্রিয়ায় অর্থ পাচারের সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে ‘পানামা পেপারস’ নামে অর্থ পাচারের যে ঘটনা ফাঁস করা হয়েছে, তা মূলত অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেই ঘটেছে। বাংলাদেশ থেকেও একই পন্থায় অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটেছে বলে পানামা পেপারসে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, বিদেশে অর্থ পাচারের একটি বড় হাতিয়ার অফশোর ব্যাংকিং। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বিস্তারিত প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এবি ব্যাংকের অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে একটি ঘটনা ঘটেছে। এ জন্য বৃহস্পতিবার সংসদীয় কমিটির বৈঠকে ডাকা হয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান দেশের বাইরে থাকায় কোনো মন্তব্য করেননি। তবে এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও কথা বলতে রাজি হননি।

জানা গেছে, এবি ব্যাংক অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল এমই জেনারেল ট্রেডিংকে ৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা (১২ লাখ মার্কিন ডলার) ঋণ দেয়। এ প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশের রহিম আফরোজ গ্লোবাল লিমিটেডের ৪৯ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। ঋণের অর্থ স্থানান্তর হয় এবি ব্যাংকের মুম্বাই শাখার রহিম আফরোজ ব্যাটারির হিসাবে, যা দিয়ে ভারতের বিভিন্ন ঋণের দায় সমন্বয় করে প্রতিষ্ঠানটি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ঋণের অর্থ দিয়ে পরিচালন ব্যয় নির্বাহের অনুমোদন থাকলেও তা না করে রহিম আফরোজ ব্যাটারির হিসাবে অর্থ স্থানান্তরের মাধ্যমে দায় সমন্বয় করা হয়েছে। এই ঋণ তদারকিতে ব্যাংকের গাফিলতি ছিল।

একইভাবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের অপর প্রতিষ্ঠান সেমাট সিটি জেনারেল ট্রেডিংকে ২৩৬ কোটি টাকা (২ কোটি ৯৫ লাখ ডলার) ঋণ প্রদান করা হয়। নেপালের সড়ক নির্মাণ প্রতিষ্ঠান কেটিএন এনার্জি প্রাইভেট লিমিটেডকে বিটুমিন সরবরাহ আদেশের বিপরীতেই এ ঋণ দেওয়া হয়। বিটুমিন সরবরাহ হয়েছে কিনা, সে বিষয়েও ব্যাংকে কোনো নথি নেই।

এছাড়া সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠান এটিজেড কমিউনিকেশনস পিটিই লিমিটেডকে ৭৯ কোটি টাকা (১ কোটি ডলার) ঋণ দেয়া হয়। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান লেভেল থ্রি ক্যারিয়ার লিমিটেডকে ক্রয় আদেশের বিপরীতে ঋণ সুবিধা দেয়া হয়। এই কোম্পানি কার্যক্রম শুরু করে ২০১৪ সালের ৭ মে। অফশোর ইউনিট থেকে প্রতিষ্ঠানটিকে একই বছরের ২৮ মে ঋণ বিতরণ করা হয়। সিঙ্গাপুরের এটিজেড কমিউনিকেশনস মূলত খেলনা ও গেমস বিক্রি করে থাকে। আর বাংলাদেশী লেভেল থ্রি ক্যারিয়ার মূলত আইএসপি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। ফলে এ দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনো ধরনের কেনাকাটার প্রয়োজন নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, লেভেল থ্রি ক্যারিয়ার প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এছাড়া ভুয়া সরবরাহ আদেশ ও ঋণের অর্থ ব্যবহার বিষয়ে তথ্য না থাকায় ঋণের আড়ালে বাংলাদেশী স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হিসাবে অর্থ স্থানান্তর করা হয়েছে।

সিঙ্গাপুরের অপর প্রতিষ্ঠান ইউরোকারস হোল্ডিংস পিটিই লিমিটেডকে ১ কোটি ৪৮ লাখ ডলার (১১৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা) ঋণ সুবিধা দেয়া হয়। এই প্রতিষ্ঠানের পরিশোধিত মূলধন মাত্র ৩০ লাখ সিঙ্গাপুর ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ঋণপত্র খোলা হলেও এর বিপরীতে দেশে মালামাল আসেনি। আর খোলাই হয়েছে মাত্র ২০ লাখ ডলারের ঋণপত্র। বাকি অর্থ ব্যবহারের কোনো হিসাব নেই ব্যাংকের কাছে। পুরো ঋণই এখন মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে। প্রকৃতপক্ষে পণ্য আসার আগেই অর্থবিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের নামে টাকা পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে এসব অনিয়মের তথ্য। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্লোবাল এমই জেনারেল ট্রেডিংকে দেয়া ঋণের অর্থ ব্যবহার হয় ভিন্ন খাতে। আর প্রস্তাব বিচার-বিশ্লেষণ না করেই সেমাট সিটি জেনারেল ট্রেডিং, এটিজেড কমিউনিকেশনস পিটিই লি. ও ইউরোকারস হোল্ডিংস পিটিই লিমিটেডকে দেয়া হয়। এছাড়া এই তিন প্রতিষ্ঠানের জামানত কম থাকা সত্ত্বেও ইকুইটির তুলনায় বেশি ঋণ মঞ্জুর করা হয়। পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছে তদন্ত দল। কেন্দ্রীয় তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এই প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণের আড়ালে বাংলাদেশী স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির অনুকূলে টাকা পাচার করেছে। চারটি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ সুবিধা দেয়া হয়েছিল প্রায় ৪৫০ কোটি টাকার। এর মধ্যে ৩৪০ কোটি টাকা পাচার হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন দল প্রমাণ পেয়েছে।

জানা গেছে, বিদেশী চার প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টাকা আদায় করে সমন্বয় করতে ১২ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংক চিঠি দেয় এবি ব্যাংককে। সেখানে ৩১ মে’র মধ্যে ঋণ আদায়ের সময় বেঁধে দেয়া হয়। পাশাপাশি ঋণ প্রস্তাব বিশ্লেষণ, মঞ্জুর প্রক্রিয়া, ঋণ বিতরণ এবং পরবর্তী মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাদের শনাক্ত করে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়। সেখানে আরও বলা হয়, নির্দেশ বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে ঋণগুলোকে শ্রেণীকরণ করা হবে।

সূত্রে জানা গেছে, এবি ব্যাংক ৩১ মে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চিঠি দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছে। কিন্তু সার্বিক বিবেচনায় তা গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়নি। এরপর ২১ জুলাইয়ের মধ্যে ঋণগুলোকে শ্রেণীকরণ করার নির্দেশ দিয়ে দ্বিতীয় দফায় চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ৩০ জুন এবি ব্যাংক এক চিঠির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানায়, আরব আমিরাতের শিল্প প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল এমই জেনারেল ট্রেডিং সুদসহ সব পাওনা বাবদ ১০ কোটি ৭৭ লাখ (প্রায় ১৪ লাখ ডলার) পরিশোধ করেছে। অন্য তিনটি প্রতিষ্ঠান তাদের মোট বকেয়া ৪৬০ কোটি টাকার (৫ কোটি ৮১ লাখ ডলার) বিপরীতে ১২৩ কোটি টাকা (১ কোটি ৫৬ লাখ ডলার) পাওয়া গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, পাচারকৃত বাকি অর্থ ফেরত আনার ব্যাপারে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। -যুগান্তর



মন্তব্য চালু নেই