অবিশ্বাস্য হলেও সত্য : ১৮ বছর ধরে ভাত খাচ্ছে না কিশোরগঞ্জের কনিকা

অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই সত্যি। দীর্ঘ ১৮ বছর ভাত না খেয়ে জীবন-যাপন করছেন কলেজছাত্রী কোহিনুর আক্তার কনিকা। জন্মের পর থেকে ভাত স্পর্শ করেননি তিনি। অন্য সব কিছু খেলেও তার ভয় কেবল ভাতে। ফলে শিশুকাল থেকে আজ পর্যন্ত ভাত স্পর্শ করেননি কনিকা।

পরিবারের লোকজন তার মুখে ভাত তুলে দেয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। কনিকাকে নিয়ে তার পরিবার অনেক চিকিৎসক, কবিরাজ, এমনকি পীর-ফকিরের মাজারে গেছেন। অন্য খাবারের সঙ্গে কৌশলে ভাত মিশিয়ে আলো বন্ধ করে খাওয়ানোর চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। অবশেষে পরিবারের লোকজন হতাশ হয়ে এখন আর কনিকাকে ভাত খাওয়ানোর কোনো চেষ্টা করেন না।

তবে ভাত না খেয়ে সামান্য রুটি ও মুড়ি খেয়ে জীবন-যাপন করায় অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছেন কনিকা। সব সময় অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকে। দরিদ্র বাবা-মা ও আত্মীয়স্বজন তাকে পুষ্টিকর খাবার দিতে পারেন না। এ নিয়ে হতাশায় ভোগছে পুরো পরিবার।

সদর উপজেলার রশিদাবাদ ইউনিয়নের লতিফপুর গ্রামে বাস করেন কোহিনূর আক্তার ওরফে কনিকা। বাবার বাড়ি পার্শ্ববর্তী হোসেনপুর উপজেলার সাহেদল রহিমপুর গ্রামে। লতিফপুর গ্রামে নানা বাড়িতে থেকে শহরের একটি কলেজে লেখাপড়া করছেন তিনি। তার আরেক বোনও থাকে নানা বাড়ি। বাবা নরসিংদীতে একটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন।

কনিকার ভাত না খাওয়ার বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে তার নানা বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, কলেজছাত্রী কনিকা একটি জামদানি শাড়িতে জরি ও চুমকির কাজ করছেন। সাংবাদিক আসার খবর পেয়ে সেখানে হাজির হয় আশপাশের মানুষ। মানুষের ভিড় জমে যায় তাদের বাড়িতে। এ সময় কনিকার ভাত না খাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে এলাকাবাসী।

কথা বলার সময় হালকা-পাতলা গড়নের কনিকা এই প্রতিবেদককে জানান, তার কখনই ভাত খেতে ইচ্ছে করে না। ভাত তার কাছে খাবার জিনিসই বলে মনে হয় না।

কনিকা বলেন, খেতে ইচ্ছে করে না, তাই ভাত খাই না। কতদিন ধরে ভাত খান না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার বয়স এখন ১৮ বছর। জন্মের পর থেকে কোনো দিন ভাত খাইনি। এটা স্পষ্ট মনে আছে।

কনিকা জানান, তিনি সকালে আটার রুটি, দুপুরে ও রাতে মুড়ি খান। অন্য কোনো খাবারের প্রতি তার কোনো লোভ নেই। প্রশ্ন কেবল ওই ভাত নিয়ে।

কিশোরগঞ্জের কালটিয়া আর এস আইডিয়াল কলেজে এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী কনিকা। তার বাবার নাম আব্দুল কদ্দুস। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে কনিকা সবার বড়। ছোট বোন বীথি একই সঙ্গে কলেজে পড়ে। আর ইতি এবার জেএসসি পরীক্ষার্থী। একমাত্র ভাই জীবন সবার ছোট। ছোট বোন ইতি আর জীবন থাকে তার মায়ের সঙ্গে নরসিংদীতে।

কনিকার নানা আব্দুল হাশিম ও নানি হালিমা জানান, কোহিনুরের বাবা একটি কারখানায় সামান্য বেতনে কাজ করেন। পরিবারের ভরণ-পোষণ চালিয়ে মেয়েদের লেখাপড়া করাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। নিজে বাড়িতে থাকেন না। তাই দুই মেয়েকে নানা বাড়িতে রেখে লেখাপড়া করাচ্ছেন। প্রতি মাসে তার বাবা কিছু টাকা পাঠান। আর লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে বাড়িতে জামদানি শাড়িতে জরি ও চুমকির কাজ করেন কনিকা। একই সঙ্গে কনিকা বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ করেন। এতে সামান্য কিছু উপার্জন হয়। এ টাকা দিয়ে তার কলেজে যাতায়াত ও হাতখরচ চলে।

নানি হালিমা বলেন, আমাদের বাড়িতে আসার পরও তাকে বিভিন্ন সময় ভাত খাওয়ানোর চেষ্টা করেছি। অনেক সময় রাতের বেলা মুড়ির সঙ্গে ভাত মেখে আলো নিভিয়ে তার মুখে দেয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে ঠিকই টের পেয়ে যায়। কোনো অবস্থাতেই তাকে ভাত খাওয়াতে পারি না।

কনিকার মামী সোহাদা জানান, জন্মের পর কনিকার বয়স ৫ মাস হলে তার মা শামসুন্নাহার মেয়ের মুখে নরম করে ভাত তুলে দেন। তখনই সে মুখ থেকে ভাত ফেলে দিতো। শিশুকাল থেকে তাকে ভাত খাওয়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তবে সম্ভব হয়নি। বাধ্য হয়ে তাকে ৯ বছর পর্যন্ত তরল খাবার খাইয়ে রাখতে হয়েছে।

তিনি আরো জানান, কনিকাকে ভাত খাওয়ানোর জন্য তার বাবা-মা বিভিন্ন পীর-ফকিরের কাছে গেছেন। এখানে আসার পরও নানাভাবে তাকে ভাত খাওয়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।

প্রতিবেশী লতিফপুর গ্রামের মো. জামাল মিয়া বলেন, গ্রামের সবাই জানে কনিকা ভাত খায় না। স্কুলে যাওয়ার পথে আমি কয়েকদিন বাড়িতে নিয়ে ভাত খাওয়ানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু কিছুতেই ভাত খেতে রাজি হয়নি কনিকা।

পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কিশোরী কনিকা ভাত ছাড়া মাছ, মাংসসহ অন্যান্য স্বাভাবিক খাবার খায়। এমনকি কনিকার সামনে বসে কেউ ভাত খেলেও এতে তার কোনো লোভ হয় না।

কনিকার বাবা বলেন, অনেক কষ্ট করে তিন মেয়েকে লেখাপাড়া করাচ্ছি। উন্নত চিকিৎসা করানোর সাধ্য আমার নেই। তবে মেয়েটার জন্য কষ্ট হয়। ঈদ বা বিশেষ কোনো দিনে পোলাও রান্না করা হলেও মেয়ে খেতে চায় না। তাকে রেখে আমাদের খেতেও কষ্ট হয়।

এ ব্যাপারে কথা হলে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এ. এ. এম নাজমুল হুদা বলেন, এটা অনেকটা মানসিক রোগ। হয়তো সে ভাত খাবে না, নিজের মধ্যে এমন বদ্ধমূল ধারণা মনে পোষণ করে রেখেছে।

তিনি আরো বলেন, দীর্ঘদিন এভাবে চলতে থাকায় সে কোনো অবস্থাতেই নিজের মধ্যে লালন করা ইচ্ছে বা অভ্যস্ততার বাইরে আসতে পারছে না। তবে পরিবারের লোকজন চেষ্টা করলে এখনো তাকে অল্প অল্প ভাত খাওয়ানো সম্ভব। পাশাপাশি চিকিৎসকের সহযোগিতা ও পরামর্শ নিতে হবে।



মন্তব্য চালু নেই