অবৈধ বিদেশিদের নিয়ে বিপাকে পুলিশ

বাংলাদেশে প্রতিবছরই নানা কাজে বিভিন্ন দেশের নাগরিক আসছেন। এদের মধ্যে ট্যুরিস্ট, শিক্ষা ও অনঅ্যারাইভালসহ বিভিন্ন ভিসায় প্রবেশ করছেন কিছু বিদেশি। কিন্তু কিছুদিন পর তারা লাপাত্তা হয়ে যাচ্ছেন।

কূটনৈতিক বিচেনায় এসব নাগরিক অবৈধ হলেও নানা কৌশলে তারা অবস্থান করছেন দীর্ঘ সময় ধরে। ধীরে ধীরে তারা কার্ড জালিয়াতি, জাল মুদ্রা-ডলার তৈরি, নারী পাচার, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে।

যেমন ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতারণার অভিযোগে ১২ বিদেশি নাগরিকসহ মোট ১৪ জনকে আটক করেছে র‌্যাব। বাংলাদেশসহ চার দেশের নাগরিক মিলে একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে শিক্ষিত ও ধনী নারীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে প্রতারণা করে চক্রটি। এদের মধ্যে নাইজেরিয়ার ৮ জন, কঙ্গোর একজন ও ক্যামেরুনের ৩ নাগরিক রয়েছেন।

শুক্রবার দুপুরে র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান জানান, বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে তাদের আটক করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ল্যাপটপ, ট্যাব, মোবাইল সেট, দেশি টাকা ও বিদেশি মুদ্রা উদ্ধার করা হয়।

এর আগে কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে গ্রাহকের ২০ লাখ টাকা তুলে নেন জার্মানির নাগরিক থমাস পিওটর। তিনি দুই বছর ধরে এ দেশে অবস্থান করে একটি শক্তিশালী জালিয়াত চক্র তৈরি করে। এ চক্রে আরো কয়েকজন বিদেশির সঙ্গে বাংলাদেশি ব্যাংক কর্মকর্তা ও বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তি জড়িত।

এদের নাম ইতিমধ্যেই পিওটর গোয়েন্দাদের কাছে বলেছেন। ওই সব বিদেশিকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। আরেকজন বিদেশি নাগরিককে গোয়েন্দারা শনাক্ত করেছেন। পিওটরের এ দেশে থাকার কোনো বৈধ কাগজ নেই। কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংকের বুথ থেকে কী পরিমাণ টাকা তুলে নিয়েছেন, তার সঠিক হিসাব পিওটর গোয়েন্দাদের নিশ্চিত করতে পারেননি।

এদিকে এর আগে ফেসবুকের মাধ্যমে প্রতারণা করে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে তিন বিদেশিসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। তারা প্রত্যেকেই নাইজেরিয়ার নাগরিক। এরা সচ্ছল ব্যক্তিদের টার্গেট করে প্রতারণা করেছেন বলে অভিযোগ আছে।

কিছুদিন আগে এক ব্রিটিশ নাগরিক বাংলাদেশের একজন চিকিৎসকের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। গত ১০ ফেব্রুয়ারি একটি কুরিয়ার সার্ভিসের একজন প্রতিনিধি মোবাইল ফোনে চিকিৎসকে জানান যে, তার নামে বিদেশ থেকে একটি গিফট বক্স এসেছে। এর জন্য পরিবহন ব্যয় বাবদ ৫৬ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে।

১১ ফেব্রুয়ারি ওই কুরিয়ার সার্ভিসের ব্রাহ্মণবাড়িয়া শাখা থেকে একই প্রতিনিধি ওই একই মোবাইল ফোন নম্বর থেকে ফোন করে বলেন যে, গিফট বক্সের এক্সরে স্ক্যান রিপোর্টের তথ্যে দেখা যায় যে, এতে ডায়মন্ডের (হিরা) গয়না আছে যার মূল্য ২ কোটি টাকা। তাকে জানানো হয়, গিফট সংগ্রহ করতে হলে তাকে ২ লাখ ৬২ হাজার ৯০০ টাকা মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের হিসাব নম্বরে প্রেরণ করতে হবে। ১৪ ফেব্রুয়ারি চিকিৎসক মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে ওই টাকা পাঠান। কিন্তু ১৪ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ওই চিকিৎসককে ফোনে আবারও জানানো হয়, বক্সের ভেতর অনেক মূল্যবান দ্রব্যাদি থাকায় তাকে আরো ১০ লাখ ৮৩ হাজার টাকা দিতে হবে। এতে চিকিৎসকের কাছে সন্দেহজনক মনে হওয়ায় তিনি র‌্যাবকে বিষয়টি জানান।

একইভাবে গত সপ্তাহে এক অভিযানে প্রায় ৩০ বিদেশিকে আটক করে পুলিশ। তারা সবাই অবৈধভাবে এ দেশে বসবাস করছিলেন। গ্রেফতারের পর কোনো কাগজও দেখাতে পারেননি তারা। এর মধ্যে ২১ জন নাইজেরিয়া, কেনিয়া ও উগান্ডার এবং চারজন শ্রীলঙ্কার নাগরিক।

সংশ্লিষ্টদের মতে, বিদেশি অপরাধীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল এখন বাংলাদেশ। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে এই সব বিদেশিরা ঢাকায় বাসাভাড়া নিয়ে বাস করছেন এবং নানা অপরাধ করে যাচ্ছেন।

পুলিশের একটি শাখা থেকে জানা গেছে, অবৈধভাবে অবস্থানকারীদের মধ্যে রয়েছে ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, চীন, কোরিয়া, আফ্রিকা, ক্যামেরুন, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, নাইজেরিয়া, ঘানা, কঙ্গো, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, সুদান, তানজানিয়া, উগান্ডা ও শ্রীলঙ্কার নাগরিকরা। এসব বিদেশি নাগরিকের পছন্দের এলাকা হচ্ছে গুলশান, বনানী, রামপুরা, নিকুঞ্জ ও উত্তরা।

এসব দেশের ১২ হাজারেরও বেশি নাগরিক বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। এদের বেশির ভাগই হুন্ডি, জাল ডলার তৈরি ও বিক্রি, মাদক পাচার এবং নানা ধরণের প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। এ দেশে প্রবেশ করতে বিদেশি নাগরিকরা নানা কৌশল অবলম্বন করেন। ভিসা পেতে পর্যটক, খেলোয়াড় বা কোনো সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণ কিংবা স্বেচ্ছাসেবক সংস্থার কর্মী হিসেবে তথ্য প্রদান করেন। এদের বড় একটি অংশ ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও অবৈধভাবে এখানে অবস্থান করছেন। তারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। আয়কর ফাঁকি দেওয়াসহ চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর ঝামেলা এড়াতে বছরের পর বছর তারা ভিসা নবায়ন করছেন না।

এ বিষয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেন, ‘অপরাধী সে যেই হোক তাকে আইনে সোপর্দ করা হবে। সে ক্ষেত্রে কে বিদেশি তা দেখা হবে না। এ দেশের প্রচলিত আইনে তাদের বিচার করা হবে। না হলে গ্রেফতারের পর তাদের দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ট্যুরিস্ট ও অন্যান্য ভিসার পাশাপাশি বিনিয়োগ বোর্ডের মাধ্যমে শিল্প ও সেবা খাতে বিভিন্ন দেশের নাগরিক বাংলাদেশে এসে থাকেন। বেপজা ও বেসরকারি অর্গানাইজেশনের মাধ্যমেও আসেন তারা।

বিনিয়োগ বোর্ডের সর্বশেষ এক হিসাবে দেখা গেছে, শিল্প খাতে ৩ হাজার ৮০০ জন এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ৪ হাজার বিদেশি নাগরিক অবস্থান করছেন। তবে তাদের কোনো ওয়ার্ক পারমিট বোর্ড থেকে দেওয়া হয়নি। এদের ব্যাপারে তেমন কোনো তথ্যও নেই বোর্ডের কাছে।

শুধু ট্যুরিস্ট ভিসায় আসা বিদেশি নাগরিকদের মনিটরিং করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ইমিগ্রেশন শাখা। ভিন্ন ভিন্ন ডেস্ক পৃথকভাবে দায়িত্ব পালন করায় এবং সমন্বয় না থাকার কারণেই দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি নাগরিকদের সঠিক পরিসংখ্যান এবং তাদের ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না।

আর ওয়ার্ক পারমিট কিংবা ভিসার মেয়াদ না থাকলেও বিদেশি নাগরিকদের কাগজপত্র দেখতে চাওয়ার ব্যাপারে উচ্চপর্যায় থেকে তাদের ওপর তেমন কোনো নির্দেশনা নেই। এ কারণে বিদেশিদের কাছে কাগজপত্র আছে কি না, সে বিষয়টি জানতেও ভয় পান আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা।

বাসা ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে পাসপোর্ট জমা দেওয়ার বিধান থাকলেও অধিকাংশ বিদেশি এসব আইন মানেন না। এ কারণেই বিদেশিরা এখানে অপরাধ করার সুযোগ পাচ্ছেন। তাদের নিয়ে একপ্রকার বিপাকে পড়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন।

যারা অবৈধভাবে বছরের পর বছর বসবাস করছেন তাদের মধ্যে প্রতারক, জঙ্গি, সন্ত্রাসী ছাড়াও বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুন্নকারী আরো বড় ধরনের নাশকতাকারী কেউ থাকতে পারেন। গুলশান, বনানী, উত্তরার মতো অভিজাত এলাকাগুলোকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিয়েছে তারা।

মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরেই এ দেশে সক্রিয় আছে। এরা বেশির ভাগই পাকিস্তানের। এ ছাড়া ভারত ও বাংলাদেশের চোরাকারবারিদের বিদেশি অপরাধী চক্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। তাদের ধরতে গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত আছে।’রাইজিংবিডি



মন্তব্য চালু নেই