অর্থমন্ত্রী-ঢাবি ভিসির ‘ইউনূস প্রীতিতে’ বিব্রত সরকার!

হঠাৎ করেই আবার আলোচনায় গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পদ্মা সেতু দুর্নীতির অভিযোগ থেকে মুক্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে গত মাসের শুরুতে এই দুর্নীতি অভিযোগের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার ব্যাপারে ব্যাপক সমালোচিত হন ড. ইউনূস। সেই রেশ কাটতে না কাটতেই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ক্ষুদ্রঋণ ও দারিদ্র্য বিমোচনে ড. ইউনূসের প্রশংসাসূচক বক্তব্যের জের ধরে আবারো আলোচনায় আসেন বহুল বিতর্কিত ড. ইউনূস। হন সমালোচিত।

সেই সঙ্গে সরকারের তোপের মুখে পড়েন অর্থমন্ত্রীও। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা করায় সরকারের ভেতর ও বাইরে ব্যাপক বিষোদ্গারে পড়েছেন নানা বক্তব্যের কারণেই বিতর্কিত এই অর্থমন্ত্রীও। সামনে চলে আসছে ড. ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ ও দারিদ্র্য বিমোচনের নেতিবাচক চিত্র এবং তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও দুর্নীতির তথ্য। একইভাবে কেন বা কি উদ্দেশে এমন বিতর্কিত ব্যক্তির প্রশংসা করে বসলেন বর্ষীয়ান এই অর্থমন্ত্রী-প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও।

একইভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনকে ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ড. ইউনূসের নাম আসা নিয়েও শুরু হয়েছে তোলপাড়। এমনকি সেখানে সবার শেষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম আসায় সমালোচনার মুখে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও।

পরে যদিও কর্তৃপক্ষ সংশোধন এনে ড. ইউনূসের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে; কিন্তু সে ঘটনায় গোটা দেশে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বইছে। এ নিয়ে অর্থমন্ত্রীর মতো তোপের মুখে পড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যও।

হঠাৎ করেই ড. ইউনূসের প্রতি কেন এমন প্রীতি; কেনই বা সামনে চলে আসছেন তিনি—এ নিয়ে নানা মহলে দেখা দিয়েছে নানা আলোচনা ও বিশ্লেষণ। বিশেষ করে সরকারের ব্যাপক অপছন্দের হওয়া ও তা জানা সত্ত্বেও সেই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও সরকারদলীয় উপাচার্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. ইউনূস এমন করে প্রশংসিত হওয়ায় এ নিয়ে সরকারও কিছুটা বিব্রত। এটি কি নিছক কথা প্রসঙ্গে বলা বা অসাবধানতাবশত তার নাম সংযুক্ত করা, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে-উঠছে সে প্রশ্নও।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের দুই মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের দুই শীর্ষ নেতা বলেন, অর্থমন্ত্রীর এ ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। যেখানে তিনি নিজে ড. ইউনূসের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত এবং বিভিন্ন সময় ড. ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আসছেন, সেখানে এমন করে প্রশংসা করায় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি ভালোভাবে নেননি।

এ বিষয়ে জানতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে ফোনে পাওয়া যায়নি। তবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, এই সাইটটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত। এর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

এদিকে ড. ইউনূসের প্রশংসা করে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যকে অর্থমন্ত্রীর ‘স্বভাবসুলভ বক্তব্য’ হিসেবেই নিয়েছেন বিশ্লেষকরা। অর্থমন্ত্রীর বয়স বিবেচনা করে আমলে নিতে চাইছেন না বিষয়টি। তবে ড. ইউনূসের নামের শেষে বঙ্গবন্ধুর নাম লেখা এবং পরে সংশোধন করা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে দায়িত্বহীনতার অভিযোগ তুলেছেন তারা। তবে, বিশ্লেষকরা স্পর্শকাতর বিষয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আরো সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

এ ব্যাপারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের কোনো রাজনৈতিক তাৎপর্য নেই। বরং তার বক্তব্যের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী দারিদ্র বিমোচনে যে বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যা করেছে, সেটি চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয়। সরকারের এই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া উচিত। এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক এই দুই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে আরো সতর্ক হওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন।

গত ২ মার্চ রাজধানীর এক অনুষ্ঠানে ক্ষুদ্রঋণের কারণেও দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, এ জন্য গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের অবদান রয়েছে।

সেদিন অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনে ও হতদরিদ্রদের প্রথম ক্ষুদ্রঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করেছে গ্রামীণ ব্যাংক। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্মানিত ব্যক্তি। তাকে সম্মান দিতে হবে। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদও একজন সম্মানিত ব্যক্তি। ব্র্যাক ও গ্রামীণ ব্যাংকের পরে অনেক বেসরকারি সংস্থা ক্ষুদ্রঋণ খাতে এসেছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে তারা ঋণ দিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের এ কার্যক্রমের কারণে দেশে দারিদ্র্যের হার অনেক কমেছে।

সেদিন তার এ বক্তব্যের পরপরই বিভিন্ন মহলে নানা ধরনের সমালোচনা শুরু হয়। সরকারও অস্বস্তিতে পড়ে। এ নিয়ে অবশ্য সরকারের কোনো মন্ত্রী বা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকে রোববার দুপুরের আগে পর্যন্ত প্রকাশ্য কোনো মন্তব্য করতে শোনা যায়নি। দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে প্রথম ক্ষুদ্রঋণের বিষয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রশংসা করায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সমালোচনা করেন।

রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের পঞ্চম জাতীয় সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, আমার দুঃখ লাগে সেদিন অর্থমন্ত্রী এমন একজনের প্রশংসা করে ফেললেন, যার কারণে আমার পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করে দেয় বিশ্বব্যাংক। এরপর আমাকে আমেরিকা থেকে বারবার থ্রেট (হুমকি) করা হয়। অথচ তিনি তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অর্থমন্ত্রী খুব ক্ষুদ্রঋণের প্রশংসা করে বললেন যে ক্ষুদ্রঋণের জন্য নাকি দারিদ্র্য বিমোচন হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন যদি তার জন্যই হতো, তাহলে আর ৬০ ভাগের মতো দারিদ্র্য থাকে কেন, কিভাবে এটা ২২ ভাগে নেমে এসেছে, কবে নেমে এসেছে।’

অর্থমন্ত্রীর উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি অর্থমন্ত্রীকেই বলব, উনি যদি হিসাব নেন, দারিদ্র্য যে ২২ ভাগে নেমে এসেছে, সেটা কাদের আমলে? আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ; যেটা অর্থমন্ত্রীও কর্মসূচি দিয়েছেন আবার কিবরিয়া সাহেব যখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন, তাকে দিয়েও আমি ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সালে যেসব কর্মসূচি নিয়েছিলাম, তারই ফলাফলে আজকে দারিদ্র্য বিমোচন হয়েছে।’

অন্যদিকে, শনিবার ৫০তম সমাবর্তন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেসবুক পেজে দেয়া একটি শুভেচ্ছাবার্তা নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। শুভেচ্ছাবার্তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আগে ড. ইউনূসের নাম দেয়ায় এই বিতর্কের সৃষ্টি হয়। পরে তিনবার সংশোধনের পর ইউনূসের নাম সেখান থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। এ নিয়ে সরব হয়ে ওঠে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা। তারা সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সমালোচনাও করেছেন।

জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রাত ১১টা ৯ মিনিটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজে একটি শুভেচ্ছাবার্তা দেয়া হয়। শুভেচ্ছাবার্তায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস তুলে ধরে বলা হয়, ‘আমরা গর্বিত হয়েছি স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমর্ত্য সেনের মতো বুদ্ধিজীবীদের সম্মানসূচক ডক্টরেটে ভূষিত করতে পেরে। গর্বিত হয়েছি ড. মুহাম্মদ ইউনূস, সত্যেন বসু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো ছাত্রদের ধারণ করতে পেরে।’

মূলত দ্বিতীয় লাইনে বঙ্গবন্ধুর আগে ড. ইউনূসকে নাম দেয়া নিয়ে শুরু হয় সমালোচনা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়কের নাম ড. ইউনূসের নামের পরে কিভাবে বসে এ নিয়ে নানা মন্তব্য করে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা। বঙ্গবন্ধুকে অসম্মান করতে পরিকল্পিতভাবে এই কাজ করা হয়েছে বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন।

এর আগে গত বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মরণিকায় জিয়াউর রহমানকে ‘প্রথম রাষ্ট্রপতি’ লেখায় সমালোচনার ঝড় ওঠে। এবার বঙ্গবন্ধুর আগে ড. ইউনূসের নাম লেখায় নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিল।



মন্তব্য চালু নেই