‘আইনের শাসন’ এ যেন সোনার হরিণ!

২০০৭ সালে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের প্রকাশ্যে হাউমাউ করে কান্নার দৃশ্যের কথা আজও ভুলতে পারেনি। বিগত ১/১১ সরকারের সময় তরি ঘড়ি করে যখন নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ করা হয় তখন বিচারিক ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের কিছু ক্ষমতা ও অধিকার নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট রোকন উদ-দৌলা এক অনুষ্ঠানে জ্বালাময়ী বক্তব্য দেয়ার একদিন পরই মিডিয়ার সামনে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়ে চাকরি রক্ষা করেছিলেন। ওই সময় ভেবেছিলাম এই নাকি আমাদের দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে।রাষ্ট্রের সর্বস্তরের নাগরিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার ভোগ করতে পারবেন।

কিন্তু জনেগণের সেই আশা একবারেই গুড়ে বালি। আমরা কী দেখলাম- বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের আগে যতটুকুই দেশে আইনের শাসন ছিল পরবর্তীতে তাও যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। এর মাধ্যমে নাগরিকের আইনী সুরক্ষা পা্ওয়ার শেষ বিন্দুটুকুও যেন নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। আজ দেশে মানবতা কাঁদছে- প্রকাশ্যে চলছে নারী-শিশু নির্যাতনের মহোৎসব, দিনদুপুরে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সামনে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে নারীর ইজ্জত হরণ করা হচ্ছে, প্রকাশ্যে ঘরে-বাইরে কুপিয়ে মানুষ খুন করা হচ্ছে।দুর্নীতির রাঘববোয়ালরা হাজার কোটি টাকা লুটে রাষ্ট্রীয় তথা জনগণের সম্পদ গ্রাস করলেও সবাই নির্বিকার। আমাদের সংবিধানে নাগরিক অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে যে বৈষম্যহীনতার কথা বলা হয়েছে তা যেন কাগজের সংবিধানেই সীমাবদ্ধ।

এ প্রসঙ্গে দু’একটি উদারহরণ না দিলেই নয়। আমরা কী দেখলাম-

এক. তারেক মাসুদ ও মিশুকের নিহতের ঘটনায় ঘাতকের এখনো বিচার না হলেও এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ ও সমালোচনায়- আবেগের বশবর্তী হয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাসে প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু কামনাকারীর ঠিকই শাস্তি হয়েছে।জানি না, তারেক মাসুদ ও মিশুকের ঘাতকের বিচার কবে নাগাদ পাবে তার স্বজনরা, আদৌ ঘাতকের শাস্তি হবে কী না তাও আমাদের সবার অজানা।

দুই. আমরা জানি বিগত ১/১১ সরকারের সময় আমাদের দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি দুর্নীতির মামলা হয়েছিল। ক্ষমতার পট পরিবর্তনে একনেত্রী সব মামলা থেকে অব্যাহতি পেলেন, কিন্তু অপর নেত্রী আজও আদালতের বারান্দায়।তাঁর বিরুদ্ধে দুই-তিনটি মামলা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে।

তিন. বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা মাঠে কর্মসূচি পালন করতে গেলেও প্রকাশ্যে গুলি করে কিংবা গ্রেফতার নির্যাতন করে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী। অন্যদিকে প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পরও কিংবা নারীদের ইজ্জত হরণের পর তারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়। এই হলো আমাদের আইনের শাসন।

চার. সদ্য এক মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত দৈনিক আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আমি মনে করি, সরকার প্রধানকে খুশি করতেই এই রায় দেয়া হয়েছে। সংবিধানে লেখা আছে আইন সবার জন্য সমান স্কাইপ কেলেঙ্কারী ছাপার জন্য আমার দেশ বন্ধ করা হয়েছে… একই অপরাধ করে ৭১ টিভি এখনো চলছে … জনকণ্ঠ বন্ধ হয়নি এর অর্থই হলো আইন সবার জন্য সমান নয়… আইন শুধু খাতা কলমে থাকলে হবে না আইনের শাসন বাস্তবে থাকতে হবে আমি এবং আমার দেশ পরিবার সেই লড়াইয়ে নেমেছি। লড়াইয়ে আপনাদেরও পাশে চাই …”!( অনলাইন বাংলাডটকমডটবিডি, ১৩ আগস্ট ২০১৫ ১৪:৪২ টা)

এ ধরনের হাজারো ঘটনার অবতারণা করা যাবে, থাক এসব বিষয়। এবার আসি আইনের শাসন প্রসঙ্গে।
আমাদের নেতা নেত্রীরা কথায় কথায় বলে থাকেন, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কী সরকারি দলের, কী বিরোধী দলের। আর আমাদের সুশীল সমাজ তথা বুদ্ধিজীবীরাও বলেন, দেশে আইনের শাসন বলে কিছু নেই। সেই ছোটকাল থেকে এই একই কথা শোনে এসেছি। কিন্তু আসলে এই শাসন বলতে তারা কি বোঝাতে চান, আর এই শাসনের ধরনই বা কি তা আমার আজও বোধগম্য নয়।

আইন নিয়ে কখনো ঘাটঘাটি করি নাই, ছাত্রজীবনে আইন বিষয়ে লেখাপড়াও করিনি। ফলে এ বিষয়ে আমার জ্ঞান শূন্যের কোঠায়। তবে সরকার ও রাজনীতি এবং শিক্ষা বিষয়ে অধ্যয়ন-গবেষণার ফলে বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের লেকচার এবং বিভিন্ন লেখকের লেখা বই-পুস্তক পড়ে কিংবা রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের বিভিন্ন থিওরি পড়ে যতটুকু জানার চেষ্টা করেছি তার ভিত্তিতে আইনের শাসন তাত্ত্বিক ভিত্তি এবং বর্তমানে দেশের প্রেক্ষাপটে কিছু বিক্ষিপ্ত ভাবনা এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

যতদূর জানা যায় তাতে, সতেরো শতকে “The rule of law ” এই শব্দটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রথম ব্যবহৃত হলেও এটার থিম পাওয়া যায় মূলত প্রাচীন দর্শনে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটল বলেছিলেন, “আইনকেই শাসন করা উচিত”।

এরিস্টটলের শিক্ষা গুরু প্লেটোর মতে, “যদি আইন হয় সরকারের প্রভু আর সরকার হয় আইনের দাস, তখন সবকিছুতে একটা প্রতিশ্রুতি থাকে এবং তখন নাগরিকরা একটি রাষ্ট্রে ঈশ্বরের ঢেলে দেয়া পুরো রহমত উপভোগ করে”( John cooper, Complete works of Plato, P. 1402)।

তাই বলে “আইনের শাসন” ধারণাটি কিন্তু পুরোপুরি পাশ্চাত্য কনসেপ্ট এটা বলা যাবে না। কেননা, প্রাচীন চীনা দর্শনে দেখা যায়, যীশুর জন্মের তিন শতক আগে হান ফেই যি বলেন, শাসক (ব্যক্তি) নয়, শাসন করবে আইন, আর আইন হতে হবে লিখিত ও প্রকাশ্য।

ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ইসলামী খোলাফায়ে রাশেদীনের শাসনামলেও আইনের প্রাধান্যের উপর জোর দেয়া হয়। বলা হয়, খলিফাও যদি আইন লঙ্ঘন করে, তবে আইন মোতাবেক তাঁকেও শাস্তি পেতে হবে।

এছাড়া ১২১৫ সালে ইংল্যান্ডের রাজা জন বিখ্যাত দলিল “ম্যাগনা কার্টা”নামে যে দলিলটি সই করেন। সেখানেও আইনের শাসনের উপর জোর দেয়া হয়েছে। ফলে কিছুটা হলেও ইংল্যান্ডের শাসককূল আইনের অধীনে আসে।

আধুনিককালে রাষ্ট্রচিন্তাবিদ, দার্শনিক ও আইনবিদ জন লক, মথেস্কুসহ আরো অনেক আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ ও দার্শনিকের চিন্তা চেতনায় বার বার প্রতিফলিত হয় আইনের শাসন তত্ব। স্যামুয়েল রাদারফোর্ড বই লিখেন, “রেক্স লেক্স”, যার অর্থ, রাজা (রাজার কথা) আইন নয়, বরং আইনই রাজা।

বৃটিশ আইনবিদ, এ ভি ডাইসির কথা না বললেই নয়। তিনি বলেছেন। “আইনের শাসন” নিয়ে আলোচনা ঠুনকো। ডাইসি “আইনের শাসন” বলতে মূলতঃ নিম্নোক্ত তিনটি বিষয়কে বুঝিয়েছেনঃ

১। আইন ভঙ্গ করা ব্যতীত কাউকে শাস্তি দেয়া যাবেনা। কেউ আইন ভঙ্গ করেছে- তা সাধারণ আদালতে প্রমাণ হতে হবে।

২। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে সবাই আইনের চোখে সমান।

৩। ব্যক্তি-অধিকার বিচারিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

এছাড়া আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য World Justice Project’s এর দেয়া সংজ্ঞায় সার্বজনীন চারটি নীতির কথা বলা হয়েছে।

1.The government and its officials and agents as well as individuals and private entities are accountable under the law.

2.The laws are clear, publicized, stable, and just; are applied evenly; and protect fundamental rights, including the security of persons and property.

3.The process by which the laws are enacted, administered, and enforced is accessible, fair, and efficient.

4.Justice is delivered timely by competent, ethical, and independent representatives and neutrals who are of sufficient number, have adequate resources, and reflect the makeup of the communities they serve

এই তো মোটামুটিভাবে আইনের শাসনের থিওরিটিকাল কথা। ফলে এই আলোচনা থেকে সহজে বোঝা যায়, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আইনের শাসন কতটা গুরুত্বপূর্ণ। স্বৈরাচার শাসকের স্বেচ্ছাচারিতার বিপরীতে আইনের শাসন কত বড় একটি রক্ষাকবচ।

সবমিলেই আইনের শাসন হলো- রাজা, বাদশাহ, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, আমলা, বিচারপতি, সেনা, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট, উকিল, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, নেতা, রাষ্ট্রদূত, জেলে, কামার-কুমার, রিকশাওয়ালা, লম্বা, খাটো, কালো, ফরসা, শিশু, বুড়ো, হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম সবাই আইনের চোখে সমান ও অধীন থাকবে। শাসকের কথা বা ইচ্ছা নয়, রাষ্ট্র বা সমাজ চলবে শুধুমাত্র আইন দ্বারা। আইন-ই রক্ষা করবে নাগরিককে, আইন-ই ঠিক করবে নাগরিকের অধিকার, দেবে নিরাপত্তা, নাগরিকের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করবে আইন, কোন ব্যক্তি নয়।

তাই আইন হতে হবে পরিষ্কার, মানুষ যাতে সহজে বুঝতে পারে। আইনের আশ্রয় যাতে সবাই সহজে পেতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। আদালতে সবাই যেতে পারবে। বিচার বিভাগ থাকবে নির্বাহী বিভাগ বা অন্য যেকোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রভাব হতে স্বাধীন। বিচারক হবেন নিরপেক্ষ ও স্বাধীন, তবে স্বেচ্ছাচারী নয়। বিচারক সব পক্ষকেই শুনবেন, সমান সুযোগ দেবেন। আদালত হবে প্রকাশ্য। গোপনে গোপনে যেনতেনভাবে বিচার করে শাস্তি দেয়া যাবেনা কাউকে।

আইন বিভাগ তো আবার খারাপ (কালো) আইনও প্রনয়ণ করতে পারে। কাজেই প্রণীত আইন আবার জনস্বার্থবিরোধী হলো কিনা, বিচার বিভাগ তাও খতিয়ে দেখবে, প্রয়োজনে বাতিল করবে।

তাই মোটা দাগে বলা যায়- যেখানে আইনের শাসন নেই, সেখানে গণতন্ত্র নেই।অর্থাৎ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জণ্য জাস্টিস একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফলে আইনের শাসন ছাড়া কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক শাসনের দাবি করা যায় না। এখন আসি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে।আজকে আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কি চলছে, তা অবশ্য আমরা সবাই অবগত।আমাদের রাষ্ট্রের হর্তাকর্তারা কথায়-কথায় আইনের শাসন আর গণতন্ত্রের কথা বলেন। সকালে নাস্তা খেতে গিয়ে মনে হলে ব্যক্তির ইচ্ছায় বিকালেই কোনো কোনো আইন প্রণীত হয়, আবার কোনো আইন সেই ব্যক্তি ইচ্ছাও অবলুপ্ত হয়।

তবে আমাদের শাসকগোষ্ঠী যাই বলুক না কেন, সাম্প্রতিককালে আমাদের রাষ্ট্রের শাসন, আইন ও বিচার বিভাগের বেশ কিছু ভুমিকা নাগরিকদের ভাবিয়ে তুলেছে। গেল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন, সাম্প্রতিককালে প্রকাশ্যে হত্যা-খুন, নির্যাতনের মহোৎসব, গুম-অপহরণ, বিরোধীদের দমন নিপীড়ন, নারী ও শিশু নির্যাতন, দুর্নীতি সন্ত্রাসসহ নানা বিষয় এদেশের সংখ্যারিষ্ট জনগণের মনে রাষ্ট্র-সমাজ ও আইনের শাসন নিয়ে বধ্যমূল ভ্রান্ত ধারণার জন্ম দিয়েছে। ফলে আইনের শাসন ও গণতন্ত্র আমাদের সমাজে কতটুকু আছে, আর তা বা কতটুকু কার্যকর তা মোটামুটি সব নাগরিকই অবগম ও ভুক্তভোগী।ফলে আমাদের দেশে ‘আইনের শাসন’ এ যেন নাগরিকের জন্য সোনার হরিণ!

তাই সবশেষে বলবো- রাষ্ট্র-সমাজে আইনের শাসনের অনুপস্থিতি আজকের এই পরিস্থিতি দায়ী। যতদিন পর্যন্ত আইনের দৃষ্টিতে সকল নাগরিকের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা না হবে ততদিন এগুলো চলতেই থাকবে। সমাজ হবে আরো কুলষিত ও অনিরাপদ।তাই আসুন আমরা হানাহানি পরিহার করে সবাই মিলেমিশে দেশটাকে নাগরিকের জন্য নিরাপদ আবাস্থল হিসেবে পরিগণিত করি। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি সুস্থ সুন্দর গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলি, তবে সমাজের সব অনাচার দূর হবে যাবে।

লেখক: গবেষক ও কলামলেখক।ই-মেইল: [email protected]



মন্তব্য চালু নেই