আওয়ামী লীগ ও সরকার: স্বতন্ত্র অবস্থানে নাকি একাকার?

আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন এই দলটিকে নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে নতুন করে অনেক ধরণের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে।

তাঁরা বলেছেন, নবীন-প্রবীণ নেতৃত্বের সমন্বয়ে দলকে আরও সংগঠিত করার প্রত্যাশা নিয়ে তাঁরা এগুচ্ছেন।
তবে বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী এই দলটি এখন টানা আট বছর ক্ষমতায় থেকে সরকার এবং দলের মধ্যে পার্থক্য হারিয়ে ফেলেছে।

সাতষট্টি বছরের পুরোনো আওয়ামী লীগ তাদের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির আদর্শের জায়গাতেও অনেক ক্ষেত্রে আপোষ করেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পুরোনো ভবন ভেঙ্গে নতুন করে নির্মাণ করা হচ্ছে।

সেজন্য দলের জাতীয় কাউন্সিল আয়োজনের সব কর্মকান্ড ধানমন্ডিতে দলীয় সভানেত্রীর কার্যালয়ে চলছে। আর এই কর্মকান্ডকে কেন্দ্র সেখানে এখন সব সময়ই নেতা-কর্মীদের ভিড়।
দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকেও অনেক নেতা-কর্মী ইতোমধ্যে ঢাকায় এসেছেন। তারাও ভিড় করছেন ধানমন্ডির কার্যালয়ে।

তাদের কয়েকজনের সাথে সেখানে কথা হচ্ছিল। তাঁরা বলছিলেন, টানা সময় ধরে সরকারে থাকায় তাদের দলে সুবিধাবাদী অনেকে ভিড়েছেন। এর সাথে দলের দুর্বলতাগুলো নিয়ে কাউন্সিলে আলোচনা হবে বলে তাঁরা আশা করেন।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসে ২০০৯সালে। সেই থেকে দলটি এখন ক্ষমতায় থাকার আট বছর পার করছে। এখন দল এবং সরকার একাকার হয়ে গেছে। এটা কিন্তু দৃশ্যমান।
বিশ্লেষকদের অনেকে বলেছেন, দল ক্ষমতায় থাকায় আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মীর মধ্যে কিছু পাওয়া না পাওয়ার বিষয় সামনে আসছে। সে কারণে অনেক এলাকায় মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যকে ঘিরে একটি গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে, দল মাঠপর্যায়েও ব্যক্তি নির্ভর হয়ে পড়ছে বলে মনে করেন লেখক-গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ।

“তৃণমূলেও দল ব্যক্তি নির্ভর হয়ে পড়ছে, ব্যক্তিকে ঘিরে সুবিধাবাদী গোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে। তখন অনেক ক্ষেত্রে দলের আদর্শ কাজ করছে না। ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর দলের কর্মকান্ড চলছে। ফলে দলেই অস্তিত্বই প্রশ্নের মুখে পড়ছে” – বলছেন মি. আহমেদ।

এ নিয়ে আওয়ামী লীগেও আলোচনা রয়েছে এবং সিনিয়র নেতাদের অনেকে সমস্যাগুলোকে কিছুটা হলেও স্বীকার করেন। দলটির সভাপতিমণ্ডীর সদস্য এবং মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অবশ্য বিষয়গুলোকে ব্যাখ্যা করেন ভিন্নভাবে।

তিনি বলেন, “দল এবং সরকার অনেক সময় একাকারই হয়ে যায়। ক্ষমতার রাজনীতিতে দল এবং সরকারের স্বতন্ত্র সত্তা দুর্বল হয়ে যায়। তবে তৃণমূল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সংগঠন শক্তিশালী রয়েছে। সে কারণে এই দলের পক্ষে স্বতন্ত্র অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে।”

শেখ হাসিনা একইসাথে সরকার প্রধান এবং দলের সভানেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মাঠপর্যায়েও মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যরাই তাদের স্ব-স্ব এলাকায় দলের নেতৃত্বে রয়েছেন।

আওয়ামী লীগ যখন দল হিসেবে সরকার থেকে আলাদা বা স্বতন্ত্র ভূমিকা রাখতে পারছে না, সে কারণে অনেক ক্ষেত্রে দলের ভিতরে শৃংখলা ভেঙ্গে পড়ছে। সহযোগী সংগঠনগুলোতেও এর প্রভাব পড়ছে।

দলের সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নানান ধরনের ঘটনার জন্ম দিয়ে বিভিন্ন সময়ই আলোচনায় এসেছে। আওয়ামী লীগের নেতারাও অনেকে ছাত্রলীগের সমালোচনা করেছেন।

কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো দিক-নির্দেশনা দৃশ্যমান নয় বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।

“সরকার এবং দল একাকার হয়ে গেলে সাংগঠনিক কর্মকান্ডে বিশৃংখলা দেখা দেয়। আওয়ামী লীগ সে ধরণের একটা পরিস্থিতিতে পড়েছে” – বলছিলেন সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ঘটনার দীর্ঘ সময় পর ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফিরতে পেরেছিলেন। এরপর থেকে দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
তবে এখন দল এবং সরকারের মধ্যে সীমানা নেই বলে যে অনেকেই মনে করছেন, তা আওয়ামী লীগের তরুণ নেতাদের অনেকে মানতেই রাজী নন।

দলের একজন তরুণ নেতা এবং সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলছিলেন যে যেহেতু দল হিসেবে তারা ক্ষমতায়, সেকারণে সরকারের কর্মকান্ড দলীয় নেতা-কর্মীরা জনগণের কাছে তুলে ধরেন। সেটাকে ভিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই বলে তিনি মনে করেন।

তিনি আরও বলেন, “সরকার এবং দল স্বতন্ত্র অবস্থানে থেকেই কাজ করছে।”
আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির আদর্শের জায়গাতেও অনেক ক্ষেত্রে আপোষ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেছেন, গণতন্ত্রের প্রশ্নে দলটির ভূমিকা নিয়ে এখন মানুষের মনে এক ধরনের সন্দেহ তৈরি হচ্ছে।

“আওয়ামী লীগের ঐতিহ্য হচ্ছে, পাকিস্তানী আমলে ২৪ বছর গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করা। সেই ধারাবাহিকতায় দলটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগের গতি প্রকৃতি লক্ষ্য করলে দেখা যায়, দলটি গণতন্ত্র নিয়ে যথেষ্ট সচেতন নয়। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির জায়গাতেও অনেক ক্ষেত্রে আপোষের বিষয় চোখে পড়ে”-বলেন অধ্যাপক হোসেন।

তবে আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করেন, তাদের দল আদর্শের জায়গায় কোনো আপোষ করছে না।
খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা এবং সেটাকে কার্যকর করার বিষয়কে এক্ষেত্রে বড় উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন।

তাঁর বক্তব্য হচ্ছে,এই বিচারের বিরোধীরা রাজনৈতিকভাবেও একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করেছিল। তবে আওয়ামী লীগ তার শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো দিয়েই সেই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পেরেছে বলে মি: চৌধুরী উল্লেখ করেন।

আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকতে চাইছে,বিভিন্ন সময় দলটির নেতাদের অনেকে তাঁদের বক্তব্যে এমন ধারণাও দেয়ার চেষ্টা করেন। ফলে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের অনেক বিষয় উপেক্ষিত হচ্ছে। সেই পরিস্থিতি নিয়ে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে মানুষের মাঝে সন্দেহ দেখা দিচ্ছে বলে মনে করেন মহিউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায় থাকার বিষয়েই বেশি মনযোগ দিয়েছে। মাহাথীর যেমন মালয়েশিয়ায় গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করে উন্নয়ন করেছিলেন, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ এখন সেই যুগে প্রবেশ করছে।”

তবে এমন সব কথা নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা মাথা ঘামাতে রাজী নন। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত একতরফা নির্বাচন নিয়েও যে সমালোচনা ছিল, সেটাও রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব হয়েছে বলে তারা মনে করেন।ওবায়দুল কাদের বলেন, তারা নির্ধারিত সময়েই নির্বাচনে যাবেন। তারা এখন দলের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার দিকে নজর দিচ্ছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।

দলটির এবারের কাউন্সিল নিয়ে ব্যাপক আয়োজন। সাজসাজ রব। তৃণমুলের নেতাকর্মীদেরও প্রত্যাশা তাদের সাংগঠনিক কাঠামো আরও শক্ত করার ব্যাপারেই নজর দেয়া হবে।

যদিও দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে তাতে ব্যবস্থা নেয়ার কথা অনেকে বলছেন, কিন্তু কাউন্সিলে দলের সাংগঠনিক কাঠামো বা পদ্ধতিতে বড় ধরণের কোনো পরিবর্তন আসবে কিনা, তা নিয়ে বিশ্লেষকদের সন্দেহ রয়েছে।  বিবিসি বাংলা



মন্তব্য চালু নেই