আওয়ামী লীগের কৌশলী পর্যবেক্ষণে কেরির সফর

আওয়ামী লীগের কৌশলী পর্যবেক্ষণে কেরির সফর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির বাংলাদেশ সফরে দেশের চলমান রাজনৈতিক ধারায় কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটি মনে করছে উল্টো দীর্ঘদিন পর যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের (লিডারশিপ) প্রতি আস্থা স্থাপন করেছে এবং তার দূরদর্শী নেতৃত্বের স্বীকৃতি দিয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘বৈরী’ মনোভাবের এ দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়েও ঈষৎ ইতিবাচক অথচ কৌশলী অবস্থান নিয়েছে আওয়ামী লীগ।

চলতি সেপ্টেম্বরে কয়েকটি পশ্চিমা দেশ সফরের কথা রয়েছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর। এছাড়া জাতিসংঘ অধিবেশনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ বিশ্বের শক্তিধর কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গেও দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হওয়ার কথাও রয়েছে। সেসব সফর এবং আগামী অক্টোবরে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং-এর বাংলাদেশ সফর দেশের রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জন কেরি বাংলাদেশে সফর করে তার সারাংশ নিয়ে ভারতের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন বলে আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন। শাসক দলের নেতারা এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন। তারা বলছেন, বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতকে পাশ কাটিয়ে এখানে কোনো কিছু করার চেষ্টা করবে না যুক্তরাষ্ট্র। আর ভারত সব সময় বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু। জঙ্গিবাদ দমন এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভারত সরকার শেখ হাসিনার সঙ্গেই থাকবে বলে ভারত সরকার এবং সে দেশের ক্ষমতাসীন দল জন কেরিকে জানিয়েছেন বলে আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করেছেন।

সূত্র জানায়, আমেরিকা আগ বাড়িয়ে বন্ধুত্বের হাত বাড়ানোয় আওয়ামী লীগ দেশটির সঙ্গে তাদের দূরত্ব কিছুটা কমিয়ে আনতে চাচ্ছে; দ্বিপাক্ষিক স্বার্থের জন্য। ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই সরকারদলীয় নেতা ও মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে আসছিলেন। পরাশক্তির এ দেশটিও বিএনপিবিহীন দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে তাদের কৌশলগত অবস্থান কখনোই পরিষ্কার করেনি। তাই সর্বশেষ জন কেরির সোমবারের ১০ ঘণ্টার সফরকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হয়েছে এ কারণে যে, আওয়ামী লীগ মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র তার আগের অবস্থান থেকে নমনীয় হয়ে সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে চায়।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ গতকাল বলেন, কারো সঙ্গে সম্পর্ক চিরকাল এক রকম যাবে এমনটা ঠিক না। বঙ্গবন্ধুর দেয়া যে পররাষ্ট্র নীতি ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়’ আমরা সে নীতিতেই অটল আছি। এক সময় চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের অবনতি ছিল, এখন চীনের সঙ্গে আমাদের অনেক ভালো সম্পর্ক।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে আস্থা ও বিশ্বাসের কিছু টানাপড়েন রয়েছে। শাসক দলের নেতারা বলছেন, জন কেরি বাংলাদেশ সফরে ‘ইমোশনাল ডিপ্লোমেসি’র আশ্রয় নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দেয়া, বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিকে ফেরত দেয়ার বিষয়ে মৌন সম্মতি দেয়া- এসবের উদ্দেশ্যই ছিল প্রধানমন্ত্রীর ইমোশনকে ছোঁয়ার জন্য। আর এর আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল নির্দ্বিধায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করার জন্য একটি স্পেস (সুযোগ) তৈরি করা। যেন এ বিষয়টি নিয়ে শাসক দলের পক্ষ থেকে কোনো সমালোচনা না ওঠে এবং হয়েছেও তাই। বিএনপির সঙ্গে জন কেরির বৈঠকের বিষয়ে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা বা সরকারের মন্ত্রী কিছু বলছেন না। তবে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চাওয়ার বিষয়টির সমালোচনা রয়েছে শাসক দলে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিএনপি রাজনীতিতে টিকে থাকার সব টুলস (মাধ্যম) ব্যবহার করেছে। দেশে জ্বালাও-পোড়াও করে দাউদ ইব্রাহীম থেকে শুরু করে পাকিস্তান-আমেরিকা সবার দ্বারে দ্বারে দীর্ঘদিন ধরেই ঘুরছে। সর্বশেষ আইএসের শরণাপন্নও হয়েছে। সারাক্ষণ ষড়যন্ত্রের মধ্যে থাকায় তারা বাংলাদেশের মানুষের কাছে যেতে পারেনি।

জানা যায়, কৌশলগত কারণে জন কেরির কোনো সমালোচনা করছেন না শাসক দলের নেতারা। সংসদের বাইরে থাকা একটি দলীয় প্রধানের সঙ্গে জন কেরির বৈঠকের বিষয়ে মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও একটি দলের প্রধানের সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বৈঠক করতেই পারেন। তবে বিএনপি চেয়ারপার্সনের সমালোচনা করেন হানিফ। তিনি বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী একটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে তাদের দূতাবাসে যাওয়া দেশের জন্য লজ্জাজনক। কতখানি দেউলিয়া হলে একটি দলের প্রধান একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে, তার সঙ্গে দেখা করে গণতন্ত্র উদ্ধারে সহায়তা চায়! তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার বোঝা উচিত, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকার আছে বলেই জন কেরি এদেশে রাষ্ট্রীয় সফর করেছেন।

সরকারের বৈধতা নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনার সমাপ্তিও এ সফরের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি হবে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তারা বলেন, জন কেরি বিএনপিকে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। এর মধ্য দিয়ে বিএনপিকে একটি বার্তা দিয়েছেন যে, নির্বাচন ছাড়া সরকার পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই।

ভারতের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক দৃঢ়তর হচ্ছে এতেও আওয়ামী লীগে কোনো বাড়তি উদ্বেগ নেই। আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা বলেন, বাংলাদেশ তার প্রয়োজন ও স্বার্থ অনুযায়ী সবার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। এক্ষেত্রে কারো অভ্যন্তরীণ বিষয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব পড়বে না। তবে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে জাতিসংঘের আগামী অধিবেশনে বাংলাদেশ ইস্যু নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ বিশ্বের প্রভাবশালী কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একাধিক বৈঠক হতে পারে। আগামী অক্টোবরে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং-এর ঢাকা সফরের কথা রয়েছে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় ১৪ দলের একটি প্রতিনিধি দল চীন সফর করে এসেছেন। জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগদানের আগে কানাডা ও যুক্তরাজ্য সফর করবেন। পরে যাবেন যুক্তরাষ্ট্রে। সরকারি সূত্র জানায়, বর্তমানে চীন, ভারত, রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। নিয়মতান্ত্রিকভাবে আমেরিকাও বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে চায়।- মানবকণ্ঠ



মন্তব্য চালু নেই