আজ কুমারী পূজা

কুমারী পূজা শারদীয় দুর্গোৎসবের এক বর্ণাঢ্য পর্ব। বিশেষত কুমারীকে দেবী দুর্গার পার্থিব প্রতিনিধি হিসেবে পূজা করা হয়ে থাকে। এছাড়াও কালীপূজা, জগদ্ধাত্রী এবং অন্নপূর্ণা পূজা উপলক্ষে এবং কামাখ্যাদি শক্তিক্ষেত্রেও কুমারী পূজার প্রচলন রয়েছে। তবে দূর্গা পূজায় এর মাহাত্ম বেশি বলে মনে করেন ভক্তরা।

সব মণ্ডপে এ পূজার আয়োজন করা না হলেও দেশের রামকৃষ্ণ মিশনের কিছু কিছু শাখায় তা মহাষ্টমীর দিনে অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর ও বরিশাল অন্যতম। গ্রাম অঞ্চলেও কোন কোন মণ্ডপে কুমারী পূজার আয়োজন করা হয়ে থাকে।

সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমী–এই তিনদিনই দেবী পূজার অন্তে কোন কুমারী বালিকাকে নতুন বস্ত্র পরিধান করিয়ে দেবীজ্ঞানে পূজা করার রীতি। শনিবার মহা সপ্তমী পূজা শেষ হওয়ার পর থেকেই চলে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এ কুমারী পূজার আয়োজন। এ পূজার মূল ভক্ত হল সনাতন ধর্মের কিশোরীরা।

প্রতি বছর দুর্গাপূজার মহাষ্টমী পূজা শেষে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। তবে মতান্তরে নবমী পূজার দিনেও এ পূজা অনুষ্ঠিত হতে পারে। কালের অতলে দুর্গাপূজায় কুমারী পূজা হারিয়ে গেলেও স্বামী বিবেকানন্দ মাতৃজাতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ১৯০১ সালে বেলুর মঠে শ্রীরামকৃষ্ণ ও মা সারদাদেবীর অনুমতিক্রমে কুমারী পূজা পুনঃপ্রচলন করেন।

ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান মহারাজ স্বামী ধ্রুবেশানন্দ কুমারী পুজা নিয়ে বলেন, বৃহদ্ধর্মপুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী দেবতাদের স্তরে প্রসন্ন হয়ে দেবী চণ্ডিকা কুমারী কন্যারূপে দেবতাদের সামনে দেখা দিয়েছিলেন। দেবীপুরাণে বিস্তারিত এ বিষয় উল্লেখ আছে। তবে অনেকে মনে করেন যে, দুর্গা পূজায় কুমারী পূজা সংযুক্ত হয়েছে তান্ত্রিক সাধনামতে। এক সময় শক্তিপীঠ সমূহে কুমারী পূজার রীতি প্রচলিত ছিল। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদেও কুমারীর কথা উল্লেখ আছে। আর এ থেকে অনুমান করা কঠিন নয় যে, দেবীর কুমারী নাম অনেক পুরনো। দেবীর কুমারী নাম যেমন পুরনো, তার আরাধনা ও পূজার রীতিনীতিও তেমনি প্রাচীন এবং ব্যাপক।

যোগিনীতন্ত্র, কুলার্ণবতন্য, দেবীপুরাণ, স্তোত্র, কবচ, সহস্রনাম, তন্যসার, প্রাণতোষিণী, পুরোহিতদর্পণ প্রভৃতি ধর্মীয় গ্রন্থে কুমারী পূজার পদ্ধতি এবং মাহাত্ম্য বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। বর্ণনানুসারে কুমারী পূজায় কোন জাতি, ধর্ম বা বর্ণভেদ নেই।

তিনি অরো বলেন, দেবীজ্ঞানে যে-কোন কুমারীই পূজনীয় তবে সাধারণত ব্রাহ্মণ কুমারী কন্যার পূজাই সর্বত্র প্রচলিত। তন্ত্রসারে এক থেকে ষোল বছর পর্যন্ত ব্রাহ্মণ বালিকাদের কুমারী পূজার জন্য নির্বাচিত করা যায়। তবে অন্য জাতির কন্যাকেও কুমারীরূপে পূজা করতে বাধা নেই। কিন্তু অবশ্যই তাদের ঋতুবতী হওয়া চলবে না। ধর্মের বিধান।

মহরাজ বলেন, আজ কুমারী পুজা সকাল ১১ টায় রামকৃষ্ণ মিশনে শুরু হবে।প্রতি বছরের ন্যায় এবারো বর্ন্যাঢ্য আয়োজন থাকবে। সনাতন শাস্ত্রে যা যা করণীয় সবই পালন করা হবে। সামাজিক ভাবে কোনো বিধি নিষেধ থাকছে না পূজাতে। সনাতন ধর্মে যা আছে তা নিয়েই আমাদের আয়োজন থাকছে।

কুমারী পূজার দার্শনিক তত্ত্ব নিয়ে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রঞ্জিত চক্রবর্ত্তী বলেন, কুমারী পুজা হলো হলো নারীতে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জন। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে যে ত্রিশক্তির বলে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় ক্রিয়া সাধিত হচ্ছে, সেই ত্রিবিধ শক্তিই কুমারীতে নিহিত। কুমারী প্রকৃতি বা নারী জাতির প্রতীক ও বীজাবস্থা। তাই কুমারী বা নারীতে দেবীভাব আরোপ করে তার সাধনা করা হয়। এ সাধন পদ্ধতিতে সাধকের নিকট বিশ্ব জননী কুমারী নারীমূর্তি স্বরূপ ধারণ করে। তাই তার নিকট নারী ভোগ্যা নয়, পূজ্যা।

পৌরাণিক কল্পকাহীনিতে বর্ণিত আছে, এ ভাবনায় ভাবিত হওয়ার মাধ্যমে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নিজের স্ত্রীকে ষোড়শীজ্ঞানে পূজা করেছিলেন।

কুমারী ভগবতীর দেবী দুর্গার সাত্ত্বিক রূপ। জগন্মাতা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্ঠিকর্ত্রী হয়েও চির কুমারী। কুমারী আদ্যাশক্তি মহামায়ার প্রতীক।

দুর্গার আরেক নাম কুমারী। মূলত নারীর যথাযথ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতেই কুমারী পূজার আয়োজন করা হয়। মাটির প্রতিমায় যে দেবীর পূজা করা হয়, তারই বাস্তবরূপ কুমারী পূজা। কুমারীতে সমগ্র মাতৃজাতির শ্রেষ্ঠ, শক্তি, পবিত্রতা, সৃজনী ও পালনী শক্তি, সকল কল্যাণী শক্তি সূক্ষ্ম রূপে বিরাজিতা।

কুমারী পুজা কেন করে: শ্রীরামকৃষ্ণের কথামৃতে বলা আছে- সব স্ত্রীলোক ভগবতীর এক-একটি রূপ। শুদ্ধাত্মা কুমারীতে ভগবতীর বেশি প্রকাশ।’

প্রথা ও নিরাপত্তার কারণে মেয়েটির নাম এবং পরিচয় পূজা সূচনার পূর্বাব্দী প্রকাশ করা হয় না। সব নারীতে মাতৃরূপ উপলব্ধি করাই কুমারী পূজার লক্ষ্য। সকালে নির্দিষ্ট কুমারীকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরানো হবে। ফুলের মালা চন্দন ও নানান অলংকার- প্রসাধন উপাচারে নিপুণ সাজে সাজানো হবে কুমারীকে।



মন্তব্য চালু নেই