আদালতে স্বীকারোক্তি : ১২০ টাকায় ছুরি কিনি, পেটের বাম পাশে আঘাত করি

স্কুলছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশার ঘাতক ওবায়দুল হক আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। স্বীকার করেছে হত্যার কথা, পাশাপাশি দিয়েছে হত্যাকাণ্ডের বিশদ বর্ণনা। একবছর আগে টেইলার্সে রিশাকে প্রথম দেখেছিল সে। এরপর প্রেম নিবেদনের চেষ্টা। আর এই প্রেমে ব্যর্থ হয়েই রিশাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল সে। এজন্য ১২০ টাকায় কেনে ছুরি। রিশাকে ছুরিকাঘাত করার পর পালিয়ে যায় নিজের গ্রামের বাড়ি, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তার। নীলফামারীর ডোমার এলাকা থেকে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় পুলিশ তাকে ১ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করে।

পরে ছয়দিনের রিমান্ডে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে ওবায়দুল স্বীকারোক্তি দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। এরপর গত ৫ সেপ্টেম্বর মহানগর হাকিম আহসান হাবীবের খাস কামরায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় সে। আদালতে ওবায়দুল বলে, ‘আমি স্বেচ্ছায় এবং কারও বিনা প্ররোচনায় রিশা হত্যার দায় স্বীকার করলাম।’

আদালত সূত্র জানায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ওবায়দুল বলেছে, তার নাম ওবায়দুল হক। পিতার নাম মৃত আব্দুস সামাদ, সাং মিরাটঙ্গী, থানা বীরগঞ্জ, জেলা দিনাজপুর। সে বৈশাখী টেইলার্স, ইস্টার্ন মল্লিকা মার্কেট (৩য় তলায়), এ্যালিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট, ঢাকা- এর টেইলার মাস্টার হিসেবে দুই বছর ধরে কর্মরত। প্রায় একবছর আগে সুরাইয়া আক্তার রিশা ও তার মা কাপড় বানানোর জন্য তার টেইলার্সে গেলে তাদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। প্রথম দেখাতে সুরাইয়া আক্তার রিশাকে তার পছন্দ হয়। এর ২/৩ দিন পর সে রিশার মায়ের কাপড়ের মাপ জানার অজুহাতে তার কাছে থাকা রিশার মায়ের মোবাইল নাম্বারে ফোন দেয়। ফোন রিশা ধরলে তার সঙ্গে ওবায়দুলের কথা হয়। ওবায়দুল জানতে পারে ওই ফোন নম্বরটি রিশা ব্যবহার করে। এরপর থেকে ওবায়দুল প্রায়ই রিশার মোবাইলে ফোন দিতে থাকে।

জবানবন্দিতে ওবায়দুল বলে, ‘সুরাইয়া আক্তার রিশার সঙ্গে দেখা হবার ২ মাস পরে আমি মোবাইলের মাধ্যমে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেই। এর কিছুদিন পর রিশা আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে আমি রিশার আম্মাকে ফোন দিয়ে বলি যে রিশার সঙ্গে আমার প্রেমের সম্পর্ক আছে। তখন রিশার আম্মা আমাকে রিশার সঙ্গে যোগাযোগ করতে নিষেধ করে। আমি তার নিষেধ না শুনে রিশার মোবাইলে কল দিলে রিশার আম্মা ও দাদী ফোন রিসিভ করে আমাকে গালিগালাজ করতো।’

৩/৪ মাস আগে রিশা আমার মোবাইল নম্বর ব্লক করে দেয় জানিয়ে ঘাতক ওবায়দুল বলে, ‘এজন্য কয়েক মাস আমি সুরাইয়া আক্তার রিশার সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ করে কথা বলতে ব্যর্থ হই। আমি রিশার সঙ্গে কথা বলার জন্য বেশ কয়েকবার উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের সামনে যাই এবং তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি। কিন্তু বলতে ব্যর্থ হই। এর মধ্যে একদিন আমি তার সঙ্গে জোর করে কথা বলতে চাইলে রিশা আমাকে জানায় যে, সে আমার সঙ্গে প্রেম করবে না। ইতোমধ্যে আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারি যে, অন্য একটি ছেলের সঙ্গে রিশার প্রেমের সম্পর্ক আছে। এই কথা জানার পর আমার ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।’

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ওবায়দুল বলে, ‘রিশা যাতে অন্যকোনও ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক করতে না পারে সেজন্য আমি তাকে উচিৎ শিক্ষা দেবার পরিকল্পনা করি। গত ২২ আগস্ট সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার সময় আমি বাংলাদেশ হার্ডওয়্যার অ্যান্ড পেইন্ট সাপ্লাই নামক দোকান হতে ১২০ টাকা দিয়ে একটি ছুরি ক্রয় করি। রিশাকে মারার জন্য গত ২৪ আগস্ট বেলা সাড়ে ১১টার সময় আমি ছুরিসহ কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। বেলা অনুমান সাড়ে ১২টার সময় রিশা তার কয়েকজন সহপাঠীসহ স্কুল থেকে বের হয়ে ফুটওভার ব্রিজের ওপর ওঠে।’

রিশাকে আক্রমণ করার বর্ণনা দিয়ে ওবায়দুল বলে, ‘আমি রিশার কাছে গিয়ে আমার কাছে থাকা ছুরি দিয়ে রিশার পেটের বাম পাশে সজোরে আঘাত করে ছুরিসহ ফুটওভার ব্রিজের নিচে নেমে দৌড়ে ব্যাটারি গলি দিয়ে সেগুনবাগিচা রাজস্ব ভবনের সামনে যাই। রাজস্ব ভবনের সামনে রাস্তার ফুটপাতে ইট-সুরকি ও ময়লার মধ্যে ছুরিটি ফেলে দিয়ে পল্টন হয়ে গুলিস্তান যাই। সেখান থেকে সদরঘাট গিয়ে নদী পার হয়ে কেরানীগঞ্জে চাচাতো ভাই জসিমের কাছে যাই। ওইদিন বিকাল বেলা কেরাণীগঞ্জ হতে কোনাপাড়ায় আমার পরিচিত টেইলার্স মাস্টার সুনীল ও গৌর হরিদের কাছে গিয়ে ১ হাজার টাকা নেই। তারপর আমি শ্যামলী গিয়ে হানিফ পরিবহনে করে নিজ বাড়িতে যাই। এরপর টিভিতে রিশা মারা যাবার খবর শুনে আমি নীলফামারীতে আমার বেয়াই খুশবুলের কাছে যাই। সংবাদ পেয়ে রমনা থানা পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে রমনা থানায় নিয়ে আসে।’

ওবায়দুল জানায়, পুলিশ আমাকে হত্যা কাজে ব্যবহৃত ছুরি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আমি পুলিশের সঙ্গে গিয়ে ছুরি ক্রয়ের দোকানটি দেখিয়ে দেই এবং সেগুনবাগিচা রাজস্ব ভবনের সামনে রাস্তার ফুটপাতে ইট সুরকির পাশ থেকে ছুরিটি বের করে পুলিশের নিকট দেই।

প্রসঙ্গত, গত ২৪ সেপ্টেম্বর কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের সামনের ফুটওভার ব্রিজের ওপর রিশাকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায় ওবায়দুল। রিশাকে উদ্ধার করে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। চারদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ২৮ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৮টার দিকে মারা যায় সে। রিশা উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়তো। বাবা রমজান হোসেন ও মা তানিয়া হোসেনের সঙ্গে পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজার এলাকায় থাকতো। রিশা হত্যার ঘটনায় মা তানিয়া হোসেন বাদী হয়ে রমনা থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।



মন্তব্য চালু নেই