আমরা কি আসলেই নিরাপদ?

আশা মনি। সেক্যুলার ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নীলের স্ত্রী। আট মাস আগে (৭ আগস্ট) রাজধানীর পূর্ব গোড়ান টেম্পোস্ট্যান্ডের কাছে ৮ নম্বর রোডের ১৬৭ নম্বরের পাঁচতলা ভবনের পঞ্চম তলায় খুন হন নীলাদ্রি। নিলয়ের স্ত্রী আশা মনি সেদিন খুনীদের খুব কাছ থেকে দেখেছেন। ঘাতকদের ভয়াবহ সেই হামলা এখনো তাড়া করে বেড়ায় তাকে।

ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেই নিষ্ঠুর হামলার কথা বলেছেন নীলয়ের স্ত্রী। স্বামীর খুনীদের বিচারের জন্য বাঁচতে চান তিনি। রাজধানীর কলাবাগানে জঙ্গিগোষ্ঠী আনসার-আল-ইসলামের হামলায় নিজ বাসায় সোমবার সন্ধ্যায় দুজন নিহত হওয়ার পর আবারো নীল হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি জানিয়েছেন আশা মনি।

আশা মনি বলেন, তিনি প্রতিনিয়ত ভয়ের মধ্যে জীবন-যাপন করছেন। চোখের সামনে স্বামীকে কুপিয়ে হত্যার সাক্ষী তিনি। নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের জন্য এক প্রকার আত্মগোপনে রয়েছেন। গার্ডিয়ানকে আশা মনি বলেন, ‘আমি স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারি না। একা বাইরে বের হতে ভয় পাই। প্রত্যেকটি নতুন হত্যা শুধুমাত্র ভয় বাড়িয়ে তুলছে’।

গত আগস্টে আনসার-আল-ইসলামের হামলায় নিহত হন নীলয় নীল। সর্বশেষ সোমবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে কয়েকজন দুর্বৃত্ত উত্তর ধানমন্ডির ৩৫ নম্বর বাসায় ঢুকে দুজনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। এদের মধ্যে একজন বাংলাদেশের সমকামীদের প্রথম পত্রিকা রূপবানের সম্পাদক জুলহাস মান্নান। নিহত জুলহাস মান্নান ঢাকায় মার্কিন দাতা সংস্থা ইউএস এইডে কর্মরত ছিলেন। হামলায় মান্নানের বন্ধু তনয় নামের আরো একজন নিহত হয়েছেন।

ব্লগার নীলয় নীল গত বছরের মে মাসে ই-মেইল বার্তায় গার্ডিয়ানকে বলেন, তিনি খুন হওয়ার ভয়ে ছিলেন এবং পুলিশ তার ভীতিকে গুরুত্বের সাথে নেয়নি। ৭ আগস্ট দুপুরের দিকে বাসা ভাড়া নেওয়ার কথা বলে এক তরুণ তার বাসায় প্রবেশ করেন। বাসা খালি থাকায় ওই তরুণকে বাসায় ঢুকতে দেন মনি।

পরে বেডরুম থেকে বেরিয়ে এসে ওই তরুণের সঙ্গে কথা বলার সময় অপর তিন তরুণ রামদা নিয়ে নীলের ওপর হামলা চালায়। এর কয়েক ঘণ্টা পর আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা আনসার-আল-ইসলাম হত্যার দায় স্বীকার করে। হামলায় জড়িত সন্দেহে আনসার-আল-ইসলামের দুই সদস্যকে আটক করা হয়। এছাড়া এ ঘটনার তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে উল্লেখ করে চলতি সপ্তাহে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ওই ঘটনায় এখন পর্যন্ত পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে।

খুনীরা সে সময় মনিকে ফ্লাটের বারান্দায় আটকে রাখে তার স্বামীকে খুন করে। মনি বলেন, ‘আমরা সাধারণত আমাদের ঘরবাড়ি নিরাপদ মনে করি, কিন্তু আমরা কি আসলেই নিরাপদ? পুলিশি নিরাপত্তা কোনো সমাধান নয়।’

গত শনিবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। চলতি মাসের শুরুতে ঢাকার রাস্তায় হাঁটার সময় নাজিমুদ্দিন সামাদ নামে ২৮ বছর বয়সী আইনের শিক্ষার্থীকে তিন হামলাকারী মোটর সাইকেলে করে এসে কুপিয়ে হত্যা করে। গত বছর চার ব্লগার এবং সেক্যুলার একজন প্রকাশক খুন হন। সর্বশেষ সোমবার কলাবাগানে দুজনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

নিহত ব্লগার নীলয়ের স্ত্রী বলেন, ‘আমরা আশা হারাচ্ছি। পুলিশের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই, এমনকি মামলার বিষয়ে কোনো আপডেটও নেই। প্রগতিশীল মানসিকতা রামদা এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে দমন করা হচ্ছে। অপরাধীদের প্রকাশ্যে না আনতে পারলে এ ঘটনা ঘটতেই থাকবে।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজধানীর শাহবাগ চত্বরে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে একদল প্রগতিশীল তরুণের আন্দোলন শুরুর পর থেকে গুপ্তহত্যার সূত্রপাত হয়েছে। সে সময় ওই তরুণরা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় খুন ও ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামির নেতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দাবি জানায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, ‘তারা (চরমপন্থীরা) সমাজে ভীতি তৈরির চেষ্টা করছে’।

ব্লগার নীলয়ের স্ত্রী এখনো ঘুমাতে পারেন না। এজন্য তাকে ঘুমের ওষুধ খেতে হয় কিন্তু তার আশা কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় নীলের খুনীদেরকে বিচারের মুখোমুখি করতে পারবেন তিনি। আশা মনি বলেন, ‘আমি তাকে রক্ষা করতে পারিনি, এজন্য সব সময় নিজেকে অপরাধী মনে হয়। তবে এখন আমি মনে করি, ন্যায় বিচারের জন্য আমাকে বাঁচতেই হবে’।



মন্তব্য চালু নেই