আমরা তো আর ছোট নেই

ছোটরা বড় হয়ে যাচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি৷ ভারতীয় সংস্কৃতি আর আধুনিকতার মাঝখানে পড়ে বাবা-মায়েরা স্যান্ডউইচ৷ সন্তান যখন বয়ঃসন্ধির দোড়গোড়ায়, আসুন তাদের একটু সিরিয়াসলি নিই৷ যৌন সুরক্ষা, যৌন হেনস্হা এবং তাদের অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর দিই৷ বিষয়টা নিয়ে মনে মনে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে দু’টো বিস্ফোরক (অন্তত আমার কাছে৷ আশা করি অন্যদের কাছেও) উক্তি উঠে এল৷ একটা দিন দুয়েক আগের, অন্যটা মাস তিনেক আগের৷ দু’টো মন্তব্যেরই উত্সস্হল, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আদালত চত্বর, খোদ রাজধানী দিল্লির বিচারসভা৷ বিবাহপূর্ব সম্মত সহবাস ও বিশ্বাসভঙ্গের এক মামলায় রায় দিতে গিয়ে বিচারপতি বীরেন্দ্র ভাট বলছেন যে ভারতীয় সংস্কার ও সংস্কৃতি অনুযায়ী প্রাক্বিবাহ যৌনতা একাধারে অনৈতিক ও পাপাচার, কারণ তা ধর্মবহির্ভূত৷ অন্য উক্তিটি দিল্লির গণধর্ষণ মামলার শুনানি চলাকালীন চোখে পড়েছিল, আসামি পক্ষের উকিল এ পি সিংহের৷ উক্তিটি কূট, দুঁদে সওয়ালকারী উকিলের কালো শামলার ওপর থেকে উঁকি মারছে রক্ষণশীল ভারতীয় অভিভাবক-পিতার মুখোশ৷ ধর্ষক মক্কেলের অপরাধ লাঘব করতে তিনি দোষী করছেন ধর্ষিতা ছাত্রীটিকেই, যথারীতি৷ তাঁর অপরাধের গভীরতা ও তাত্পর্য বোঝাতে তিনি অনায়াসে বলছেন যে তাঁর নিজের মেয়ে যদি রাতের বেলায় ছেলে বন্ধুর সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়, বা বিয়ের আগে কোনওরকম যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, তবে তিনি তাকে নিজের হাতে পুড়িয়ে মারবেন৷
জানি না বিচারপতি ভাট বা অ্যাডভোকেট সিংহ কোন ভারতবর্ষের কথা বলছেন, কোন সংস্কৃতির! তবে এইটুকুই জানি যে খাপপঞ্চায়েত বা অনার কিলিং-এর বাইরেও একটা ভারতবর্ষ আছে, যেখানে আলো-হাওয়া খেলে, যেখানে কিছুটা হলেও হাত-পা ছড়িয়ে নিজের মতো করে বাঁচা যায়৷ আমরা আজ সেই ভারতবর্ষের কথা বলছি৷
যে সমস্যা, বা সমস্যা না বলে বলা ভাল যে ঘটনা নিয়ে আমরা কথা বলছি সেটা একান্তই এই একুশ শতকের মুক্ত আবহাওয়ায় নিজের মতো করে, নিজের শর্তে বাঁচতে চাওয়া কিশোর-কিশোরীদের কথা৷ যারা ছোট ছিল, কিন্ত্ত আর ছোট নেই৷ যে ১২-১৪-১৬ বছর বয়সিদের আমরা ছোট বলে, এলেবেলে বলে, ‘দুধভাত’ করে রাখতাম, তারা কিন্ত্ত আজকাল ওই বয়সেই ‘বড়’ হয়ে যাচেছ৷ আভাসে-ইঙ্গিতে, রাতজাগা ফিসফিসানিতে, খুব গোপনে, অতি সাবধানে, একটা একটা করে রহস্যের পরত খুলে, যে রোমাঞ্চময় বড় হয়ে ওঠা ছিল আমাদের, সেভাবে বোধহয় কোনও ছোটই বড় হয় না এখন৷ এদের বড় হওয়াটা খুব স্পষ্ট, আর খুব ক্যাজুয়াল৷ এরা স্কুল-কলেজ করে, ফেস্ট করে, গান-বাজনা করে, ফেসবুক করে, রাত জেগে পার্টি করে, যৌনতাও করে৷ এদের মেলামেশা, আদানপ্রদান–কী ভারচুয়াল, কী রিয়্যাল, কী মানসিক, কী শারীরিক–জড়তাহীন, অসংকোচ, অবাধ৷ এরা অসংকোচে জড়িয়ে ধরে, আদর করে, হাগ করে, চুমু খায়, আবার দ্বিধাহীন ভাবে রাগ-দুঃখ-আনন্দ-ঘৃণা-সবই শেয়ার করে বৈদ্যুতিন খোলা পাতায়৷ ফেসবুক-এ, ট্যুইটার-এ৷ কোনও রাখঢাক নেই, রহস্যও নেই৷ ‘ব্যক্তিগত’ কথাটার সংজ্ঞাই পাল্টে দিয়েছে আজকালকার ছোটরা৷ এরা কথা বলে কম, টেক্সট করে অগুণতি, নেট সার্ফ করে অবিরাম৷
বয়ঃসন্ধি এই ছোটদের জীবনে এসে পড়ে আগের ছোটদের চেয়ে তাড়াতাড়ি, ১২-১৩ বছরেই৷ শরীরী পরিবর্তনের হাত ধরে আসে প্রেম৷ আর আসে যৌন চেতনা৷ কিছুটা কৌতূহল, কিছু হরমোন, বাকিটা বন্ধুবান্ধব, ইণ্টারনেট৷ আর বিভিন্ন্ পত্রপত্রিকায় খোলাখুলি যৌনগন্ধী আলোচনা–সব মিলেমিশে ছোটরা এখন সক্রিয়ভাবে বড় হওয়ার আগেই যৌনভাবে সক্রিয় হয়ে যায়৷
অবশ্য ‘বড়’ হওয়ার চাইতে কুল হওয়াটা এই ছোটদের, বিশেষত শহুরে টিনএজারদের, কাছে অনেক-অনেক জরুরি৷ আর কে না জানে কুল হওয়ার প্রথম ধাপ হল যৌন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়া! তাই সেক্সটিং এখন স্কুলপড়ুয়াদের কাছেও জলভাত৷ এদের একটা বড় অংশ এক বা একাধিক সঙ্গীর সঙ্গে নিয়মিত যৌনসংসর্গে অভ্যস্ত৷ সমীক্ষায় পড়ছিলাম গ্রাম ও শহরতলির ছেলেমেয়েরাও পিছিয়ে নেই এই ক্ষেত্রে৷ (সেখানে অবশ্য একটু লুকিয়ে চুরিয়ে, সমাজের মাথারা বসে থাকেন তো ওত পেতে৷ তবু–)
ছোটদের এই অসময়ে বড় হওয়া অবশ্যই এক অনিবার্য পরিবর্তন বা বিবর্তন৷ তাদের চারপাশটাই যে আগের চেয়ে অনেক পাল্টে গিয়েছে৷ তারা এখন অনেক কিছু দেখছে, শুনছে, পড়ছে, জানছে (সবটা বুঝছে না অবশ্যই, বা নিজেদের মতো করে বুঝে নিচ্ছে)৷শরীর এখন আর আবছা আলো-আন্ধারির রহস্য নয়, শরীরী খেলা এখন ডার্ক রুম খেলার মতোই সহজ৷ কৈশোরের এই বাঁধভাঙা (যৌবন) জলতরঙ্গ রোধার ক্ষমতা কারও নেই৷ মা-বাবা-শিক্ষক-শিক্ষিকা–কারও নয়৷ রোধ করাটা অবশ্য তাঁদের কাজ নয়, কাম্যও নয়৷ ভারতীয় মা-বাবাদের অবস্হাটা আবার আরও জটিল৷ একদিকে সনাতন সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের চাপ, অপরদিকে পশ্চিমী আধুনিকতার জববর প্রভাব৷ এর মাঝে দোদুল্যমান তাঁরা শ্যাম রাখেন, না কুল রাখেন? একদিকে যেমন ছেলেমেয়েদের ঘরের মধ্যে, বইয়ের পাতায় আটকে রাখাটা চূড়ান্ত আন কুল, অন্যদিকে তাদের একেবারে ছেড়েই বা দেন কী করে? মাঝামাঝি রাস্তা একটা আছে অবশ্য৷ পাল্টে যাওয়া সমাজ, তার পরিবর্তিত মূল্যবোধ, আদবকায়দাকে মেনে নিয়ে, মানিয়ে চলাটাই বুমিানের কাজ৷ আমরা যেটা সহজেই করতে পারি তা হল পরিণত-অপরিণতর মাঝখানে পড়ে যাওয়া এই শরীর মনগুলোকে তৈরি করে দিতে৷
স্কুলে যৌনশিক্ষার পাঠ্যক্রম চালু হয়েছে বেশ কিছুদিন হল৷ সেখানে শেখানো যায়, আলোচনা করা যায়, ভুল ধারণা ভাঙানো যায়৷ যৌন সুরক্ষা, অসুরক্ষিত যৌন সংসর্গের বিপদ, যৌন হেনস্হা থেকে আত্মরক্ষা নিয়ে কথা বলা যায়, দলগত ও ব্যক্তিগত ভাবে৷
বাড়িতে ছোটরা যখন তাদের নতুন ফুটে ওঠা শরীরের অস্বস্তি নিয়ে, ভ্রান্ত ধ্যানধারণা নিয়ে, অসংখ্য অস্বস্তিকর প্রশ্ন নিয়ে বিপন্ন্ মুখে ঘুরে বেড়ায়, চলুন তাদের একটু সিরিয়াসলি নিই৷ তাদের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলি, প্রশ্ন করি, তাদের প্রশ্ন করতে উত্সাহ দিই, ধৈর্য ধরে উত্তর দিই মনের মধ্যে বুড়বুড়ি কাটা জিজ্ঞাসাগুলোর৷ তাদের বলি অবাঞ্ছিত মাতৃত্বের কথা, যৌনরোগ সম্পর্কে সতর্ক করি, যৌন সুরক্ষার পরামর্শ দিই৷ যৌন অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ভয় না দেখিয়ে, যৌন সংসর্গের দায় সম্পর্কে অবহিত করি, দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করি৷ যাতে কিশোরী মাতৃত্ব নিয়ে তৈরি অসাধারণ ছবি ‘জুনো’-র ষোলো বছরের জুনো-র মতো আমাদের কিশোরী কন্যারা চিউইং গাম কেনার মতো ক্যাজুয়ালি প্রেগন্যান্সি কিট কিনতে না যায়, আবার তার মা-বাবার মতো আমাদেরও ভাবতে না হয় ‘where did we go wrong?’ চলুন আমরা কথা বলি, পরামর্শ দিই, তারপর বলি–’Go, have fun’৷


মন্তব্য চালু নেই