‘আমি আমার সন্তানকে হারিয়েছি’

ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে রোববার সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা পারভিন সুলতানা দিতি। তাকে হারিয়ে শোকে বিহ্বল শুধু তার পরিবার নয়, হতবাক মিডিয়া জগতসহ পুরো বাংলাদেশ।

দিতির দীর্ঘদিনের পরিচিত কাছের একজন বন্ধু ও সহকর্মী ছিলেন এককালের বিখ্যাত চিত্রনায়ক ও অভিনেতা আলমগীর। একান্ত সাক্ষাৎকারে দিতিকে নিয়ে আবেগঘন স্মৃতিচারণ করেন তিনি। সেই স্মৃতিতে দিতি কখনো ছিলেন আলমগীরের পরিবারের সদস্য, কখনো আবার অসাধারণ সহকর্মী।

চলুন জেনে নেই আলমগীরের ভাষায় তার স্মৃতিতে আঁকা দিতির ছবি।

প্রথম দেখা

দিতির শুরু ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে। ওখানেই তাকে আমি প্রথম দেখেছি। চলচ্চিত্রের জন্য নতুন নায়ক-নায়িকা সন্ধানের প্রতিযোগিতা ‘নতুন মুখের সন্ধানে’-তে আমি মাঝে মাঝে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ পেতাম ওদের অভিনয় দেখার জন্য এবং অভিনয়ের ওপর মন্তব্য করার জন্য। সেখানেই দিতি আর সোহেল চৌধুরীকে দেখেছিলাম। ওরা দু’জনেই জিতেছিলো।

দিতির মধ্যে খুব সুন্দর একটা মিষ্টি ভাব ছিলো। আর সোহেলের মধ্যে ছিলো একটা নায়কসুলভ ভাব। তবে সেই ভাবটা ছিলো বেশ দাম্ভিক। অবশ্য ওটারও দরকার হয় অভিনয়ে।

পরিবারের অংশ

কেনো জানি না, সোহেল চৌধুরী একদিন হঠাৎ করে এসে আমাকে বললো, ‘ড্যাড, আপনি আমাকে একটু সাহায্য করবেন ফিল্মে টিকে থাকার জন্য।’ আমার খুব ভালো লেগেছিলো ওর কথাটা। আমিও রাজ্জাক সাহেবকে এভাবেই অনুরোধ করেছিলাম। তবে ‘ড্যাড’ হিসেবে নয়। আমি তাকে রাজ্জাক ভাই বলে ডাকতাম।

আমি তখন বনানীতে থাকি। সোহেলেরও বাড়ি বনানীতে, আমার বাড়ি থেকে হাঁটা দূরত্বে। ও প্রায়ই আমার বাসায় আসতো, আড্ডা দিতো।

এরপর দিতি আর সোহেলের বিয়ে হলো। বিয়ের পর দিতিও আমাকে ‘ড্যাড’ বলেই ডাকা শুরু করলো। আমার বাড়িতে এমন কোনো অনুষ্ঠান হতো না যেখানে দিতি ও সোহেল চৌধুরী আসতো না। তবে দাওয়াত পেয়ে নয়, ওরা আয়োজক হিসেবে আসতো। কোথায় প্লেট বসবে, কাকে কীভাবে আপ্যায়ন করতে হবে, সব কিছু পরিবারের সদস্যের মতোই তারা সামলাতো।

দিতি অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত এভাবেই চলছিলো। মোহাম্মদপুরে আমার আগের বাড়িতে যে অনুষ্ঠানটা হলো, তখনও দিতিই অতিথিদের দেখাশোনা করা, সবাইকে খাবার বেড়ে খাওয়ানো, সব কিছু করেছে।

দিতির সঙ্গে এই পারিবারিক সম্পর্কটা আমি সবসময় ধরে রেখেছি। পরিচয়ের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সে আমাকে ড্যাডই ডেকেছে। তাকেও আমি সন্তানের মতোই স্নেহ করতাম। তাই ওর মৃত্যুতে আমি সবাইকে একটি কথাই বলেছি – আমি আমার সন্তানকে হারিয়েছি।

দিতি মানুষকে খুব সহজেই আপন করে নিতে পারতো। আমাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করতো। ও ভালো গান গাইতো, আর অভিনয় তো ভালো করতোই। ওর মধ্যে ভালো করার একটা চেষ্টা ছিলো সবসময়। দেখতেও খুব মিষ্টি ছিলো।

আমার পরিবারের স্থায়ী সদস্য ছিলো দিতি। খেতে এলে সাথে পাতিলও নিয়ে আসতো। সঙ্গে করে বাসায় খাবার নিয়ে যেতো। এতোটাই কাছাকাছি সম্পর্ক ছিলো আমাদের।

পারিবারিকভাবে ওর ওপর দিয়ে অনেক ঝামেলা গেছে। বেচারি অনেক কষ্ট পেয়েছে জীবনে। সুখে-দুখে প্রত্যেকটা ব্যাপারে দিতি আমার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেছে, কেঁদেছে, কী করা যায়, কীভাবে করা যায় – পরামর্শ চেয়েছে।

দিতি আমার পরিবারের অংশ ছিলো। তাই ওর চিকিৎসার সময় শত ব্যস্ততার মাঝেও আমি যতোটা সম্ভব ওর পাশে থাকার চেষ্টা করেছি।

প্রতিভাধর সহকর্মী

প্রয়াত খ্যাতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক আলমগীর কুমকুমের ‘অমরসঙ্গী’ চলচ্চিত্রে প্রথম দিতি আমার বিপরীতে অভিনয় করে। ছবিটি সুপারহিট হয়েছিলো। কিন্তু ছবির শ্যুটিংয়ের সময় অন্যান্য দৃশ্য খুব ভালোভাবে শ্যুট হয়ে গেলেও যখন দু’জনে একটি রোমান্টিক গানে অভিনয় করতে গেলাম, কিছুতেই অভিনয়টা পারছিলাম না। দু’জনের একজনের মধ্য থেকেও সেই অভিনয়টা আসছিলো না। কারণ আমাদের সম্পর্কটা তো অন্যরকম।

এরপর থেকেই আমি সিদ্ধান্ত নেই যে, দিতির সঙ্গে আমি আর কোনো রোমান্টিক ছবিতে অভিনয় করবো না। এবং আমি করিওনি। এরপরও আমরা স্বামী-স্ত্রী চরিত্রে বেশ কিছু চলচ্চিত্র করেছি। তবে সেগুলোতে আমরা ছিলাম নায়ক-নায়িকার ভাই-ভাবী বা এমন কিছু।

আমরা সুভাষ দত্তের ‘স্বামী-স্ত্রী’ সিনেমায় অভিনয় করেছি। সেটি তেমন কোনো রোমান্টিক ছবি ছিলো না। জাতীয় পুরস্কার পাওয়া ওই চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়েই দিতি চলচ্চিত্র জগতে তার ভীত মজবুত করে ফেলে।

শেষের কিছু স্মৃতি

দিতির রোগ ধরা পড়ার আগেই একদিন দুপুরে বাসায় কাজ করার সময় দেখি ও একসাথে অনেকগুলো ওষুধ খাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এতো ট্যাবলেট খাচ্ছো কেনো? ও জানালো, সকালে ৪টা ট্যাবলেট খায়, দুপুরে ৫টা আর রাতে ৭টা। আমি শুনে আঁতকে উঠলাম। বললাম, তুই তো মরবি রে! এতো ওষুধ খেয়েই তো মরে যাবি। তখন দিতি বললো, ‘আমার আসলে টাইম শেষ।’

অসুস্থ হওয়ার ছয় মাসের সময় থেকে ও আমার চেয়ে রুনার বেশি কাছাকাছি চলে গেলো। আমি তখন খুব ব্যস্ত থাকতাম কাজ নিয়ে। সবসময় সময় দিতে পারতাম না। ও রুনাকে ফোন করেই অনেকক্ষণ ধরে কথা বলতো পরামর্শ চাইতো, বলতো, ‘মা, এই সমস্যা, এমনটা হচ্ছে, কী করবো?’

তবে শীতের দিন আসলেই ওর ব্যস্ততা শুরু হয়ে যেতো। বলতো, ‘ড্যাড, সোয়েটার পাঠান তাড়াতাড়ি!’ আমার সোয়েটারের ফ্যাক্টরি আছে। নিজের আর পরিবারের সবার জন্য ওই সোয়েটারই ছিলো ওর উপহার। ওই পেয়েই মহাখুশি। শুধু আমার পাঠানো সোয়েটারই পরতো দিতি।

এই সময় দিতির মৃত্যুটা আকস্মিক ছিলো। শেষের দিকে মাঝে মাঝেই ফোনে কথা হতো। সামনাসামনি সবসময় ড্যাড ডাকলেও ফোনে মাঝে মাঝে আলমগীর ভাই বলেও ডাকতো দিতি। একদিন ওর সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছে, কী অবস্থা, এসব। ও বললো, ভালো আছে, বেশ সুস্থ। অনেকটা বেটার ফিল করছে তখন আগের চেয়ে। ওকে জানালাম আমার নতুন বাড়িতে ওঠার কথা। ওই অবস্থাতেই দিতি বলে উঠলো, ‘আল্লাহর কসম আলমগীর ভাই, আপনি যদি নতুন বাড়ির হাউজ ওয়ার্মিং পার্টি করেন আমাকে রেখে! আমি পার্টিতে কাচ্চি বিরিয়ানি খাবো। আপনি আমাকে রেখে পার্টি করবেন না।’

আহারে… এখন তো হাউজ ওয়ার্মিং করতে গেলে আমার কষ্ট হবে, বার বার ওর কথা মনে পড়বে। কিন্তু অনুষ্ঠান করতে তো হবেই। পৃথিবী তো কারো জন্য বসে থাকে না।

এখন আল্লাহ তাকে শান্তিতে রাখুন, এই প্রার্থনাই করবো।চ্যানেলআই



মন্তব্য চালু নেই