“আম্মু মেনে নিতে পারে না, বাবাকে সবসময় সন্দেহ করে…”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানিয়েছেন নিজের সমস্যার কথা।

“আমি আম্মুর হয়ে কথাগুলো বলছি। আমার আম্মু ছোটবেলা থেকেই তার নানী বাড়িতে থাকেছে। আমার নানার ২জন স্ত্রী ছিলো। আমার নানি আমার নানার কাছে খুব অবহেলিত থাকায় আমার আম্মু আর আমার মামাদের আমার নানী তার মায়ের বাসায় রেখে আসে। আমার মা ছোট বেলা থেকে তার খালা, মামি এদের খেয়ে পরে মানুষ হয়েছে। আমার আম্মুর নানা মারা যাওয়ার পর সে প্রেম করে আমার বাবার সাথে পালিয়ে বিয়ে করে।

বিয়ে কেউ মেনে নেয়না। আমার দাদী বাড়ি থেকেও না। আমার বাবাও বেকার ছিলো। আমি হওয়ার কিছুদিন পর আমার দাদা তাদের বাড়িতে তোলে। কিন্তু আমার মা তার বাবার বাড়ি থেকে কিছু না আনায় আর আমার বাবা বেকার থাকায় আমার দাদী তার উপর খুব অত্যাচার করে, কিন্তু আম্মু সব মেনে নেয়। আমার নানা বাড়ির সাথে আম্মুর কোন সম্পর্ক নাই। আমার আম্মু তার মামাতো, খালাতো ভাই বোনদের খুব ভালোবাসতো। এতোটা যে তার নিজের ভাইবোনদের থেকেও বেশি। কিন্তু তাদের বিয়ে হওয়ার পর আম্মুর সাথে তারা খুব অন্য রকম আচরণ করে এবং আম্মু খুব কষ্ট পায়।

আমরা ৩ ভাইবোন। আম্মুর বিয়ের ২২ বছর চলে। আমার দাদা বাড়ি থেকে আম্মুকে খুব অত্যাচার করে। আর আমার বাবা কিছু করে না বললেই চলে। আমি এর মধ্যে ৩ বছর আগে পালিয়ে বিয়ে করে ফেলি। সেখান থেকেও আম্মু খুব কষ্ট পায়। এখন আমার বাবা নতুন দোকান দিয়েছে আর আম্মুকে কম সময় দিচ্ছে। আম্মু এটা মেনে নিতে পারেনা। বাবাকে সব সময় সন্দেহ করে। আর আমার বাবাও নতুন ফেসবুক খুলেছে আর খুব আসক্ত হয়ে পড়েছে। সে বাড়িতে গিয়েও ফেসবুক চালায় ঘন্টার পর ঘন্টা। আম্মুকে কোন সময় দেয়না। আমার আম্মু এখন আমার ভাই বোন সবার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করে। বাবাকে সন্দেহ করে। বাবার সাথে ঝগড়া করে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয়। খুব অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন।

আমরা আম্মুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। উনি বলেছে আমার বাবা সহ যেতে কিন্তু আমার বাবা যাবেনা। আমার বাবার মাঝেও কিছু সমস্যা আছে। সে আগে আমার আম্মু ছাড়া কিছু বুঝতো না। এখন সে আম্মুকে খুব কম সময় দেয়। সব মিলিয়ে আম্মু খুব খারাপ অবস্থায় আছে।

আমি বুঝতে পারছি না কী করবো? প্লিজ কোন সমাধান দিন। আমার বাবা খুব দায়িত্বজ্ঞানহীন। আম্মুর কিছু হলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় না। টাকা দেয় আর বলে তোমরা নিয়ে যাও। আমার ভাইবোনের স্কুলের টাকা ঠিকঠাক দেয়না। কী করবো?

আমার বয়স ১৯, ছোট বোনের বয়স ১৩ এবং ছোট ভাইয়ের বয়স ৮ বছর।”

পরামর্শ:
আপু, আমি খুবই দুঃখিত তোমাদের পরিস্থিতিতে। এবং এই সাথে এই কারণেও যে এখন আমাকে কিছু কঠোর কথা বলতে হবে। আমি কাউকে কঠিন কিছু বলতে চাই না। কিন্তু মাঝে মাঝে এই কঠিন কথাগুলো আমাদের জন্য খুবই জরুরী হয়ে ওঠে।

প্রথমত বলি, তোমার চিঠিতে যদিও আম্মুর দিকে সহানুভূতির পাল্লা অনেক ভারী, কিন্তু তারপরও আজকের এই অবস্থার জন্য আম্মুর যে কোন দায় নেই এটা বলা যায় না। তবে চিঠি পড়ে আমার মনে হচ্ছে আম্মু মানসিক কিছু সমস্যায় ভুগছেন। ছোটবেলা থেকেই নানান হতাশা ও সমস্যার মাঝে বড় বড় হতে হতে ওতে তাঁর মনের মাঝে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। এবং সেগুলোর মাঝে একটি হচ্ছে নিজের সমস্যার জন্য অন্যকে দোষারোপ করা। এক হাতে কখনোই তালি বাজে না। কিন্তু আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজের দোষটি দেখতে পাই না।

তোমার আম্মু কিন্তু নিজের জন্য বর নির্বাচনে বিশাল ভুল করেছেন। একটি বেকার ছেলেকে পালিয়ে বিয়ে করার পর নানী বাড়ি যে আম্মুর সাথে কোন সম্পর্ক রাখবে না, সেটাই কি স্বাভাবিক না? এখানে নানী বাড়ির বা মামাতো-খালাতো ভাইবোনদের কোনই দোষ দেয়া যায় না। তাঁরা আগেই বুঝেছেন যে তোমার বাবা পাত্র হিসাবে সুবিধার না। একইভাবে তোমার দাদীকেও দোষ দেয়া যায় না। বেকার ছেলে বিয়ে করে আনলে কোন মা-ই খুশি হয় না। এবং তোমার বাবা যেহেতু আজীবন অকর্মাই রয়ে গিয়েছে, সেটার জন্য দাদী তোমার মাকেই দায়ী মনে করেন নিঃসন্দেহে। এবং আমার মনে হচ্ছে, বিষয়টি খুব একটা ভুল না। কারণ তুমি নিজেই লিখেছ যে বাবা নতুন দোকান দিয়েছে বলে মাকে সময় দেয় না আর এটা মা মেনে নিতে পারছে না। এমন হলে বাবা কীভাবে কাজ করবে বল? এমন হলে দুনিয়ার কেউই তো ক্যারিয়ার নিয়ে মাথা ঘামাতে পারবে না। আবার নিজের ব্যক্তিগত হতাশা তিনি সন্তানদের ওপরে ঝারছেন, যেটা খুবই খারাপ। এসব কারণেই মনে হচ্ছে তোমার আম্মুর কিছু মানসিক অসুবিধা হচ্ছে। সম্ভব হলে আম্মুকে একজন কাউন্সিলারের কাছে নিয়ে যাও। পেশাদার সাহায্য নিলে তাঁর মানসিক অবস্থার উন্নতি হতে পারে। তোমার আম্মুর পেশাদার সাহায্য চাই।

অন্যদিকে এখন একটি কঠিন বাস্তবতার কথা বলবো। দেখো আপু, বিয়ের ১৯/২০ বছর পরও যে দম্পতির মাঝে তারুণ্যের মত ভালোবাসা থাকবে, এটা আশা করা একেবারেই ভুল। সময়ের সাথে সাথে ভালোবাসার ধরণ বদলে যায়, মানুষ ক্রমাগত বৈচিত্র্য খুঁজতে থাকে। আর এই বৈচিত্র্য খুঁজতে খুঁজতে মন অন্যদিকে চলে তখনই যায়, যখন নিজের ঘরে শান্তি মেলে না। ভালোবাসা পানির মতন, বেশি ধরে রাখতে চাইলে হাতের মুঠোতে কিছুই থাকে না। আম্মু একটু বেশিই জোর করছেন সম্পর্কের সকল দিক দিয়ে। না বুঝেই করছেন। এই কারণে তাঁর দাম্পত্যে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সন্তান হিসাবে মা বাবার ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে আসলে তোমার বলার কিছু নেই। সেটা তোমার কথা বলার জায়গা না।

অন্যদিকে তুমিও হুট করে একটা বিয়ে করে বেশ বর একটা সমস্যা তৈরি করে ফেলেছ। তোমার মাঝেও মায়ের মত ভুল সিদ্ধান্ত নেবার প্রবণতা ও অস্থিরতা দেখতে পাচ্ছি। তুমি যা করবে আপু, প্রথমেই নিজেকে শান্ত করবে। নিজে ঠিক না থাকলে কিছুই ঠিক করতে পারবে না। নিজেকে আগে গুছিয়ে নাও, নিজের লেখাপড়া ও ক্যারিয়ারের ফোকাস ঠিক করো। লেখাপড়া সামাল দিয়ে তারপর ঘরের দিকে মন দাও। নিজের ভাইবোনগুলোকে দেখে রাখবে, তাঁদের আদর করবে। কারণ মা বাবা কেউইই তো আদর দিচ্ছে না। বড় বোন হিসাবে তোমার কর্তব্য মায়ের মত আদর করা। বাড়িতে সব সময় সুন্দর একটা পরিবেশ তৈরি করে রাখতে চেষ্টা করবে, এতে তোমাদের সবার মন ভালো থাকবে আর বাবাও বাড়ির দিকে আকৃষ্ট হবে। যেমন কিছু একটা রান্না করে সবাই একসাথে বসে খাওয়া, একসাথে টি ভি দেখা বা গল্প করা। একদিনে এসব হবে না। আস্তে আস্তে করতে হবে। সাথে মাকে ক্রমাগত বোঝাবে যে বাবার সাথে যেন খারাপ ব্যবহার না করে, তাতে বাবা আরও ফেসবক আসক্ত হয়ে পড়বে। মাকে বোঝাবে নিজের দিকে মন দিতে, সংসারে মন দিতে, ভালোবাসা দিয়ে বাবার মন জয় করতে। আর তোমরাও চেষ্টা করবে মা বাবাকে একটু নিরবিলি সময় কাটানোর সুযোগ দিতে। অন্যদিকে মাকে বোঝাবে জোর না করে আস্তে আস্তে বাবার ঘাড়ে সংসারের দায়িত্ব ও ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব দিতে। এতে বাবা রাতারাতি বদলে যাবেন না। কিন্তু একটু হলেও নিতে শিখবেন। ভালোবাসা আর ধৈর্য দিয়ে অনেক কিছুই সম্ভব।

আশা করি আস্তে আস্তে তোমাদের বাড়ির পরিস্থিতির উন্নতি হবে। শুভকামনা।প্রিয়.কম



মন্তব্য চালু নেই