‘আল্লাহ’ শব্দ কীভাবে এলো জানেন কি? না জানলে জেনে নিন!

মানব সৃষ্টির সূচনা থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত খুব অল্প সংখ্যক মানুষই আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করেছে। ফেরাউন, নমরুদ এবং এতেদর মতো আরো যারা ছিল, তারা কেউ আল্লাহর অস্তিত্বে অবিশ্বাসী ছিলনা। তারা কখনো এ কথা বলেনি যে, এই গোটা বিশ্ব আমি সৃষ্টি করেছি। বরং তারা বলেছে, কোরআনের ভাষায় ‘আমিই তোমাদের শ্রেষ্ঠ রব’। আমার চেয়ে শক্তিশালী আর কেউ নেই।

অর্থৎ তারা দাবী করেছে,‘ এই বিশাল ভূখন্ডের শাসক হিসাবে দেশের জনগণের ওপরে আইন ও বিধান চলবে আমার। এখানে অন্য কারো আইন কানুন চলবে না। জনগণ অন্য কারো আইন অনুসরণ করতে পারে না। আইন চলবে একমাত্র আমার এবং আমাকেই ইলাহ হিসাবে পূজা অর্চনা করতে হবে।

মাথানত করতে হবে একমাত্র আমার কাছে। ’ এভাবে দেশের জনগোষ্ঠী আল্লাহকেও বিশ্বাস করেছে, সেই সাথে তারা আল্লাহর অংশীদার বানিয়েছে। পবিত্র কোরআনে দেখা যায় আরবের যারা মূর্তিপূজক ছিল তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করতো। মুখে তারা আল্লাহর নাম বেশ শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারণ করতো। কিন্তু তাদের বিশ্বাস ছিল, আল্লাহর কাছে পৌঁছানোর মাধ্যম হলো এসব মূর্তি।

পক্ষান্তরে ইসলাম মানুষকে শিখালো, আল্লাহ এমন এক অদ্বিতীয় সত্তার নাম,ডিনি গোটা বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন। দৃশ্যমান এবং অদৃশ্যমান যা কিছু আছে, সমস্ত কিছুই তাঁরই সৃষ্টি। সমস্ত সৃষ্টির সব ধরনের প্রয়োজন যিনি পূরণ করেন তিনিই হলেন মহান আল্লাহ। আল্লাহ শব্দের বিকল্প কোন শব্দ নেই।

তিনিই মানব জাতির সব ধরনের বিধান দাতা। প্রাচীন সিমেটিক ভাষাগোষ্ঠীর প্রত্যেকটি শাখাতেই সামান্য রূপান্তর ভেদে আল্লাহ কথাটি এক,অদ্বিতীয়, অনাদী, অনন্ত উপাস্য সত্তার জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ভাষাবিদগণ অনুমান করেন যে,মানব সভ্যতার সূচনাকাল থেকেই তাওহীদবাদী জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিশ্ব প্রতিপালকের একক সত্তা বোঝানোর জন্য আল্লাহ শব্দটির প্রচলন রয়েছে।

যেমন প্রাচীন কালদানীয় ও সুরইয়ানী ভাষায় আল্লাহ শব্দটি আলাহিয়া,‘প্রাচীন হিব্রু“ভাষায় উলুহ এবং আরবী ভাষায় ইলাহ রূপে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিবর্তিত আরবী ভাষায় ইলাহ শব্দের সাথে আরবী আল অব্যয় যুক্ত হয়ে আল ইলাহ বা আল্লাহ শব্দে রূপান্তরিত হয়েছে।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের পূর্বেও আরবদের মধ্যে আল্লাহ শব্দটিই মহান পরওয়ারদেগারের একক শব্দরূপে হতো। আল্লাহ শব্দটির কোন লিঙ্গান্তর হয়না। এর কোন দ্বিবচন বা বহুবচনও হয় না। এ প্রাচীন শব্দটিই পরম উপাস্যেও সত্তা বোঝানোর জন্য পবিত্র কোরআনে বারবার ব্যবহৃত হয়েছে।

ইসলামী শরীয়াতে আল্লাহ নামের কোন বিকল্প নেই। মহান আল্লাকে তাঁর যে কোন গুণবাচক নামেও ডাকা যায়। তবে আল্লাহ ও আল্লাহর গুণবাচক নামের বিকল্প যেমন, গড,ঈশ্বও,পরমেশ্বর,ভগবান ইত্যাদি কোননামে ডাকা স্পষ্ট হারাম। কারণ এসব শব্দের মধ্য দিয়ে তওহীদ বিশ্বাসের অনুরূপভাব প্রকাশ পায় না।

কারণ ঐসমস্ত শব্দের লিঙ্গান্তর করা যায় এবং স্ব স্ব ভাষায় ব্যকরণ শুদ্ধভাবে করা যায়। ইংরেজী গড শব্দের ইংরেজী বানান (GOD).এখানে ইংরেজী বর্ণমালার তিনটি অক্ষর রয়েছে। এই শব্দটি যদি উল্টিয়ে উচ্চারণ করা হয় তাহলে তা একটি চতুষ্পদ জন্তুর নাম প্রকাশ করবে।

আল্লাহ কে এবং তাঁর পরিচয় স্বয়ং তিনিই এভাবে দিয়েছেন-

“হে নবী ! আপনি বলে দিন, আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয় ,তিনি অভাব শুন্য। তাকে কেউ জন্ম দেয়নি তিনিও কাউকে জন্ম দেননি। (সূরা ইখলাস)

আর ভগবানের সংজ্ঞা শ্রী মদ্ভাগবত গীতা দিয়েছেএভাবে ,অর্জুনের এক প্রশ্নের উত্তরে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন

যদা যদা হি ধর্ম্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভুত্থনমধর্ম্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম।।
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম। ধর্ম্মসঙস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।
(গীতা, চতুর্থোহধ্যায়ঃ জ্ঞানযোগ ৭-৮)

অনুবাদঃ হে অর্জ্জুন ! যে যে সময়ে ধর্ম্মের পতন আর পাপের প্রাদুর্ভাব হয়,সেই সেই সময়ে আমি জন্ম লইয়া থাকি। এইভাবে পাপীদের বিনাশ করিতে (শাস্তি দিতে)আর সৎ লোকদের বাঁচাইতে এবং ধর্ম্মকে আবার প্রতিষ্ঠিত করিতে যুগে যুগে আমি জন্মগ্রহণ করি।

হিন্দু সম্প্রদায় শ্রী কৃষ্ণকে স্বয়ং ভগবান নামে অভিহিত করেন। সুতরাং ভগবান প্রয়োজনে বা বাধ্য হয়ে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন।

এই ভগবান পৃথিবীতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নরূপে পিতার ঔরসে মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছেন। ভগবান একবার চার অংশে রাজা দসরথের ঔরসে জন্মগ্রহণ করে রাম,লক্ষণ, ভরত ও শত্রুঘ্ন- এই চার নাম ধারণ করেছিল। ভগবান তার ভক্ত প্রহল্লাদের সামনে পশুরাজ সিংহের আকৃতি ধারণ করে নিজেকে প্রকাশ করেছিল। তাহলে দেখা গেল ভগবান এই পৃথিবীতে মাতৃগর্ভে পিতার ঔরসে প্রয়োজনে জন্মগ্রহণ করে।

যে কোন পশুর রূপও ধারণ করতে পারে। সুতরাং ,স্রষ্টাকে নামের পরিচয়ে আবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে মানুষ এমন সব শব্দ আবিষ্কার করেছে যে, এসব শব্দের যে কি অর্থ এবং শব্দকে খন্ডিত করলে যে কি অর্থ প্রকাশ করে, সেদিকে লক্ষ্য না রেখেই মানুষ তার সীমিত জ্ঞান প্রয়োগ করে কল্পিত স্রষ্টার একটি নাম রেখেছে। কেবলমাত্র ব্যতিক্রম হলো ইসলাম। ইসলাম আল্লাহ নামের যে পরিচয় দিয়েছে,তার কোন বিকল্প নেই ।

আরবের ছাফা পর্বতের অনেক শিলালিপিতে আরবী আল্লাহ শব্দটি সেই যুগ থেকেই লিখা ছিল এবং এখনো আছে। উত্তর আরবের জনগোষ্ঠী এবং নাবাতী জনগোষ্ঠী নামের একটি অংশ আল্লাহ নাম ব্যবহার করতো।

নাবাতীদের কাছে আল্লাহ নামটা পৃথক কোন উপাস্য হিসাবে বিবেচিত না হলেও তাদের শিলালিপিতে দেবতাদের নামের সাথে আল্লাহ নাম সংযুক্ত দেখা যায়। পকাষান্তরে সেল, মাবগলিউথসহ অনেক ইসলাম বৈরী পাশ্চাত্য গবেষক ‘আল্লাহ’ শব্দটি জাহিলিয়াত যুগের ‘আল লাত’ নামক দেবমূর্তিও নামের রূপান্তর বলে যে কষ্ট কল্পনা করেছে,আরবী শব্দ গঠন পদ্ধতির বিচারে এটা নিতান্তই হাস্যষ্পদ অপচেষ্টা মাত্র।

আল্লাহ শব্দের অনুবাদ কেউ যদি স্রষ্টা লিখে তাহলে তা হবে এক মারাত্মক ভুল। কারণ স্রষ্টা হিসাবে তো মহান আল্লাহর খালিক নামক একটি গুণবাচক নাম রয়েছে ।

শুধু একটি নয়, আল্লাহর অনেকগুলো সর্বোত্তম গুণবাচক নাম রয়েছে। মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন -“আল্লাহ সুন্দর সুন্দর নামের অধিকারী, তাঁকে সুন্দর সুন্দর নামেই ডাকো”। সেই লোকদের কথার কোন মূল্য দিও না যারা তাঁর নামকরণে বিপথগামী হয়। তারা যা কিছুই করতে থাকে ,তার বিনিময় তারা অবশ্যই লাভ করবে। (সূরা আল আ’রাফ১৮০)

আল্লাহর গুণবাচক নাম রহমান, এ নামেও তাঁকে ডাকা যায়। মহান আল্লাহ বলেন-() হে নবী! এদেরকে বলে দাও ,আল্লাহ অথবা রহমান যে নামেই ডাকো না কেন তাঁর জন্য সব ভালো নামই নির্দিষ্ট। (সূরা বনী ইসলাঈল ১১০)

মহান আল্লাহ অসংখ্য গুণাবলীর অধিকারী এবং গুণ ও বৈশিষ্ট্যেও কারণে তাঁর গুণবাচক নাম প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর গুণবাচক নাম সম্পর্কে স্বয়ং তিনিই সূরা ত্বা-হায় বলেছেন-() তিনি আল্লাহ, ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই, তাঁর জন্য রয়েছে সর্বোত্তম নামসমূহ ।(সূরা ত্ব-হা)

আল্লাহর এসব গুণবাচক নামও অতীব সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী। এসব নামেরও তসবীহ করতে হবে। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-() ( হে নবী!) তোমার মহান শ্রেষ্ঠ রব এর নামের তাসবীহ করো। (সূরা আ’লা -১)

আল্লাহ শব্দের অর্থ কোনক্রমেই স্রষ্টা হিসাবে অনুবাদ করা যেতে পারে নাএবং এ নামের কোন অনুবাদও হতে পারে না। আল্লাহ নামের কোন বিকল্প হতে নেই। স্রষ্টা হিসাবে আল্লাহ তা’য়ালার একটি নাম রয়েছে। কোরআন বলছে-() তিনিই আল্লাহ ,যিনি সৃষ্টি পরিকল্পনা রচনাকারী ও তার বাস্তবায়নকারী এবং তা অনুসারে আকার আকৃতি প্রদানকারী তাঁরই জন্য অতীব উত্তম নামসমূহ। (সূরা হাশর ২৪)

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল্লাহ নাম দিয়েই তিনি তাঁর পরিচয় এভাবে তুলে ধরেছেন-() আল্লাহ সেই চিরঞ্জীব শাশ্বত সত্তা যিনি সমগ্র বিশ্বচরাচরকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে আছেন ,তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। তিনি সদাজাগ্রত এবং তন্দ্রা তাকে স্পর্শ করতে সক্ষম নয়। আকাশমন্ডলে ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবকিছুর সার্বভৌমত্ব তাঁর। (সূরা বাকারা ২৫৫)

আল্লাহ হলেন তিনি, যিনি একমাত্র দাসত্ব লাভের অধিকারী এবং অসীম দয়ালু তাঁর কাছে গোপন ও প্রকাশ্য বলে কোন কিছু নেই। কোরআন ঘোষণা করছে -() তিনিই আল্লাহ যিনি ব্যতীত কোন মাবুদ নেই। তিনি গোপন ও প্রকাশ্য সবকিছুরই জ্ঞাতা, তিনিই রহমান ও রাহীম (সূরা হাশর ২২)

আল্লাহ মহাপবিত্র এবং তিনি সমস্ত কিছুর মালিক সমস্ত কিছুরই বাদশাহ রাজাধিরাজ। কোরআন তাঁর পরিচয় এভাবে পেশ করছে-() তিনিই আল্লাহ যিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। তিনি মালিক বাদশাহ। অতীব মহান ও পবিত্র। সম্পূর্ণ শান্তি ,নিরাপত্তা দানকারী, সংরক্ষণকারী, সর্বজয়ী নিজের নির্দেশাবলী শক্তি প্রয়োগে কার্যকরী এবং স্বয়ং বড়ত্ব গ্রহণকারী । (সূরা হাশর ২৩)

সমস্ত কিছুর একচ্ছত্র অধিপতি হলেন আল্লাহ। তাঁর নাম বিকৃত করার সামান্যতম অবকাশ নেই। আল্লাহ নামের প্রতিটি অক্ষর দিয়েই তাঁর পরিচয় কোরআন উপস্থাপন করেছে। আল্লাহ নাম লিখতে প্রথমে আরবি অক্ষর আলিফ এর প্রয়োজন হয়। এই আলিফ অক্ষর বাদ দিলেও আল্লাহর নাম বিকৃত করা যাবে না। কোরআন বলছে-() আকাশ রাজ্য ও পৃথিবীতে যা কিছুই রয়েছে,তা সবই আল্লাহর ।তোমাদের মনের কথা প্রকাশ করো অথবা নাই করো আল্লাহ অবশ্যই তোমাদের কাছ থেকে সে সম্পর্কে হিসাব গ্রহণ করবেন। (সূরা বাকারা ২৮৪)

পবিত্র কোরআন আল্লাহ শব্দের আলিফ ব্যতিতই এ ধরনের বহু আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালার পরিচয় প্রকাশ করেছে,তাঁর অসীম ক্ষমতার কথা তুলে ধরেছে। উল্লেখিত আয়াতে আল্লাহ শব্দ থেকে আলিফ উহ্য রাখার কারণেআল্লাহ শব্দের সামান্যতম বিকৃতি ঘটেনি। আল্লাহ শব্দ থেকে আলিফ উহ্য রাখলে শব্দ হলো লিল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর জন্য বা আল্লাহর । এই লিল্লাহ শব্দ থেকেও যদি একটি পবিত্র কোরআন মহান আল্লাহর পরিচয় তুলে ধরেছে এভাবে- () আকাশ ও যমীনের ভান্ডারসমূহের চাবি তাঁরই হাতে নিবদ্ধ, যাকে ইচ্ছা অঢেল রিযিক দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা মেপে দেন। তিনি সব কিছু জানেন। (সূরা আশ শূরা১২)

এভাবে আল্লাহ শব্দ থেকে আলিফ অক্ষরটি বাদ দেয়া হলো, তারপর দুটো লাম অক্ষরের প্রথমটি বাদ দেয়া হলো। এবারে দ্বিতীয় লাম অক্ষর টি বাদ দেয়ার পরে থাকে শুধুমাত্র হা অক্ষর টি ।এই হা অক্ষরের সাথে পেশ যুক্ত করে হু আকারে উচ্চারিত হয়ে মহান আল্লাহর পরিচয় তুলে ধরেছে। পবিত্র কোরআন এই হু শব্দ দিয়ে আল্লাহর পরিচয় এভাবে পেশ করছে-() তিনিই প্রথমবার সৃষ্টি করেন এবং তিনিই পুনরায় সৃষ্টি করবেন। আর তিনি ক্ষমাশীল, প্রেমময়,আরশ- অধিপতি, মহান শ্রেষ্ঠতর। নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী সব কাজ সম্পন্নকারী (সূরা বৃরুজ)

সুতরাং মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আল্লাহ নামের কোনভাবেই বিকৃতি ঘটানো সম্ভব নয়। আল্লাহ শব্দটি আরবী অক্ষরে লিখতে যে কয়টি অক্ষরের প্রয়োজন,এর যে কোনো একটি অক্ষর ও ছেড়ে দিলেও তা অবিকৃত থাকেএবং সঠিক অর্থ প্রকাশ করে। এ নামের সাথে কোন কিছুর তুলনা করা যায়না এবং এ নামের কোন ভাষান্তও করাও যায় না।



মন্তব্য চালু নেই