আ.লীগের নেতাকর্মীদের ওপর ক্ষুব্ধ প্রশাসনের কর্মকর্তারা

জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং সহকারী কমিশনাদের ওপর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলার ঘটনা্য় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে প্রশাসন। সর্বশেষ শুক্রবার সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা মারধর করে ফেনীর পরশুরামের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) হাসপাতালে পাঠালেন। তার অপরাধ, তিনি আওয়ামী লীগের উপজেলা পর‌্যায়ের এক নেতার সঙ্গে করমর্দন না করেই চলে যাচ্ছিলেন।

এর আগে গত মার্চ মাসেই কয়েক দফা হামলার ঘটনা ঘটে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ওপর।

ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের এসব হামলার ঘটনায় কোথাও কোথাও মামলা হয়েছে, কোথাও কোথাও দলীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও কিছুই হয়নি।

খোঁজ নিয়ে দেখা দেখা গেছে, এসব হামলার পেছনে মূলত নেতাকর্মীদের ব্যক্তিস্বার্থ জড়িত। যে পর‌্যায়ের নেতাই হোন, তাকে তার মর্জিমতো তোয়াজ কিংবা সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় মারপিট যেমন আছে, তেমনি হাটবাজারের দরপত্র, সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি গঠন ও অনুমোদন এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পছন্দমতো না চলায় লাঞ্ছিত বা হামলার শিকার হয়েছেন কর্মকর্তারা।

প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে কথা বলে জানা গেছে, এসব ঘটনায় প্রশাসনের ভেতরে ক্ষোভ জমা হচ্ছে। অথচ মাঠপর‌্যায়ে এসব কর্মকর্তা সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন।

মন্ত্রিপরিষদ-সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম জানান, মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা সব সময় তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে সরকারের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে থাকেন। তারা যদি এভাবে আক্রমণের শিকার হন, তাহলে সরকারের কর্মকাণ্ড সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।

সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের হাত থেকে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের রক্ষার উপায় কী্- এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা সব সময় জনগণের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তাদের সঙ্গে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের ভালো সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (জেলা ও মাঠ প্রশাসন অনুবিভাগ) মো. মাকছুদুর রহমান পাটওয়ারী জানান, “আমরা যে তথ্য পেয়েছি এতে দেখা গেছে, মারধরের ঘটনায় মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা সরকারি দলের নেতাকর্মীদের ওপর ক্ষুব্ধ। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মারধরের ঘটনায় আমরা আলাদাভাবে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করব। এভাবে লাঞ্ছিত হলে মাঠ পর‌্যায়ের কর্মকর্তারা সরকারি কাজ করতে পারবেন না। দলীয় নেতাকর্মীরা হয়রানি করে আসছে্ন বলে ডিসি ও ইউএনওদের কাছে থেকে অনেক লিখিত অভিযোগ আমাদের কাছে রয়েছে।”

ফেনীর জেলা প্রশাসক মো. আমিন উল আহসান বলেন, “মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা সরাসরি সরকারের আদেশ-নির্দেশ বাস্তবায়ন করে থাকেন। সেই কর্মকর্তাদের ওপর সরকার দলীয় নেতাকর্মীরা হাত তুলবে, তা কাম্য নয়।”

আমিন উল আহসান বলেন, “ইউএনওকে মারধর করার ঘটনায় আমরা দ্রুত বিচার আইনে মামলা করেছি। এর মধ্যে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, আজকের মধ্যে মূল আসামিকে গ্রেপ্তার করা হবে।”

ডিসি আরো বলেন, এর আগে এ জেলায় বিভিন্ন উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তারা নেতাকর্মীদের হাতে হয়রানির শিকার হয়েছেন। তবে এখন তা আগের চেয়ে কমেছে।

মন্ত্রিপরিষদ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান সরকারের আমলে দেশের বিভিন্ন জেলায় বেশ কজন জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং সহকারী কমিশনার (ভূমি) সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের হাতে মারধর, লাঞ্চনা ও হামলার শিকার হয়েছেন।

চলতি বছরের ৩১ মার্চ অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) ওপর হামলা চালান শেরপুরের শ্রীবরদী পৌরসভার মেয়র আবু সাইদ। পরে আবু সাইদকে মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত ও তার বিরুদ্ধে নির্বাচনী আইনে মামলা হয়।

গত ১০ মার্চ মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাঈদুজ্জামান খানকে অফিস চলাকালীন প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের তিন নেতা।

এর আগে ২৪ ফেব্রুয়ারি জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলায় হাটবাজারে দরপত্র নিয়ে ইউএনওকে তার কার্যালয়ে মারধর করেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

২০১৪ সালের ৫ অক্টোবর দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ ফরহাদ হোসেন নির্মমভাবে মারপিটের শিকার হন। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট নেতাদের বহিষ্কার করে স্থানীয় আওযামী লীগ। পরে ইউএনও সৈয়দ ফরহাদ হোসেন নিজে বাদী হয়ে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের ২৯ জন নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করে মামলা করেন।

২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগরের ইউএনও তবিবুর রহমানের ওপর হামলা চালান স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় মামলা করা হয।

এর আগের বছর ২০১২ সালের ১ ডিসেম্বর কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক (ডিসি) সৈয়দ বেলাল হোসেনকে নাজেহাল করেন একই জেলার মিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা কামারুল আরেফিন। ওই দিনই মন্ত্রিপরিষদ-সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও খুলনার বিভাগীয় কমিশনারকে চিঠি দিয়ে ঘটনা জানান নিগৃহীত ডিসি।

৩ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ উপজেলা চেয়ারম্যান কামারুল আরেফিনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবকে চিঠি দেয়।

কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান ২০১২ সালের ১৬ জুন সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের হামলা শিকার হন। এ ঘটনায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চূড়ান্ত অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। ঢাকাটাইমস



মন্তব্য চালু নেই