ইনিই সেই মফিজ, যার ভাড়া তিরিশ

‘আমার নাম মফিজ, ভাড়া হইছে তিরিশ’- একথাটি শোনেননি এমন মানুষ পাওয়া ভার। আর যাদের নাম মফিজ তাদেরতো কথাই নেই। যার মুখের একথা এতটা জনপ্রিয় হয়েছে তাকে হয়তো সেভাবে চেনেন না। পর্দার পেছনেও তার আরেকটা গল্প আছে। সেটা আরো ‘থ্রিলিং’, আরো চ্যালেঞ্জিং। ছবি দেখে আন্দাজ করেছেন নিশ্চয়ই। হ্যাঁ, বাস্তবেও তিনি পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত। বর্তমানে ডিএমপিতে দায়িত্ব পালন করছেন। ও, তার নামটাইতো বলা হয়নি। সবাই মফিজ বলে চিনলেও, তার প্রকৃত নাম খন্দকার লেলিন, সহকারী পুলিশ সুপার।

দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মিডিয়াতেও কাজ করছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। কদিন আগে অভিনয়ে জুটেছে পুরস্কারও। কথা হল সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষটির সাথে। সংবাদ মাধ্যমে অপরাধ বিভাগে কাজ করতে গিয়ে সবসময় ব্যত্যয়টাই চোখে পড়েছে। এবার দেখলাম একজন পুলিশ কর্মকর্তার পর্দার আড়ালের জীবন। এর শুরুটা কোথা থেকে? জানতে চাইলে মৃদু হেসে জবাব দিলেন খন্দকার লেনিন। বললেন, ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী। সেখানে তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় একদিন বন্ধুদের সাথে প্রখ্যাত অভিনেতা তারিক আনামের অফিসে গিয়েছিলাম। সেই সময়টাতেই কাকতালীয়ভাবে সেখানে একটা বিজ্ঞাপণের জন্য স্ক্রিন টেস্ট চলছিল। অপেক্ষা করতে দেখে সেখানকার একজন জিজ্ঞেস করলেন, আমিও স্ক্রিন টেস্ট দেব কিনা, কী যেন ভেবে দিয়েই দিলাম। নির্বাচিতও হলাম। সেখান থেকেই শুরু, বলে রাখা ভালো ওই বিজ্ঞাপনটি ছিল একটি টুথ পাউডারের বিজ্ঞাপন। যার স্লোগান পরে সবার মুখে মুখে চলে এসেছিল, ‘আমার নাম মফিজ ভাড়া হইছে তিরিশ।’

তবে চাকরি, মডেলিং, অভিনয়ের আড়ালে সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন মঞ্চের কর্মীও। মঞ্চের সাথে তিনি এখনও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একসময় কাজ করেছেন নাট্যদল আরন্যকে। ইতোমধ্যে তিনি শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ, রাশিয়ান একটি নাটক থ্রি সিস্টারস, ফ্রেঞ্চ প্লে দ্যা তুফেনে কাজও করেছেন। এছাড়াও কাজ করেছেন, বিখ্যাত নোবেল বিজয়ী লেখক হ্যারল্ড প্রিস্টন এর কয়েকটি নাটক, সংস্কৃত নাটক মৃচ্ছকটিসহ বেশ কটিতেই।

এখন পর্যন্ত সবচেয়ে প্রিয় কাজ কোনটি? জানতে চাইলে লেনিন বলেন, ‘আমার জীবনের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে প্রিয় কাজ সেটি হচ্ছে মনসা মঙ্গল এর বেহুলার ভাসান নাটকে অভিনয় করা। যেখানে আমি শ্রদ্ধেয় জামিল আহমেদ স্যারের তত্ত্বাবধানে নাটকটিতে অভিনয় করি। আসলে উনি সবার সাথে এমনিতেই বেশি কাজ করেন না, আমি মনে করি আমি অনেক সৌভাগ্যবান উনার সাথে কাজ করতে পেরে।’

মডেলিং থেকে অভিনয়। পরিচালক রেদোয়ান রনির হাত ধরে জাম্পিংটা হয়েছিল। বললেন সে গল্পও। বললেন, ‘টেলিফিল্ম এ আসার পেছনে অনন্য অবদান রেদোয়ান রনি ভাইয়ের। উনার মত ডিরেকশন খুব কম পরিচালকই দিতে পারেন। নাটকের বিষয়ে উনার সৃজনশীল জ্ঞ্যান, লাইট সম্পর্কে ধারণা এবং সর্বোপরি উনি নতুন চিন্তাচেতনার মানুষ যেটা একজন ডিরেক্টরের থাকা উচিত বলে মনে করি। আরো বড় কথা হল, নতুন যে কারো ভেতর থেকে অভিনয় বের করে আনার তার দুর্দান্ত ক্ষমতা তার আছে।’

বিজ্ঞাপণ দিয়েই শুরুটা। তবে নতুন কোনো বিজ্ঞাপণে আর দেখা যাচ্ছে না। হাতে কোনো কাজ? ‘আসলে এখনি সেরকম ইচ্ছে নেই। কাজের অফার এখনো অনেক আসে। কাজ করলে জানতে পারবেন। তবে আপাতত অভিনয়টাকেই গুরুত্ব দিতে চাই।’ বললেন পার্টটাইম এই অভিনেতা।

অভিনয়ে পার্টটাইম হলেও স্বপ্ন কিন্তু ফুলটাইমই দেখেন লেনিন। ইচ্ছেটাও আকাশ ছুঁইবার। চাইছিলেন ছবি বানাবেন। সেজন্য একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার পদে কাজও শুরু করেন। কিন্তু দায়িত্বশীল কাজের প্রেসারে আর হয়ে ওঠেনি। এরপর শুরু করেন নতুনভাবে পড়াশুনা। ৩১তম বিসিএসে পারও হয়ে যান কঠিন বৈতরণী। এরপর ২০১৩ সালে যোগ দেন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে। স্বপ্নপুরণ আর হয়নি। তবে অখুশি নন তিনি। বাংলাদেশ পুলিশে কাজ করতে পেরেও গর্ববোধ করেন তিনি। লেনিনের ভাষায়, ‘দেশ এবং দেশের মানুষের সেবা করতে পেরে নিজেকে অনেক ধন্য মনে করি।’

বাংলাদেশ পুলিশ দেশ রাষ্ট্রের জন্য যে কমিটমেন্ট নিয়ে কাজ করে, ফিল্ম নিয়ে কাজ না করতে পারলেও এখানে কাজ করার ফলে সেই আশাটা অনেকটা পুরণ হয়েছে। দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে পেরে অনেক আনন্দিত তিনি।

এখন পর্যন্ত মিডিয়ার কাজে কোনো প্রতিবন্ধকতা ফেলেনি প্রশাসনিক কাজ। তার মতে, ‘সরকারি বিধি অনুযায়ী কর্তব্য অবসর বলে একটি কথা আছে। আমি সেই অবসরটুকুতে কাজ করি। আসলে মানুষের ভালোবাসা আমাকে এতটা শক্তি জোগায়। তা না হলে এত কিছু ম্যানেজ করে কাজ করা আসলেই সম্ভব হত না। অভিনয়ের প্রতি আমার কাছ থেকে তাদের আশা আমাকে অনেক অনুপ্রাণিত ও দায়বদ্ধ করে। ভালো কিছু প্রত্যাশায় কাজ করে যেতে চাই।’

এছাড়াও সাধারণ মানুষের কাছাকাছি ‘বিনোদন সেবা বা এন্টারটেইনমেন্ট সার্ভিস’ পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন তিনি। তার কথায়, ‘মানুষ সারাদিনের কাজের পর ক্লান্ত হয়ে টিভির সামনে বসে কিছু পাবার আশায়, তাই তাদের প্রতি দায়বদ্ধতাটা থেকেই আমার এই লক্ষ্যের চিন্তা হয়। মানুষকে শুধু আনন্দ নয় তার সাথে সাথে যদি কিছু মেসেজ দেয়া যায় সেই কাজগুলো হবে আমার জীবনের সার্থকতা।’

আপনার প্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রী কারা? জবাবে বললেন অনেকের নামই। লেনিনের কথায়, ‘অনেকের কাজই ভালো লাগে। তবে নাম বলতে গেলে হুমায়ন ফরিদী, মোশাররফ করিম, সুবর্না মোস্তফা, জাহিদ হাসান, আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর আর বলিউডের মধ্যে নাসিরউদ্দীন শাহ, ইরফান খান উনাদের অভিনয় খুব ভালো লাগে।

চ্যালেঞ্জিং পেশার পাশাপাশি নিজের আরেকটা জগৎ তৈরি করেছেন লেনিন। আর পেশা যতটাই কাঠখোট্টাই হোক, এই পুলিশ কর্মকর্তার ড্রিম ক্যারেক্টার কোনটা জানেনতো? ড্রিম ক্যারেক্টার একটাই, দেবদাস।-বাংলামেইল



মন্তব্য চালু নেই