ইসলামের দৃষ্টিতে আদর্শ নারী ও পুরুষের ১০টি মৌলিক গুণ জেনে নিন

 মাওলানা আব্দুর রহীম : ইসলাম নারী ও পুরুষ উভয়কেই যেমন সৃষ্টিকুলের মধ্যে বিশেষ সম্মানিত মর্যাদায় ভূষিত করেছে তেমনি নারী ও পুরুষের মধ্যে বিশেষ কতগুলো গুণের বর্তমানতাও ইসলামের দৃষ্টিতে কাম্য। এ গুণগুলোই তাদের পূর্ণ আদর্শবাদী বানিয়ে দেয় এবং এ আদর্শবাদ চিরউজ্জ্বল ও বাস্তবায়িত রাখতে পারলেই ইসলামের দেয়া সে মর্যাদা নারী ও পুরুষ পূর্ণমাত্রায় রক্ষা করতে পারে। নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও তাদের পারিবারিক জীবনের বিস্তারিত বিধান পেশ করার পূর্বে আমরা এখানে সে বিশেষ গুণাবলী সংক্ষিপ্ত উল্লেখ করতে চাই। আল্লাহ তা’আলা কুরআন মজীদে এরশাদ করেছেনঃ

আল্লহার অনুগত পুরুষ ও স্ত্রীলোক, ঈমানদার পুরুষ ও স্ত্রীলোক, আল্লাহর দিকে মনোযোগকারী পুরুষ ও স্ত্রীলোক, সত্য ন্যায়বাদী পুরুষ ও স্ত্রীলোক, সত্যের দৃঢ়তা প্রদর্শনকারী পুরুষ ও স্ত্রীলোক, আল্লাহর নিকট বিনীত নম্র পুরুষ ও স্ত্রীলোক, দানশীল পুরুষ ও স্ত্রীলোক, রোযাদার পুরুষ ও স্ত্রীলোক, নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাযতকারী পুরুষ ও স্ত্রীলোক, আল্লাহকে অধিক মাত্রায় স্মরণকারী পুরুষ ও স্ত্রীলোক –আল্লাহ তা’আলা এদের জন্যে স্বীয় ক্ষমা ও বিরাট পুরস্কার প্রস্তুত করে রেখেছেন। কোনো ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার স্ত্রীলোকের জন্যে –আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যখন কোনো বিষয়ে চূড়ান্তভাবে ফায়সালা করে দেন, তখন সেই ব্যাপারে তার বিপরীত কিছুর ইখতিয়ার ও স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগ করার কোনো অধিকার নেই। আর যে লোক আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করে, সে সুস্পষ্ট গোমরাহীর মধ্যে লিপ্ত হয়।

এই দীর্ঘ আয়াত থেকে যে গুণাবলী প্রমাণিত হচ্ছে –সেসব গুণাবলী নর-নারীর মধ্যে বর্তমান থাকলে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ হতে পারে –তা এখানে খানিকটা ব্যাখ্যাসহ সংখ্যানুক্রমিক উল্লেখ করা যাচ্ছে, যেন পাঠকগণ সহজেই সে গুণাবলী সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হতে পারেন।

১. মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম স্ত্রীলোক। ‘মুসলিম’ শব্দের আভিধানিক অর্থ আত্মসমর্পণকারী, আনুগত্য, বাধ্য। আর কুরআনী পরিভাষায় এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণকারী, আল্লাহর অনুগত ও বাধ্য। ব্যবহারিকভাবে আল্লাহর আইন পালনকারী।

২. মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন মহিলা। ‘মু’মিন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ঈমানদার। ঈমান অর্থ কোনো অদৃশ্য সত্যে বিশ্বাস স্থাপন, আর কুরআনী পরিভাষায় কুরআনের উপস্তাপিত অদৃশ্য বিষয়সমূহকে সত্য বলে নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করে নেওয়াই হচ্ছে ঈমান। এই অনুযায়ী মু’মিন হচ্ছে সে পুরুষ ও স্ত্রী, যারা কুরআনের উপস্থাপিত অদৃশ্য বিষয়সমূহের প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাসী। মুসলিম-এর পরে মু’মিন বলার তাৎপর্য এই যে, দুনিয়ার মানুষকে কেবল আল্লাহর বাহ্যিক আইন পালনকারী হলেই চলবে না, তাকে হতে হবে তাঁর প্রতি মন ও অন্তর দিয়ে ঐকান্তিক বিশ্বাসী।

৩. আল্লাহর দিকে মনোযোগকারী পুরুষ ও স্ত্রীলোক। এর অর্থ সেসব লোক, যারা সর্বপ্রকার মিথ্যাকে পরিহার করে আন্তরিক নিষ্ঠা সহকারে আল্লাহর হুকুম পালন করে চলে। ফলে তাদের আমলে কোনো প্রকার রিয়াকারী বা দেখানোপনা থাকে না।

৫. সত্যের পথে দৃঢ়তা প্রদর্শনকারী পুরুষ ও স্ত্রীলোক। মূল শব্দ (আরবী) সবর। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে নিজেকে বেঁধে রাখা, ধৈর্য ধারণ করা। এখানে সেসব পুরুষ-স্ত্রীলোককে বোঝানো হয়েছে, যারা আল্লাহর দ্বীন পালন ও তাঁর বন্দেগী অবলম্বন করতে গিয়ে সকল প্রকার দুঃখ-কষ্ট অকাতরে সহ্য করে, তার ওপর দৃঢ় হয়ে অচল অটল হয়ে থাকে। শত বাধা-প্রতিকূলতার সঙ্গে মুকাবিলা করেও দ্বীনের ওপর মজবুত থাকে এবং কোনোক্রমেই আদর্শ বিচ্যুত হয় না।

৬. আল্লাহর নিকট বিনীত নম্র পুরুষ ও স্ত্রীলোক অর্থাৎ যারা অন্তর, মন ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সব কিছু দিয়ে আল্লাহর বিনীত বন্দেগী করে। মূল শব্দটি হচ্ছে (আরবী) ‘খুশূয়ূন’, অর্থ প্রশান্তি, স্থিতি, প্রীতি, শ্রদ্ধা-ভক্তি, বিনয়, ভয়মিশ্রিত ভালোবাসা এবং আল্লাহর প্রতি আগ্রহ-উৎসাহ।

৭. দানশীল পুরুষ ও স্ত্রীলোক অর্থাৎ যারা গরীব-দুঃখী ও অভাবগ্রস্তদের প্রতি অন্তরে দয়া অনুভব করে উদ্ধৃত্ত মাল ও অর্থ কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে অভাবগ্রস্ত লোকদের দেয়।

৮. রোযাদার পুরুষ ও স্ত্রীলোক অর্থাৎ যারা আল্লাহর হুকুম-মুতাবিক রোযা রাখে, যে রোযার ফল হচ্ছে তাকওয়া পরহেযগারী লাভ এবং যার মাধ্যমে ক্ষুৎপিপাসার জ্বালা ও যন্ত্রণা অনুভব করা যায় প্রত্যক্ষভাবে ও তার জন্যে ধৈর্য ধারনের শক্তি অর্জন করতে পারেন।

৯. লজ্জাস্থানের হেফাযতকারী পুরুষ ও স্ত্রীলোক অর্থাৎ যারা নিজেদের লজ্জাস্থান অন্য লোকদের সামনে প্রকাশ করে না –তাতে লজ্জাবোধ করে এবং নিজেদের লিঙ্গস্থানকে হারামভাবে ও হারাম পথে ব্যবহার করেনা। ঢেকে রাখার যোগ্য দেহে –দেহের কোন অঙ্গকে ভিন-পুরুষ-স্ত্রীর সামনে উন্মুক্ত করে না।

১০. আল্লাহকে অধিক মাত্রায় স্মরণকারী পুরুষ ও স্ত্রীলোক অর্থাৎ যাঁরা আল্লাহকে কস্মিনকালেও এবং মুহুর্তের তরেও ভুলে যায় না, আর মুখ ও কলব ক্ষেত্রেই আল্লাহকে চিরস্মরণীয় রাখে।

এই দশটি মৌলিক গুণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হোক এবং এ গুণধারী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সমাজ গঠিত হোক, কুরআনের এ ভাষণের মূল লক্ষ্য তাই। এ মৌলিক গুণাবলী নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যেই কাম্য। কেবল পুরুষদেরই নয়, নারীদেরও এই গুণাবলীর অধিকারী হতে হবে। আর তা হতে পারলেই এই পুরুষ ও নারী সমন্বয়ে গঠিত হবে আদর্ম সমাজ যা কুরআন গড়ে তুলতে চায়।



মন্তব্য চালু নেই