ঈদ বাজারকে সামনে রেখে মুরগির খামারে তৈরি হচ্ছে লাচ্ছা!

বসতবাড়ি ঘেঁষে মুরগির খামার। খামারের ভেতরে পা দিতেই নাকে ভেসে এল উৎকট গন্ধ। শেডের ওপরে ঝুলছে মুরগির পানি খাওয়ানোর প্লাস্টিকের পাত্র। তবে শেডে এখন মুরগি নেই। এক মাসের জন্য শেডে মুরগি তোলা বন্ধ করে তৈরি করা হচ্ছে লাচ্ছা সেমাই।

ঈদ বাজারকে সামনে রেখে বগুড়ার কাহালু উপজেলার শেখাহার বাজারে অস্থায়ীভাবে গড়ে ওঠা এ কারখানায় গত বৃহস্পতিবার গিয়ে দেখা গেল, শ্রমিকদের কেউ মেঝেতে ময়দা ঢেলে পা দিয়ে খামির তৈরি করছেন, কেউ খালি গায়ে ডালডার বল তৈরি করছেন, কেউ রিং করছেন। সবার গা থেকে টপটপ করে ঘাম বেয়ে পড়ছে। কারখানার মালিক আবু সাঈদ।

আবু সাঈদ বলেন, এক মাসের ব্যবসা। এ জন্য শেডে মুরগি তোলা বাদ দিয়ে লাচ্ছা তৈরি করছেন। এবার ময়দা, পামওয়েল ও ডালডার দাম বাড়লেও লাচ্ছার বাজার মন্দা। গতবার প্রতি মণ লাচ্ছা দুই হাজার থেকে দুই হাজার দুই শ টাকা দরে বিক্রি হলেও এবার সর্বোচ্চ এক হাজার আট শ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
পাশের সেকেন্দার আলীর কারখানায় গিয়ে দেখা গেল, বিশাল কারখানায় একপাশে চলছে খামির তৈরির কাজ। পাঁচ থেকে ছয়জন শ্রমিক পা দিয়ে খামির তৈরি করছেন। গা থেকে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে খামিরের ওপর। পাশেই তৈরি করে রাখা খামিরে মাছি বসেছে। এখানে খামির তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে পান করার অযোগ্য পানি।

1111

সেকেন্দার আলী বলেন, কারখানায় ৩০ জন শ্রমিক কাজ করছেন। প্রতিদিন গড়ে ৫০ মণ লাচ্ছা তৈরি হচ্ছে। ৭৫ কেজি ময়দার লাচ্ছা তৈরি ও খামির করার জন্য মজুরি দিতে হচ্ছে ৪৫০ টাকা। গত বছর ছিল ৪৩০ টাকা। হাত দিয়ে খামির করতে গেলে খরচ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদনও কমে যাবে। তাতে বাজার ধরা সম্ভব হবে না।

ওই দুই কারখানার মতোই চিত্র দেখা যায় শেখাহার বাজারের ১৬টি কারখানার। এখানকার অর্ধশতাধিক কারখানার মধ্যে মাত্র দুটির অনুমোদন রয়েছে বিএসটিআইয়ের।

বিএসটিআই বগুড়া কার্যালয়ের মাঠ কর্মকর্তা দেবব্রত বিশ্বাস বলেন, বগুড়া জেলায় ৫৬টি লাচ্ছা কারখানার অনুমোদন রয়েছে। এর মধ্যে শেখাহারেরও দুটি কারখানা আছে। তবে লাচ্ছা তৈরির নামে শেখাহারে কয়েক বছর যা হচ্ছে, তা মেনে নেওয়া যায় না। গত বছর অভিযান চালানো হয়েছিল। এবার দুটি কারখানার অনুমোদন বাতিলসহ অভিযান চালিয়ে সব কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে বিএসটিআই।

চলছে ময়দার খামির বানানোর কাজকয়েকটি কারখানার মালিকেরা জানান, ২৫ বছর আগে এই বাজারে মনির হোসেন ও আবু বক্করসহ কয়েকজন লাচ্ছা তৈরি করে পাইকারি বাজারে সরবরাহ শুরু করেন। তাঁদের হাত ধরে এখানকার লাচ্ছার বাজার ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে লাচ্ছা তৈরির সুযোগ নিয়ে কারখানার মালিকদের ঘুষ দিতে হয় বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে।

সেকেন্দার আলীর কারখানায় পা দিয়ে ময়দা খামির করছিলেন বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার চাউলিয়াপাড় গ্রামের শ্রমিক মেহেদী হাসান। তিনি বলেন, তিনি মূলত কৃষিকাজ করেন। রোজার এক মাস এখানকার লাচ্ছার কারখানায় কাজ করতে আসেন। সাড়ে ৩৭ কেজি ওজনের এক বস্তা ময়দার খামির করে পান ৮০ টাকা। দিন শেষে গড়ে ৩০০ টাকা মজুরি মেলে। তিনি আরও বলেন, হাত দিয়ে খামির করলে সময় অনেক লাগে। খরচ বাঁচাতেই কারখানা মালিকেরা পা দিয়ে খামির করিয়ে নিচ্ছেন।

শেকাহার বাজারের ব্যবসায়ী আবদুর রাজ্জাক বলেন, ময়দা থেকে খামির করতে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে তিনি মেশিন কিনেছেন। মেশিনে খামির করা লাচ্ছার গুনগত মান ঠিক থাকায় বাজারে এর চাহিদা ও দাম বেশি।

শেখাহার বাজারের লাচ্ছার সবচেয়ে বড় কারখানা সাজ্জাদ হোসেন ও রুবেল হোসেনের। ভাই ভাই লাচ্ছা অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্টসের সাজ্জাদ হোসেন বলেন, এখানে ছোটবড় প্রায় ৫০টি কারখানায় গড়ে এক হাজার মৌসুমি শ্রমিক কাজ করেন। কেউ পেশাদার কারিগর নন। তিনি আরও বলেন, অপরিকল্পিতভাবে লাচ্ছার কারখানা গড়ে ওঠায় লাচ্ছার গুনগত মান ঠিক রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তবে খামির করার যন্ত্র কেনার জন্য সরকার সহজ শর্তে পুঁজি, কারখানা স্থাপনের জন্য জায়গা বরাদ্দ এবং গ্যাস সংযোগের দিকে নজর দিলে শেখাহারের লাচ্ছার বাজার বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।

কক্সবাজার থেকে লাচ্ছা কিনতে আসা পাইকার জালাল উদ্দিন জানান, কয়েক বছর ধরে তিনি এখান থেকে লাচ্ছা কিনে বিভিন্ন শহরে সরবরাহ করছেন। এবার ৩০ মেট্রিক টন লাচ্ছা কিনে পাঠিয়েছেন। আরও ৫০ টন লাচ্ছা কিনবেন। তিনি বলেন, মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে পারলে বগুড়ার লাচ্ছা বিদেশে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।

বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. খোরশেদ আলম বলেন, অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে লাচ্ছা উৎপাদন কোনোভাবেই চলতে দেওয়া হবে না। শেখাহারের লাচ্ছা কারখানাগুলোতে ভেজালবিরোধী টাস্কফোর্সের অভিযান চালানো হবে।প্রথম আলো



মন্তব্য চালু নেই