‘ঈদ মানে নিছকই একটি দিন’

ঈদুল আজহা। মুসলমানদের আনন্দঘন বড় একটি উৎসবের দিন। দিনটিকে সামনে রেখে কতজনার কত পরিকল্পনা সে হিসেব রাখার সাধ্য নেই। হাটে যাওয়া, পশু কেনা, নতুন পোশাক পরা, খাওয়া-দাওয়া আর বেড়াতে যাওয়ার ভাবনা তো আছেই। আছে উপহার নেওয়া-দেওয়ার বাসনাও।

ঈদ উৎসবকে ঘিরে রাজধানীর ধর্ণাঢ্য পরিবারগুলো কেনাকাটা শুরু করে পুরো মাস জুড়ে। অভিজাত মার্কেটগুলোতে ভিড় লেগেই থাকে। ঈদ ঘনিয়ে আসতে তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না পোশাকের শো-রুমে। এসব পরিবারে মাসব্যাপী চলে ঈদ উদযাপনের পরিকল্পনা।

পাশেই রয়েছে ভিন্ন চিত্র। এমন মানুষ আছেন যারা বছরের পর বছর রাজধানীতে বসবাস করেন। অথচ ঈদ আনন্দের ছোঁয়া তাদের গায়ে লাগে না। এরা বেশির ভাগই বস্তিবাসী বা ভাসমান মানুষ। প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে শুধুমাত্র বেঁচেই থাকেন। বড় ঈদ(কোরবানির ঈদ) ছোট ঈদ উৎসব-পাবন অনুভব করার সুযোগ তাদের ভাগ্যে জোটে না। এমন কিছু ছিন্নমূল সাধারণ মানুষের কথা রাইজিংবিডির পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

আতিকুর। বয়স ৮ বছর। থাকে রাজধানীর কমলাপুরে। দাদির সঙ্গে ছোটবেলায় ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় চলে আসে পেটের দায়ে। দুটো ভাতের জন্য শিশুকাল থেকেই কাগজ টোকানোর কাজ করছে। ঈদের বাকি এক দিন-এমন দিনেও ফুটপাতে কাজ করছিল আতিকুর। মুখে সামান্য হাসি নিয়েই তাকিয়েছিল সে। প্রশ্ন করা হয়-ঈদের জন্য কী কী কিনেছ তুমি ?- সঙ্গে সঙ্গে তার চেহারা কালো হয়ে আসে। আস্তে আস্তে নিচু হয়ে যায় তার মাথা। মনে হলো ঝড় শুরু হওয়ার আগ মুহূর্তের কোনো মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে তার মুখ।

এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন-কী কিনবে তুমি ঈদের জন্যে। ….সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করল। ২/৩ ফোটা পানি মাটিতে পড়ল, শরীর গড়িয়ে কয়েক ফোটা ঘামও পড়ল মাটিতে। কিছুই বললনা আতিকুর। তবে তার কান্নায় কোন শব্দ ছিলো না।

হাফিজা বেগম (৪৩)কে পাওয়া গেল সায়েদাবাদ এলাকায়। তিনি বলেন, `ভাই আমাদের কি আর ঈদ আছে । আমাদের নতুন জামা-কাপড় আর সেমাই চিনি কিনতে কিনতেই ঈদ শেষ হয়ে যায়। কষ্ট লাগে আপসুস হয় যদি একটু ভালো পয়সা কড়ি রোজগার করতে পারতাম তাহলে পোলাপানদের কাপড় কিনে দিতে পারতাম। আমাদের কাছে বড় ঈদ, ছোট ঈদ ও সাধারণ দিনের মধ্যে কোনো ব্যবধান নাই।` ঈদের দিনও প্রতিদিনের মতোই কাজে-কর্মে কেটে যায় বলে জানান হাফিজা।

হাফিজার স্বামী নেই তিন ছেলে-মেয়ে। বড় মেয়ের বয়স নয় বছর। শেরপুর থেকে ১২ বছর আগে ঢাকায় এসে বলতে গেলে ফুটপাতেই সংসার পাতেন হাফিজা বেগম। তার মতো রাস্তার পাশে এ রকম সারি বেধে অনেকেই বসবাস করেন। কাগজ ও প্লাস্টিক কুড়িয়ে যে রোজগার হয় তা দিয়েই হয় তার ঈদের আয়োজন।

জীবিকার তাড়নায় গ্রাম থেকে বছর কয়েক আগে চার সন্তানসহ ঢাকা আসেন মিনা বেগম (৪০)। তারও আশ্রয় হয় ফুটপাতে। মিনা বেগম বলেন, ‘খুব কষ্টে ঈদের আয়োজন করি। হাফ কেজি চাল,হাফ কেজি চিনি সেমাই, কেউ যদি গোস্ত দেয় তা দিয়েই তো আমাদের ঈদ।’

হাফিজা ও মিনার মতো আরো হাজারো মানুষ বিভিন্ন জেলা থেকে নগরীতে এসে বস্তি ও ফুটপাতে আশ্রয় নেয়। তাদের জীবনে ঈদের দিনটি কোনো ভিন্ন বার্তা বয়ে আনে না। ঈদ মানে তাদের কাছে নিছকই একটি দিন। ঈদের সময়টা কাজ বন্ধ থাকায় শ্রমজীবী এ মানুষগুলোর কেউ কেউ ঘুমিয়েই পার করে দেয় দিনটি।

শফিক নামের এক বৃদ্ধ বলেন, ‘ঈদে মানুষ আনন্দ-ফুর্তি করে,আমাদের কোনো আনন্দ-ফুর্তি নেই। আমরা ঈদের জামা-কাপড় কোথায় পাবো?’

প্রতিনিয়ত জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করা এ মানুষগুলোর কাছে অন্য দিনগুলোর সঙ্গে ঈদের দিনের কোনো পার্থক্য নেই। ঈদের দিনে তাদের ভাবনা ও জীবনযাত্রায় কোনো তফাৎ আনে না।

বৃদ্ধ আফজাল (৬০)বলেন, `আমার বাড়িঘর নাই। আত্মীয় স্বজন গ্রামে আছে। তাদের কাছে যাই না। আমার ছেলে-বউ কেউ নাই। আমি সব সময় এখানেই থাকি। ছেলে পেলে হয়নি। দরিদ্র বলে স্ত্রী আমাকে ত্যাগ করে চলে গেছে।`

কেউ যদি তাকে দান করে তাহলে সে জামা কাপড় পায়। তা না হলে পুরাতন কাপড় দিয়ে ঈদ করে থাকে। মসজিদে থাকে তাই থাকা খাওয়ার কোন সমস্যা হয় না-জানান আফজাল।

রিকশা চালক মোস্তাফিজ(৩৪) বলেন, `ঈদের দিন যদি রিকশা চালাই তাহলে ভাড়া বকসিস মিলিয়ে ভালই কামানো যায়।`

মোস্তাফিজ বলে, তার মা-বাবা কেউ নেই, বিয়ে করেছেন গত বছর। তাই নীলফামারী গ্রামের বাড়িতে তার যাওয়া হয় না। স্বামী-স্ত্রী মিলে ভালই রোজগার করে তারা। পয়সা নষ্ট করার কোনো অভ্যাস তার নাই। ঈদের দিন স্ত্রীকে নিয়ে কেটে যাবে আর কি। সামনে তাদের সংসারে নতুন অতিথি আসবে বলে জানায় মোস্তাফিজ।



মন্তব্য চালু নেই