একজন ‘চরিত্রহীনা’র খোলা চিঠি

জেসমিন চৌধুরী :

প্রিয় পুরুষ, প্রিয় সমাজ, প্রিয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের রক্ষক নারীগণ, আজ আপনাদের কাছে বিনীত স্বীকারোক্তি জানাতে এসেছি। আপনাদের নানান মন্তব্য আর সাবধান বাণীতে আমার বোধোদয় হয়েছে, অবশেষে আমি বুঝতে পেরেছি আমি আসলেই চরিত্রহীন।

এতোদিন আপনাদের কাছে আমি আমার যুদ্ধের গল্প বলেছি, সাহসের গল্প বলেছি, বিজয়ের গল্প বলেছি কিন্তু তা আপনাদের ভাল লাগেনি। আজ আপনাদেরকে অম্লান বদনে আমার চরিত্রস্খলনের গল্প বলবো। আশা করি আমার এ শুভ বুদ্ধির উদয় আপনাদের মনপুতঃ হবে।

আমার চরিত্রের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে আপনাদের লেখা প্রেসক্রিপশন আমি খুলে দেখেও অবহেলায় ফেলে রেখেছি, তা স্বীকার করতে আজ আর আমার দ্বিধা নেই। আপনারা আমার আধখোলা চোখ টেনে এতোটাই খুলে দিয়েছেন যে নিজের কৃত সমস্ত অপরাধ আমি আজ স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি। আমি নি:সন্দেহে অপরাধী।

আমি একজন বাংগালি নারী। আঠারো বছর বয়সে আমি খুশী মনেই আপনাদের কথামতো নিজের পড়াশোনার পাট চুকিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলাম। ভেবেছিলাম আমার জন্য যা করা হচ্ছে তা আমার ভাল’র জন্যই করা হচ্ছে। আমি ভাত রাঁধতে জানতাম, মাছ কুটতে পারতাম, আমার হাতের কুচি করা পেঁয়াজ হতো দেখবার মতন মিহিন, আমি কাপড় ভাঁজ করলে তা দেখতে এতোই পরিপাটি হতো যে কোনটা লুংগি আর কোনটা শার্ট তা দূর থেকে বুঝবার যো টি ছিল না। বিবাহিত জীবনে সুখী হবার জন্য হাতে কলমে উপযুক্ত প্রশিক্ষণই আপনারা আমাকে দিয়েছিলেন, কিন্তু আমার জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। আমি আপনাদেরকে আশাহত করেছি, আমি নিঃসন্দেহে চরিত্রহীন।

আপনাদের দেয়া সমস্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে সংসার করতে গিয়ে যখন আমি দেখেছি আমাকে দেয়া আপনাদের প্রতিশ্রুতিগুলো মিথ্যা ছিল, যখন বুঝেছি পুরুষের চরিত্র আমার মত সমান পবিত্রতার দাবী রাখে না আপনাদের কাছে, আমি চেঁচাইনি। আমি আপনাদের কাছে কাঁদতে ছুটে আসিনি, আমার দুর্ভাগ্য নিয়ে ‘আহা উহু’ করার সুযোগ দেইনি আপনাদেরকে। কোন একজন পুরুষের কাছে আশ্রয়ের জন্য ছুটে যাইনি, আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে দেইনি কোন পুরুষকে। আমি আপনাদের বঞ্চিত করেছি, আমি চরিত্রহীন তো বটেই।

তাপ নির্ণয় না করেই আপনারা আমাকে যে গরম তেলের কড়াইতে ফেলেছিলেন, তাড়াহুড়ো করে তা থেকে আমি আগুনে ঝাঁপ দিইনি, নিজেকে পুড়িয়ে আপনাদের চোখে সতী সাবিত্রী হতে পারিনি। আপনাদের অনেকেরই আঠারো বছরের মেয়ে আছে। ভেবে দেখুন, এই বয়সের একটি মেয়ে যার কোন শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই, প্রতিকূলতার মুখে টিকে থাকার অভিজ্ঞতা নেই, যখন জীবনের নিষ্ঠুরতার মুখোমুখি হয়, সে কতটুকু অসহায় বোধ করতে পারে। এমন পরিস্থিতিতেও কারো দিকে আংগুল না তুলে যে মেয়ে ভালভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে, কারো কাছে অভিযোগ না করে টিকে থাকার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে সন্দেহাতিতভাবে উদ্ধত এবং চরিত্রহীন।

দশজনকে ডেকে বিচার বসায়নি যে মেয়ে, তার ব্যক্তিগত জীবনের একান্ত সমস্যাগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণের সুযোগ দেয় না সমাজকে, সে নিতান্তই বেয়াদব।

ঝামেলাটা ঠিক কোথায় ছিল? দাম্পত্য কলহের কারণ কী? দোষটা কার ছিল? স্বামীটি কি কখনো তার গায়ে হাত তুলেছে? নাকি অন্য কোন ধরনের দুর্ব্যবহার করেছে? স্বামীর নানান দোষের কথা যদি গেয়ে বেড়াতো সে সমাজ তাকে বুঝানোর সুযোগ পেত, ‘পুরুষ লোকের এসব দোষ এক আধটু থাকেই, মাথা ঠাণ্ডা রেখে ঘর সংসার কর।’

যেহেতু সে তা করেনি, তাহলে ঘটনাটা দাঁড়ায়, ‘পুরুষটা তো ভালই ছিল, তোমারই বোধ হয় চরিত্র খারাপ। সচ্চরিত্র কোন বাঙ্গালী মেয়ে কি স্বামী ত্যাগ করার কথা ভাবতেও পারে? তার উপর আবার পুনর্বিবাহ? ছি:!’

এসব বিকৃত কৌতুহল মেটানোর সুযোগ যদি সে দিত সমাজকে, সে হতো ভাল মেয়ে। তা না করে সে মুখ বুজে ধৈর্য্য ধরে নিজেকে শিক্ষিত করে তুলেছে, কারো কাছে কখনো পাঁচ টাকা না চেয়ে নিজ যোগ্যতায় অর্থনৈতিক মুক্তির পথ খুঁজেছে, নিজের সমস্যাগুলোর সমাধান নিজেই করেছে, তারপর স্বেচ্ছায় স্বামীগৃহ ত্যাগ করেছে। সমস্যার কথা কাউকে কখনো জানায়নি যে মেয়ে, সে আজ তার সাফল্যের গল্প বলতে ব্যাকুল, তার গৌরবের কাহিনী গেয়ে বড়াই করে বেড়ায়, আরো দশটা মেয়ের মাথা নষ্ট করে। এমন মেয়ে কি চেয়েছিল এ সমাজ? ধিক এমন মেয়েকে, ধিক!

আমার অপরাধ আমি আগুনে ঝাঁপ না দিয়ে কড়াইতে বসেই তাপ সইতে শিখেছি, কিন্তু আমার এই শিক্ষার কৃতিত্ব কড়াই বা তেল কাউকেই দেইনি। সবকিছুর পর কড়াইতে বসেই নিজেকে প্রস্তুত করলাম, অথচ কড়াইর গুণগান গাইলাম না, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম না। আমি জানি আপনাদের আদরে লালিত কড়াইয়ের প্রতি আমার এই আচরণে আপনারা ক্ষুব্ধ, এবং এতে আমার চরিত্রহীনতাই প্রকাশ পায়।

এখানেই আমার অপরাধের শেষ হলে কথা ছিল, তারপরও বড়শি থেকে ছুটে যাওয়া মাছ যেমন অন্য মাছেদের সতর্ক করে দেয়, তেমনি নিরলসভাবে তেল আর কড়াই’র কাহিনী লিখে আমার মত আরো দশজনকে সতর্ক করে দেওয়ার স্পর্ধা দেখিয়েছি আমি। আপনারা আর কাঁহাতক সহ্য করবেন? আপনাদের মনোবেদনা আমি বুঝি।

আর আমার সবচেয়ে গুরুতর, সবচেয়ে ক্ষমাহীন অপরাধ হলো আমার নির্দাগ অস্তিত্ব, নিরুদ্বেগ চালচলন। কড়াইর তেলে এতোদিন পুড়েও গায়ে ফোস্কা নেই, এ কেমন কথা? আমি পুড়ে সোনা হয়েছি, এমনটা ভাববার কোন কারণই নেই। আপনাদের কড়াই, আপনাদের চূলা, আপনাদের আগুন আমাকে ধ্বংস করতে পারেনি। এ আমার চরিত্রেরই দোষ।

আমার সন্তানদের কখনো দুর্বল বা অসহায় বোধ করতে দিইনি আমি। আপনাদের দ্বারে দ্বারে কেঁদে ফেরেনি তারা, সহানুভূতি ভিক্ষা চায়নি। তাদেরকে করুণা করবার সুযোগ ঘটেনি আপনাদের। তাদের শিখিয়ে-পড়িয়ে আপনাদের মনমতো প্রস্তুত করবেন কী, তাদের টিকিটির নাগালও কখনো পাননি। তারা নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, শিক্ষিত হয়েছে, আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে শিখেছে। তারা আমারই সন্তান, তারা আমার চেয়ে আর কতোটুকু ভাল হবে বলুন?

আঠারো বছর বয়সের অর্বাচীনতা, অক্ষমতা, অসহায়ত্ব নিয়ে নিজের চারপাশের ধূলা আমি নিজের হাতেই সাফ করেছি। দশজনকে ডেকে সেই ‘ধূলারে মারিয়া’ কাদা বানাতে দেইনি। এ অপরাধ যে ক্ষমার অযোগ্য তা আমি জানি, তাই আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইবো না।

বিনীত,

একজন ‘চরিত্রহীনা’ নারী



মন্তব্য চালু নেই