একাকী প্রবাস জীবন

ফেরদৌস আরা, সেন্দাই (জাপান) থেকে: হোমসিকনেস বা গৃহকাতরতা শব্দটির সঙ্গে আভিধানিক ভাবেই কেবল পরিচিত ছিলাম এতদিন, কখনো উপলব্দি করার সুযোগ হয়ে উঠেনি।

জাপানে প্রবাস জীবনে এই শব্দটিই এখন নিত্যদিনের সঙ্গী।

নিজের মা-বাবা ছেড়ে আছি সেই ক্লাস সিক্স থেকে, কিন্তু কখনও সেই অর্থে একাকীত্ব অনুভব করিনি। সত্যি বলতে গেলে, তখন বাড়ি ছেড়ে থাকতে এক ধরনের ভালো লাগাই কাজ করতো। এক ধরনের স্বাধীনতা অনুভব করতাম।

প্রবাস জীবন দৃশ্যত খুব স্বাধীন, কিন্তু সব স্বাধীনতার পরেও কী যেন এক অদৃশ্য শেকলে বাঁধা পড়ে থাকা এক জীবন।

জাপানে একাকী পথ চলার সময়গুলোতে বার বার দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়কার দিনগুলোকেই যেন খুঁজে ফিরি। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাজুন্নেসা হলের ছাত্রী ছিলাম। ক্যাম্পাসে ছিল ক্লাসের ফাঁকে আড্ডা, টং দোকানের চা, ক্যাফেটেরিয়ার বিল নিয়ে টানাটানি, হৈ হুল্লোড় আর আনন্দময় সময় কাটিয়ে ঘরে ফিরে ছিল রুমমেটদের সাথে খুনসুটি। কখনও ইচ্ছে হলে হলের পেছনের পাহাড়ে দৌড়াদৌড়ি, সুযোগ পেলেই জাফলং বেড়ানো, বিনা ছুতোয় পাঁচ ভাই বা উন্দাল রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়া।

শিক্ষা বা গবেষণায় সকল প্রাপ্তির ভিতরেও হঠাৎ করেই যখন খুব একা লাগে, কিছুই যেন করার থাকে না তখন। আর এই প্রবাস জীবনে তো মাঝে মাঝে কথা বলার মতো কাউকে পাওয়া যায় না,সবাইতো ব্যস্ত! ভাগ্যবানরা ছাড়া অনেক প্রবাসীই আসলে বন্ধুহীন জীবনই কাটায়।

সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে যখন অসুস্থ হলে কেউ পাশে থাকে না। এখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা হয়ত খুবই ভালো তবে ইচ্ছে হয় কেউ এসে একবার কপালে হাতটা রেখে জ্বর দেখুক।

খুব মন খারাপের সময় চলে যাই নদীর কাছে, একা একা পানির স্রোতের সঙ্গে মৃদু স্বরে কথা বলেই কাটিয়ে দেই কিছুটা সময়।

দেশে বাড়ির বাইরে থাকলেও ইচ্ছে হলেই ছুটে যাওয়া যায় আপন নীড়ে, কিন্তু প্রবাস জীবনের গণ্ডি পেরিয়ে চাইলেই ইচ্ছেমতো ঘরে ছুটে যাওয়ার সুযোগ থাকে না। ইচ্ছেগুলো বাধা পড়ে যায় দূরত্বের ফাঁদে।কখনও গুমড়ে কাঁদে ইচ্ছেগুলো, কখনও ভাসিয়ে দিতে হয় চোখের জলে।

ছোট্ট একটুকরা ইচ্ছে, হয়তো কোন দেশী খাবার, হয়ত কচুর লতি, যা দেশে থাকতে গলা চুলকানোর ভয়ে খেতেই চাইতাম না, মাঝে মাঝে তার জন্যই মনটা কেঁদে উঠে। এর নামই বোধ হয় গৃহকাতরতা।



মন্তব্য চালু নেই