এনালগ মস্তিষ্কের ডিজিটাল দেহ !

দুটো ঘটনাই ২০১০ সালের। একটি ঘটেছিল পটুয়াখালী জেলার দশমিনা উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চল চরবোরহানে। অন্যটি ঘটেছিল জাতীয় সংসদের অভ্যন্তরে অবস্থিত মসজিদের সামনে। প্রথম ঘটনার নায়িকা হরিমন বেওয়া নামক ৭০-৭২ বছর বয়স্ক এক মহিলা। নিতান্ত দরিদ্র, অশিক্ষিত এবং নানান রোগে আক্রান্ত খিটখিটে মেজাজের এক গ্রাম্য ভিখারিণী। দ্বিতীয় ঘটনার নায়ক হলেন একজন ডাকসাইটে মন্ত্রী— বয়স হরিমন বেওয়ার প্রায় কাছাকাছি। প্রথম ঘটনার নায়িকা লোকমুখে খবর পেলেন সরকারের ডিজিটাল কর্মসূচির উদ্বোধন হবে। তিনি মনে করলেন বড় মাপের কোনো ত্রাণফ্রান দেওয়া হবে। দৌড়ে তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখলেন একটি টিনের ঘরের অন্ধকারের মধ্যে সরকারের ডিজিটাল প্রকল্পসমূহ নিয়ে তৈরি বায়োস্কোপ দেখাচ্ছে। বুড়ি কি মনে করলেন তা বলতে পারব না। তিনি সবাইকে অতিক্রম করে একদম সামনের দিকে গিয়ে চ্যাংড়া পোলাপানের সঙ্গে বসে খুব মনোযোগ সহকারে প্রামাণ্যচিত্রটি দেখতে লাগলেন। অনুষ্ঠান শেষে তিনি বেশ উচ্ছ্বাস এবং হাসিমাখা মুখ নিয়ে বের হলেন এবং লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলেন— মনুরা! চাউল দেবে না! কেউ একজন দুষ্টামি করে বলল— ওরে আমার ডিজিটাল বুড়িরে! চাউল লাগবে ক্যা— দুই ঘণ্টা বইস্যা ডিজিটাল দ্যাখলা— প্যাট ভরে নাই। লোকটির কথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন হরিমন বেওয়া। খিস্তিখেউর করার জন্য ফোকলা দাঁতের চর্মসার মুখটি ভেংচিয়ে বললেন— এ্যাই ছ্যামড়া চাইয়্যা দ্যাখ! কি কইলি! মুই ডিজিটাল? তোর ম্যায় ডিজিটাল— তোর বাহে ডিজিটাল— তোর চৌদ্দগুষ্টি ডিজিটাল… কোহানকার ফ্যাতরার পো ফ্যাতরা— চুলুর পো চুলু…।

এবার দ্বিতীয় ঘটনার নায়ক সম্পর্কে কিছু বলে নেই। সাদা সফেদ পাঞ্জাবি এবং ঢোলা পাজামা পরে নায়ক দাঁড়িয়ে আছেন মসজিদের সামনে। কাচুমাচু মুখ— একটি হাত পাজামার পকেটে ঢোকানো। মাগরিবের আজান হয়েছে। দলে দলে মন্ত্রী-এমপি, আমলা এবং দর্শনার্থীরা তাড়াহুড়া করে মসজিদে ঢুকছেন। আমি সেখানে ঢোকার সময় লক্ষ্য করলাম নায়কের বিবর্ণ মুখচ্ছবি এবং অস্থির ছটফটানি। এগিয়ে গিয়ে বললাম— ভাই সমস্যা কি? অমন করছেন কেন। তিনি চোখে মুখে মহা বিরক্তি ফুটিয়ে তুলে বললেন— আরে বইলো না— মোবাইল নিয়ে বড় ঝামেলার মধ্যে আছি। মেয়ে একটা নতুন ফোন কিনে দিয়েছে। এখন ওটা বন্ধ করতে পারতেছি না। এদিকে বার বার ফোন আসছে আর মোরগের কক্কর ককর শব্দে রিংটোন বাজছে। সাউন্ডও কমাতে পারছি না। এইটা নিয়ে নামাজ পড়ব কীভাবে! জামাতে দাঁড়ালে যদি ফোন আসে তবে লোকজন তো মুরগার ডাক শুনে হাসাহাসি করব। তাই দাঁড়াইয়্যা আছি— সবার নামাজ শেষ হলে মসজিদে ঢুকব…।

সরকারের ডিজিটালাইজেশনের সময়ে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একজনের প্রতিভূ এবং সরকারি দলে একজন কেবিনেট মন্ত্রীর বাস্তব সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে কেউ যদি প্রযুুক্তির পথে এগুতে চান তবে তিনি বা তার কর্মের দ্বারা কি ভয়ঙ্কর অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে তা হালের ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা থেকে বোঝা যায়। সরকার পুরো দেশকে ডিজিটালাইজেশন করার জন্য কোনো মাস্টার প্ল্যান করেনি। তৈরি করেনি দক্ষ জনশক্তি এবং আধুনিক অবকাঠামো। পশ্চিমা দুনিয়ার রাস্তার পাশের সাইবার ক্যাফেগুলোতে যারা একজন কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে চাকরি করার যোগ্যতা রাখে না সেসব লোককে বড় বড় রাষ্ট্রীয় প্রকল্পে কনসালটেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়ে গত কয়েক বছরে কতটা সর্বনাশ করেছে তার নমুনা ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। টেলিযোগাযোগ এবং প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় যখন একীভূত ছিল তখন মন্ত্রী ছিলেন মোহতারেমা সাহারা খাতুন। এরপর এলেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। পরবর্তীতে তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় আলাদা করা হলে প্রথমে মন্ত্রী হন পদ্মা সেতু-খ্যাত সৈয়দ আবুল হোসেন। পরে মোস্তফা ফারুখ চৌধুরী নামের বয়োবৃদ্ধ এক ভদ্রলোক— যিনি তার সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর সৈয়দ আবুল হোসেনের কোম্পানি সাঁকো ইন্টারন্যাশনালে কাজ করতেন। ৫ জানুয়ারির পর ওই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান জুনায়েদ আহমেদ পলক। অন্যদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় নামের আরেকটি মন্ত্রণালয় গত সাত বছর যাবৎ নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন ইয়াফেস ওসমান নামের একজন কবি। ফলে বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি কর্মকাণ্ডে প্রযুক্তির ব্যবহারের নামে আসলে কি হচ্ছে তার কিছু কিছু নমুনা সবে প্রকাশ হতে শুরু করেছে।

মন্ত্রীসহ বড় বড় সরকারি কর্মকর্তার রুমে একটা-দুইটা করে কম্পিউটার সংযোগ দেওয়া হয়েছে। কিছু কম্পিউটার কেনা হয়েছে রাষ্ট্রীয় অর্থে। আবার কিছু এসেছে বিভিন্ন বিদেশি রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক সংস্থা, এনজিও ইত্যাদির অনুদান বা খয়রাতি সাহায্য থেকে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, আইডিবি, জাইকা প্রভৃতি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েও কম্পিউটার কেনা হয়েছে। মন্ত্রী-সচিব বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেসব কম্পিউটার চালান না। অনেকে চালাতেও জানেন না। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত কম্পিউটার অপারেটররাই কম্পিউটারগুলোর মালিক। ২/৪টা চিঠিপত্র টাইপ করা, অবসরে গেম খেলা এবং ইন্টারনেট কানেকশন থাকলে ফেসবুক, ইউটিউব প্রভৃতি সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে হাবিজাবি করার মধ্যেই কম্পিউটার ব্যবহার সীমাবদ্ধ থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত কম্পিউটার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা বিরাজমান ছিল এবং আছে।

নবম পার্লামেন্টের এমপিদের ইউএনডিপি প্রথমে খয়রাতি সাহায্য হিসেবে ডেস্কটপ কম্পিউটার এবং অফিসের জন্য কিছু ফার্নিচার দিল। পরে প্রত্যেক এমপির জন্য আবার একটা করে ল্যাপটপ এলো। নবম পার্লামেন্টের এমপিরা সেই ল্যাপটপ অবশ্য পায়নি— হতে পারে বর্তমানের এমপিরা সেগুলো পেয়েছেন। এমপিরা কম্পিউটার দিয়ে কি কি ডিজিটাল কাজ করেছেন তার ২/১টা নমুনা আমি তাদের সংসদ ভবনের অফিসে গিয়ে দেখেছি। ও কথা আমি কোনো দিন বলতে পারব না। বলা ঠিকও হবে না। তাদের কর্মকাণ্ড এবং সেগুলো নিয়ে সমবয়সী সহকর্মীদের মধ্যে সংসদ লবিতে বসে ফিসফিসানী কোনো অবস্থাতেই মুদ্রণযোগ্য নয়। এমপিদের বাইরে, মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর প্রশাসক এবং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানরাও অফিসের জন্য ডেক্সটপ এবং ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য ল্যাপটপ পেয়েছেন। তারা গত সাত বছরে সেই কম্পিউটার দিয়ে কি করেছেন কি শিখেছেন ইত্যাদি প্রশ্ন করা হলে যে জবাবগুলো বেরিয়ে আসবে তা সরকারের জন্য মোটেই সুখকর হবে না।

মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকসহ উঁচু পর্যায়ের সরকারি বৈঠকগুলোতে দেখা যায়, সবার সামনে একটা কম্পিউটার রয়েছে। তারা মিটিংয়ে বসে কম্পিউটার দিয়ে কি করেন তা আমার মতো নাদান বান্দার মাথায় আজও ঢুকেনি। টেলিভিশনে যখন ওসব দৃশ্য দেখি তখন নিজের অজান্তে মনে মনে হাসি। উন্নত দেশের পেপার লেস অনেক অফিসে গিয়েছি— বৈঠক করেছি কিন্তু বাংলাদেশের মতো হাস্যকর ঘটনা কোথাও দেখিনি। এখানকার লোকেরা চিন্তা-চেতনায় পুরোই এনালগ। কিন্তু পোশাক আশাকে ডিজিটাল হওয়ার চেষ্টা করছে। হাতে ফোরজি মোবাইল বা আইপ্যাড, ডিজিটাল ঘড়ি, কানে ব্লুটুথ স্পিকার এবং মুখে ভাঙা ভাঙা ইংরেজির বোল ফুটিয়েই লোকজন চিৎকার শুরু করে এই বলে যে আমি ডিজিটাল হয়ে গেছি।

একটি দেশকে প্রযুক্তির পথে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সবার আগে দরকার মুক্ত, স্বাধীন এবং উদার একটি আধুনিক মন। গণতান্ত্রিক পরিবেশ, সুশাসন এবং রাষ্ট্র কর্তৃক নাগরিক অধিকারসমূহের বাস্তবায়ন, সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা এবং ন্যায় বিচারের সংস্কৃতি গড়ে না ওঠা পর্যন্ত কোনো দেশের নাগরিকরা আধুনিক মনের অধিকারী হয় না। আধুনিক মনের মানুষের মধ্যে যাদের রয়েছে আধুনিক শিক্ষা, উদ্ভাবনী মন এবং উঁচু স্তরের মেধা কেবল তারাই প্রযুক্তির পথের যাত্রী হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। অন্যদিকে দীর্ঘ সময় ধরে প্রযুক্তির পথে বিচরণ করার পর তৈরি হয় দক্ষ প্রযুক্তিবিদ। আমাদের প্রতিবেশী ভারত গত ২৫ বছর ধরে লাখ লাখ দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রযুক্তিবিদ তৈরি করার পরও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রযুক্তির ব্যবহার যতটা না বিস্তৃত করেছে আমরা গত সাত বছরে কোনো কিছু না থাকা সত্ত্বেও বিস্তৃতি ঘটানোর চেষ্টা করেছি অনেক অনেক বেশি যা প্রকারান্তে আমাদের জন্য ভয়ঙ্কর বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমরা প্রযুক্তির ভালো দিকসমূহের সুফল না পেলেও মন্দ দিকগুলো দ্বারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এনালগ মস্তিষ্কের ডিজিটাল দেহের কারণে সামাজিক অবক্ষয়, নৈতিক অধঃপতন এবং অপরাধসমূহ মারাত্মক আকারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজকের সমাজের পরকীয়া, বিবাহ বিচ্ছেদ, চুরি, ডাকাতি, গুম, হত্যা, মারামারিসহ অন্যান্য সাইবার অপরাধের কারণে আমরা অধঃপতনের প্রান্ত সীমানায় পৌঁছে গেছি। ফেসবুক, ভাইবার, স্কাইপে, ট্যাংগো, হোয়াটস আপ, ক্লাউড ইত্যাদি প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেসব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে তার কাছে নিরীহ ব্যক্তি তো দূরের কথা রাষ্ট্রও অসহায়বোধ করছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকার না পারছে অপরাধীদের শনাক্ত করতে আর না পারছে প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ অথবা বন্ধ করতে।

প্রকৃতির কতগুলো অমোঘ নিয়ম রয়েছে। মিষ্টি ফলে পোকার আক্রমণ বেশি হয়। অসহায় সুন্দরী নারীরা লোভী পুরুষের লালসার শিকার হন এবং দুর্বল ধনশালীরা শক্তিমানদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। অন্যদিকে যে মানুষ তার যে জিনিসটি নিয়ে বড়াই করেন বা গর্ব অনুভব করেন লোকটির শত্রুরা সেই জিনিসটি ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন। বর্তমান সরকার গত সাত বছর ধরে বুক ফুলিয়ে প্রচার করছে যে, দেশ উন্নয়নের পথে এগুচ্ছে— দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভের পাহাড় জমে গেছে এবং নগদ অর্থের জোগান বেড়ে গেছে অস্বাভাবিকভাবে।

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বেড়ে গেছে— এবং শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও রপ্তানি আয় বেড়ে গেছে। সরকার যেসব বিষয়কে তাদের সফলতা বলে প্রচার করছে সেসব বিষয়ে সেইভ গার্ড তৈরি করার প্রয়োজন অনুভব করেনি— বা তা করার মতো বুদ্ধিশুদ্ধি জোগাড় করেনি। সরকার যদি নিজেদের কঠোর পরিশ্রম এবং পরিকল্পনার মাধ্যমে তাদের সফলতাগুলো অর্জন করত তাহলে সেগুলোর রক্ষা কিংবা প্রতিরক্ষার ভেদবুদ্ধিও তাদের কাছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ধরা দিত। সময় ও সুযোগের কারণে অনেকে যেমন অনেক কিছু পায় তেমনি সরকারও তার সফলতা পেয়েছে পরিস্থিতির কল্যাণে। সরকারবিরোধীরা তাই ঠাট্টা করে বলেন, খায়দায় চিকন আলী, মোটা হয় রমজান।

সরকার তার সফলতাকে রক্ষা করার জন্য দুর্ভেদ্য দুর্গ হিসেবে বিবেচনা করেছে সীমিত গণতন্ত্র, নিয়ন্ত্রিত বাক স্বাধীনতা এবং বিরোধী দলের বিনাশ সাধন। গত ৪/৫ বছর ধরে সরকার তাদের ক্ষমতা রক্ষার দুর্গ যা তারা তাদের সফলতা রক্ষার দুর্গ বলে প্রচার চালাচ্ছে সেগুলো করতে গিয়ে এতটাই ব্যস্ত সময় পার করেছে যে, একবার ভাবার কিংবা দেখার সময় পায়নি কখন কীভাবে এবং কারা তাদের সফলতাগুলোতে পোকা ধরিয়ে দিল?

প্রথমে শেয়ার মার্কেট লুট, তারপর সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকসমূহের অর্থ লুট এবং সবশেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থ লুটের মাধ্যমে দেশের পুরো অর্থনীতিকে এবং উন্নয়নকে যারা সর্বনাশ করে ছাড়ল সরকার তাদের আজ অবধি চিনতে পারল না। বরং এমন সব সিদ্ধান্ত নিলো যাতে সব কেলেঙ্কারির দায় তাদের ঘাড়ে এসে চাপলো। উদাহরণ হিসেবে বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ব্যাংক কেলেঙ্কারির ব্যাপারে সরকার গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ পর্যালোচনা করলেই তাদের নির্বুদ্ধিতার নমুনাসমূহ পরিষ্কার হয়ে যাবে।

সরকারি ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে কাজ চালানোর জন্য দুটি অনুষঙ্গ থাকে। একটি হলো নিয়মিত প্রশাসন এবং অন্যটি হলো বোর্ড। ব্যাংকগুলোর বোর্ড সব সময় সরকার মনোনীত ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত হয়। তেমনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বোর্ড ছাড়াও গভর্নর পদটিতে সরকার মনোনীত ব্যক্তি নিয়োগ লাভ করে। ইতিপূর্বে সোনালী এবং বেসিক ব্যাংকের কেলেঙ্কারি ধরার পর সরকার ব্যাংকগুলোর প্রশাসনিক কাঠামোকে বিচারের আওতায় না এনে তড়িঘড়ি করে বোর্ড ভেঙে দিল। এতে প্রমাণ হলো, সরকার মনোনীত ব্যাংক পরিচালক এবং চেয়ারম্যানরাই সব অপকর্মের হোতা। প্রায় একই ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকা লোপাট হওয়ার বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডে দুজন নতুন পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ লেখা যখন লিখছি তখন খবর এলো যে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে গভর্নর পদত্যাগ করেছেন। অর্থাৎ অর্থ লোপাটের দায়-দায়িত্ব সরকার নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিল— যা আগামী দিনে তাদের দিকে কতটা ভয়ঙ্করভাবে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে তা হয়তো তারা কল্পনাও করতে পারছে না।

গত সাত বছরে বিপুল অঙ্কের টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। কেউ কেউ আবার কোনো প্রবাসীকে ডামি বিনিয়োগকারী বানিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশে ফেরত এনেছে। ফলে দেশটি এখন মুদ্রা পাচারকারী, ভুয়া ব্যবসায়ী এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্রের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। নামবর্ণহীন অখ্যাত ব্যক্তিবর্গ হাজার হাজার বিঘা আবাদি জমি, পাহাড়-পর্বত এবং জলাভূমি কিনে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ভূমিহীন বানিয়ে রাজধানীসহ বড় বড় শহরে ভাসমান জনগোষ্ঠী হিসেবে পুশইন করাচ্ছে। হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, ডেভেলপার কোম্পানি, বিদ্যুৎ খাত, ব্যাংক-বীমা, সরকারি বন্ড, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং রিয়েল এস্টেট ব্যবসাসমূহে অখ্যাত, নাম না জানা কিংবা শ্যাডো মালিকানার আড়ালে লুটেরাদের লুটের টাকা সিন্ডিকেট আকারে ঢুকে পড়েছে। গত ২/৩ বছরে সিন্ডিকেটটি এত শক্তিশালী হয়ে পড়েছে যা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সরকারের আছে কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ বেড়েই যাচ্ছে।

হবিগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, সিলেট, মৌলভীবাজার, টেকনাফ, কক্সবাজার, কুয়াকাটা, গাজীপুর, ময়মনসিংহ প্রভৃতি এলাকায় গত ৩/৪ বছরে ৭/৮ লাখ কোটি টাকার জমি জিরেতের মালিকানা হস্তান্তর হয়েছে। অনেক জায়গায় গড়ে উঠেছে হাজার কোটি টাকার রিসোর্ট নামের বিনোদন কেন্দ্র। এসব কেন্দ্রে নিয়মিত উল্লেখিত সিন্ডিকেটটি মিলিত হয়। তারা হেলিকপ্টারে যাতায়াত করে এবং অতি গোপনে লোকচক্ষুর আড়ালে ওইসব স্থানে নিয়মিত বৈঠক করে। পত্রিকা মারফত জানতে পারলাম প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা পাচারের ঘটনাটি সিরিয়াসলি নিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্ধত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নাকি প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তাকে গোয়েন্দা নজরদারিতে আনা হয়েছে। অন্যদিকে র‍্যাবসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে ঘটনার ক্লু খুঁজে বের করার জন্য। তারা হবিগঞ্জের একটি রিসোর্টে গত ফেব্রুয়ারি মাসের ১৮, ১৯ এবং ২০ তারিখে কিছু বিতর্কিত ব্যক্তি, সরকারের অত্যন্ত স্পর্শকাতর অফিসসমূহের প্রভাবশালী কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের গমনের বিষয়ে খোঁজখবর করছেন।

আমরা যারা দিন এনে দিন খাওয়ার আমজনতা তারা যেমন লুটেরাদের দুর্বৃত্তায়নের নিত্যনতুন কৌশল বুঝি না, তেমনি বুঝি না কি ডিজিটাল কৌশল ব্যবহার করে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকা লোপাট করে নেওয়া হলো! আমরা শুধু শান্তি চাই আর চাই আমাদের দেশের মান মর্যাদা যেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভূলুণ্ঠিত না হয়। আমাদের সোনার ছেলেদের রক্তপানি করা বৈদেশিক মুদ্রা, শ্রমিকের ঘাম ও রক্তের রপ্তানি আয় এবং খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের সঞ্চয় যেন কোনো দূরাচার পাপিষ্ঠ লুট করতে না পারে এতটুকু গ্যারান্টি রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে পারলেই আমরা সুখী হব। রাষ্ট্রের কাছে আমরা কোনো ভিক্ষা চাই না— শুধু কুত্তাগুলো সামলানোর দাবি জানাই, যারা আমাদের সবকিছু লুট করে নিয়ে গেছে।

লেখক : কলামিস্ট।



মন্তব্য চালু নেই