দেশ ছাড়ছেন সৈয়দ আশরাফ!

এবার কে বা কারা?

মন্ত্রিপরিষদের বহুলালোচিত রদবদল তবে কী শুরু হয়ে গেলো? অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের একটি বক্তব্যকে পরিবর্তনের সেই ইঙ্গিতবাহী বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

অর্থমন্ত্রী এমএ মুহিত শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টায় সিলেটের কাজীরবাজার ব্রিজ পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে অব্যাহতি দেয়া হচ্ছে, বিষয়টি আগে থেকেই আমরা ৬-৭ জন জানতাম।’

বৃহস্পতিবার দলের সাধারণ সম্পাদক ও সবচেয়ে আস্থাবান লোক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুপুরে এ নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

সৈয়দ আশরাফকে স্থানীয় সরকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেয়ায় বেশ অবাক বনে যান আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তবে অর্থমন্ত্রীর কথা থেকে মনে হয় বিষয়টি পরিকল্পিত।

বৃহস্পতিবার এ নিয়ে কেউ কথা না বললেও শুক্রবার মুখ খোলেন সরকারের গুরুত্বপুর্ণ দুই মন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং ওবায়দুল কাদের।

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘দলের কাজে আরো বেশি করে সময় দেয়ার জন্যই সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে দপ্তরবিহীন করা হয়েছে। হয়তো তিনি (প্রধানমন্ত্রী) মনে করেছেন দলের কাজে তাকে আরো বেশি সময় দেয়া প্রয়োজন। সেটা করতেই তিনি তাকে (সৈয়দ আশরাফ) সেই সুযোগ করে দিয়েছেন।’

ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘প্রত্যেক দেশেই সরকার প্রধান থাকেন, আমাদের দেশেও আছেন। তিনি প্রয়োজন মনে করলে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভূক্ত করেন। আবার প্রয়োজন মনে না করলে সরিয়েও নেন। এটা প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। এখানে আমাদের কিছুই করার নেই।’

আর অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে অব্যাহতি দেয়া হচ্ছে, বিষয়টি আগে থেকেই আমরা ৬-৭ জন জানতাম। কিন্তু আর কাউকে অব্যাহতি দেয়া হবে কি না তা বলা মুশকিল।’

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম একজন দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হিসেবেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করবেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে যখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয় তখনই একটি প্রস্তাব দিয়ে রাখা হয়েছিল যে, তিনি মন্ত্রী থাকবেন। কিন্তু তার কোনো দপ্তর থাকবে না। প্রধানমন্ত্রী এতোদিন পর সেই প্রস্তাব কার্যকর করলেন।’

আর কাউকে অব্যাহতি দেয়া হচ্ছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী হাত দিয়েছেন। দেখা যাক কী হয়। আই হ্যাভ নো আইডিয়া। একটু রিকাস্টিং হতে পারে।’

সুতরাং অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে পরিষ্কার, সামনে আরো চমক অপেক্ষা করছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কাদের নিয়ে সেই চমক?

আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ দুপুরে কুষ্টিয়া শহরে নিজের বাসায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘দল এবং মন্ত্রিপরিষদ_ দুটি আলাদা বিষয়। প্রধানমন্ত্রী দেশ পরিচালনা করেন। … প্রধানমন্ত্রী নিজেই জানেন কখন কাকে কীভাবে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগানো যাবে।’
তবে রদবদলের বিষয়টি সাবধানে এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, ‘দপ্তর বণ্টনের বিষয়ে কোনো কথা বলার সুযোগ নেই।’

এদিকে গত তিন মাস ধরে দল ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে মন্ত্রিসভায় রদবদল নিয়ে কথা হচ্ছে। এ নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদনও প্রকাশিত হচ্ছে।

সৈয়দ আশরাফের অব্যহতি নিয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কাছে মন্ত্রিত্ব বড় কোনো ব্যাপার নয়। একজন আপাদমস্তক রাজনীতিক। তার কাছে মন্ত্রিত্বের পোর্টফোলিও বড় ব্যাপার নয়। তিনি যেখানেই থাকেন, পারিবারিক ঐতিহ্য ও জাতীয় চার নেতার একজনের সন্তান হিসেবে নিজস্ব মেধা ও মননে একজন সৎ রাজনীতিবিদ হিসেবে ভূমিকা রাখবেন।’

তিনি বলেন, ‘মন্ত্রিসভায় কে কি পোর্টফোলিও পাবেন, তা একেবারেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এখতিয়ার। দেশ, জাতি, দল ও গণতন্ত্রের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশরাফকে সরিয়েছেন। এটা সম্পূর্ণ প্রধানমন্ত্রীর ব্যাপার।’

যোগাযোগ করা হলে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, ‘মন্ত্রিসভার রদবদল এটা আসলে স্বাভাবিক নিয়ম বা প্রক্রিয়া। সংসদীয় গণতন্ত্রে সিস্টেমটাই এরকম। বাজেটের পর সরকার সাধারণত মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের রদবদল করে থাকেন। এটা নিয়ে বেশি চিন্তার কারণ নেই। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।’

বাদ যেতে পারেন যারা
বর্তমান মন্ত্রিসভা থেকে যারা ঝরে পড়তে পারেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ত্রাণমন্ত্রী ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এবং খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম।

অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় মায়াকে বেকসুর খালাস দিয়ে ঘোষিত হাইকোর্টের রায় বাতিল করে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়েছে। রায়ে মায়ার আপিল হাইকোর্টে পুনরায় শুনানি করে নিষ্পত্তির আদেশ দেয়া হয়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘এ অবস্থায় সংবিধান অনুযায়ী মায়ার সংসদ সদস্য পদ থাকা উচিৎ নয়।’

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিকও অভিমত দিয়েছেন, ‘মন্ত্রিসভায় থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন মায়া। তার পদত্যাগ করা উচিৎ।’

মায়া কোন ক্ষমতাবলে ত্রাণমন্ত্রী পদে বহাল আছেন তা জানতে চেয়ে গত মঙ্গলবার সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইউনুছ আলী আকন্দ একটি রিটও করেছেন।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ১৩ জুন রাজধানীর সূত্রাপুর থানায় মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে ৬ কোটির টাকার বেশি অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুদক। পরে ২০০৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বিচারিক আদালত মায়াকে দোষী সাব্যস্ত করে ১৩ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন।

আর কামরুলের বিরুদ্ধে ব্রাজিল থেকে পোকায় খাওয়া নিম্নমানের গম কেনার অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে মিডিয়ায় ব্যাপক লেখালেখি হচ্ছে। বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় সরকারের ভাবমূর্তির জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ব্রাজিল থেকে আমদানি করা দুই লাখ টন গমের কার্যাদেশ পায় ইমপেক্স ইন্টারন্যাশনাল এবং ওলাম ইন্টারন্যাশনাল নামের দুটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান। এই কোম্পানি দুটির সঙ্গে সরকারের উপরের মহলের ঘনিষ্ঠতা আছে বলে জানা গেছে।

ব্রাজিল থেকে আমদানিকৃত গম দিয়ে পুলিশ বাহিনীর রেশন দিতে যাওয়ার ফলে ঘটে বিপত্তি। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয় প্রধানমন্ত্রীকে। তিনি খাদ্য সচিবকে তলব করলে শুরু হয় তোলপাড়। এরপরই ব্রাজির থেকে গম আমদানির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।

এর আগে হজ ও তাবলিগ জামায়াত নিয়ে কটূক্তি করার দায়ে মন্ত্রিত্ব হারান আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। কিন্তু তার মন্ত্রণালয়টি এখনো কাউকে দেয়া হয়নি।

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে নিয়েও বিস্তর সমালোচনা হচ্ছে। তবে এ যাত্রায় তিনি পার পেয়ে যাবেন বলে ধারণা করছেন তার ঘনিষ্ঠজনরা।

ঢুকতে পারেন যারা
মন্ত্রিসভার আসন্ন রদলে যারা নতুন করে যুক্ত হতে পারেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ড. দীপু মনি, ড. হাছান মাহমুদ, ড. আব্দুর রাজ্জাক ও খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। দলের আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিমও এ তালিকায় যুক্ত হতে পারেন। ডা. দীপু মনি, ড. হাছান মাহমুদ, ড. আব্দুর রাজ্জাক আগের সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় সরকার গঠনের পর তাদের মন্ত্রিসভার বাইরে রাখা হয়। লতিফ সিদ্দিকী বাদ যাওয়ায় আব্দুর রাজ্জাকের সম্ভাবনা উজ্জল হয়ে উঠেছে। গত মেয়র নির্বাচনে তার ভূমিকায় প্রধানমন্ত্রী খুশি বলেও জানা গেছে।

তবে কারা মন্ত্রিসভায় যুক্ত হবেন, কারা বাদ পড়বেন- এটা প্রধানমন্ত্রী নিজেই জানেন। এ ব্যাপারে তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এটা একমাত্র তারই এখতিয়ার।

দেশ ছাড়ছেন সৈয়দ আশরাফ!
দপ্তর হারানোর পর এবার দেশান্তরী হচ্ছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। দল ও দলের শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর অভিমান করে তিনি ১৫ জুলাই লন্ডনে পাড়ি জমাচ্ছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। এ নিয়ে দলেও বেশ কানাঘুষা শুরু হয়েছে। আশরাফও শেষ পর্যন্ত সোহেল তাজের পথেই হাঁটবেন কিনা এমন কথাও বলছেন কেউ কেউ। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সৈয়দ আশরাফ রাজনীতিকে বিদায় জানিয়ে লন্ডনে স্থায়ী হতে পারেন বলেও জানিয়েছেন তার ঘনিষ্ঠজনরা।

সৈয়দ আশরাফের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, আগামী ১৫ জুলাই তিনি লন্ডন যাচ্ছেন। তবে সহসাই তার ফেরার সম্ভাবনা কম। অপমান সহ্য করে দলে কিংবা সরকারে থাকতে চান না তিনি। যে কারণে সোহেল তাজের মতো বিদেশেই স্থায়ী হবেন তিনি। সোহেল তাজকেও দপ্তরবিহীন করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি কাজ না করে বসে বসে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী থাকতে চাননি। সোহেল তাজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মন্ত্রীর সম্মানীসহ সব ধরনের আর্থিক সুবিধা মাস শেষে পৌঁছে গেলেও তিনি তা উত্তোলন করেননি। সোহেল তাজ মনে করেন, কাজ না করে সম্মানী নেয়া উচিত নয়। তিনি যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সৈয়দ আশরাফও একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কারণ দুজন কাছাকাছি মানসিকতার মানুষ। দুজনের পারিবারিক ঐতিহ্যও কাছাকাছি। দুজনের পিতাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজনীতি করেছেন। দেশ স্বাধীন করার পেছনে তাদের পিতাদের অবিস্মরণীয় অবদান রয়েছে।
১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফ। আর সোহেল তাজ দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে। মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেয়ার সময় সোহেল তাজকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছিলেন সৈয়দ আশরাফ। মন্ত্রিসভায় থাকার জন্য সোহেল তাজের কাছে প্রধানমন্ত্রীর বার্তা নিয়ে বারবার গিয়েছিলেন তিনি। তার অনুরোধেই সোহেল একবার যুক্তরাষ্ট্রে চলে গিয়েও আবার ফিরে আসেন।
এক মন্ত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মন্ত্রিসভায় অনেক বিতর্কিত সদস্য রয়েছেন। তাদের বাদ না দিয়ে এমন একজনকে বাদ দেয়া হলো যিনি সততার মানদন্ডে অনেক ওপরে অবস্থান করছেন। তার সততা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। শুধু সততা নয়, তিনি চৌকসও বটে। দাপ্তরিক কাজে অল্প সময় দিলেও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করতেন না। আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তাকে এভাবে দূরে ঠেলা ঠিক হয়নি।

আওয়ামী লীগ সূত্র জানিয়েছে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে তাকে সরানোয় দলের সিনিয়র অনেক নেতা (মন্ত্রী) খুশি হয়েছেন। মন্ত্রণালয়ে অনুপস্থিত থাকা এবং দলীয় কর্মকান্ডে সক্রিয় না থাকায় সিনিয়র ওইসব নেতা দীর্ঘদিন থেকে তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে ওইসব নেতা প্রধানমন্ত্রীর কান ভারি করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাদের কথায় কান দিতেন না। সৈয়দ আশরাফও ওইসব নেতার কর্মকান্ডে অখুশি ছিলেন। সরকার এবং দলের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে বারবার তার দ্বিমত হয়েছে। এ কারণে কয়েক দফা তিনি ইস্তফাও দিতে চেয়েছেন। কিন্তু কোনো বারই তার ইস্তফাপত্র গ্রহণ করেননি দলীয় প্রধান। দলের ওইসব সিনিয়র নেতার বিভিন্ন ধরনের খায়েশ এবং বিতর্কিত কর্মকান্ডের কারণেই তিনি দলীয় এবং মন্ত্রণালয়ে সক্রিয় ছিলেন না।

তাকে দপ্তর থেকে সরানোর বিষয়ে দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, দলে আরো বেশি সময় দেয়ার জন্যই আশরাফুল ইসলামকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে সরানো হয়েছে। সাধারণ সম্পাদককে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করায় দলেও কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে না।

জানা গেছে, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভরাডুবির দায় মাথায় নিয়ে ২০১৩ সালের ১৪ জুলাই পদত্যাগপত্র জমা দেন দলীয় প্রধানের কাছে। ওই সময় তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাকে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের অনুরোধ জানালেও তিনি তা করেননি। তখন তিনি তার ঘনিষ্ঠজনদের বলেন, দলের ভরাডুবির জন্য যদিও এককভাবে কেউ দায়ী নয় কিন্তু কাউকে না কাউকে এর দায় নিতে হবে। আর দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তার ওপরই এ দায় বর্তায়। তাই তিনি পদত্যাগ করেছেন।
ওই বছরের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনেই পরাজিত হয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল সমর্থিত প্রার্থীরা। হারের অন্যতম কারণ হিসেবে দলীয় কোন্দল এবং ক্ষমতাবানদের সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের দ্বন্দ্ব উঠে আসে।
এরপর ওই বছরের ৬ জুলাই গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে প্রচারণার পরও হেরে যায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী। এ জন্যও অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে দায়ী করা হয়।

পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনেই দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা ছিল না। বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী তার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তার পদত্যাগেরও দাবি ওঠে। এসব দাবি এবং ওই সময় দলীয় নেতাদের ষড়যন্ত্রের কারণে তিনি পদত্যাগপত্র জমা দেন।

একই বছর চট্টগ্রাম মহানগরের কাউন্সিলের পর কমিটি গঠন নিয়ে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের সঙ্গে সৈয়দ আশরাফের মতবিরোধ দেখা দেয়। দলীয় এক বৈঠকে চট্টগ্রামের সাংগঠনিক সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কমিটি নির্ধারণের দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে। তিনি পর্যবেক্ষণ করে চট্টগ্রামের নেতা এবিএম মহিউদ্দিনের কারণে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না বলে মত দেন। পাশাপাশি তাকে বাদ রেখে কমিটি করার সুপারিশ করেন তিনি। কিন্তু তার মতকে উপেক্ষা করে এবিএম মহিউদ্দিনকে সভাপতি করায় তিনি দলের হাইকমান্ডের ওপর নাখোশ হন। এরপর বিভিন্ন জেলার কমিটি এবং নির্বাচনে প্রার্থী দেয়া নিয়ে তার সঙ্গে দলের সিনিয়র নেতাদের মতবিরোধ হয়। এসব কারণেই তিনি দলীয় কোনো কর্মকান্ডে উপস্থিত থাকতেন না।

এ ব্যাপারে দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, মন্ত্রিসভায় কে-কি পোর্টফোলিও পাবেন, তা একেবারেই প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। আর এ নিয়ে সরকার গেল গেল বলে চিৎকার করার কিছু নেই। এ ছাড়া সৈয়দ আশরাফ একজন আপাদমস্তক রাজনীতিক। তার কাছে মন্ত্রিত্বের পোর্টফোলিও বড় ব্যাপার নয়। তিনি যেখানেই থাকবেন সেখানেই পারিবারিক ঐতিহ্য এবং জাতীয় চার নেতার একজনের সন্তান হিসেবে নিজের মেধা ও মননে একজন সৎ রাজনীতিবিদ হিসেবে ভূমিকা রাখবেন।

প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগের ২০০৯ সালের ২৪ জুলাইয়ের সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এর আগে এক-এগারোর সময় ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন তিনি। শেখ হাসিনা মুক্তি আন্দোলন বেগবান করেন। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সঙ্গে মিলে দলকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করেন, দলকে সুসংগঠিত করেন। সর্বোপরি শেখ হাসিনাকে জেল থেকে মুক্ত করতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে নজরকাড়া ভূমিকা পালন করে নিরঙ্কুুশ বিজয় অর্জনে অবদান রাখেন। এরপর ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর দলের সর্বশেষ সম্মেলনেও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সৈয়দ আশরাফ।

মন্ত্রিসভায় আরো পরিবর্তনের ইঙ্গিত
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দপ্তর হারানোর পর মন্ত্রিসভায় আরো পরিবর্তন আসছে বলে ইঙ্গিত মিলেছে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কথায়।
শুক্রবার সিলেটের কাজীরবাজারে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ক্ষমতাসীন দলের এই বর্ষীয়ান নেতা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যখন হাত দিয়েছেন, দেখা যাক কি হয়। আই হ্যাভ নো আইডিয়া। একটু রিকাস্টিং হবে। কিন্তু কীভাবে হবে তা বলা মুশকিল।’ মুহিত বলেন, সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেয়ার বিষয়টি তিনি এবং কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা আগে থেকেই জানতেন। আশরাফ সাহেবের যে পোর্টফোলিও পরিবর্তন হবে এটা অবশ্য তারা কয়েকজন জানতেন।
দুদিন ধরে চলা গুঞ্জনের অবসান ঘটিয়ে সৈয়দ আশরাফকে স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করা হয়। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে দেয়া হয় স্থানীয় সরকারের মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।
গতকাল এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মুহিত বলেন, ‘মন্ত্রিপরিষদের পরিবর্তন_ এটা প্রাইম মিনিস্টারের এখতিয়ার। প্রাইম মিনিস্টার করেছেন, দ্যাটস ইট।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, সৈয়দ আশরাফ যখন সাধারণ সম্পাদক হন তখনই একটি প্রস্তাব ছিল তাকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করার। প্রধানমন্ত্রী সেই সিদ্ধান্তই হয়তো এতদিন পর বাস্তবায়ন করেছেন। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর শেখ হাসিনাসহ কেন্দ্রীয় নেতারা কারাবন্দি হলে দলে সাধারণ সম্পাদকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের ভার পান বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী সৈয়দ নজরুলের ছেলে সৈয়দ আশরাফ। পরে ২০০৯ সালে দলের সম্মেলনে তিনি ওই পদে নির্বাচিত হন।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনার সরকারে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন আশরাফ। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ আবারো সরকারে এলে দলের সাধারণ সম্পাদককে একই দপ্তরে রাখেন শেখ হাসিনা।
গত মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরে প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রিসভায় তিন দফা বড় রদবদল আনলেও এবার দলে তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত হিসেবে পরিচিত আশরাফের বাদ পড়ার মধ্য দিয়েই কার্যত প্রথম পরিবর্তন এলো।
এর আগে বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বাদ পড়েন। তবে তার মন্ত্রণালয় কাউকে দেয়া হয়নি।
ইতোমধ্যে সরকারের দেড় বছর পার হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শিগগিরই মন্ত্রিসভায় রদবদল আনতে পারেন বলে গত কিছুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল, যদিও মুহিতের আগে আওয়ামী লীগের আর কেউ গণমাধ্যমের সামনে সে ইঙ্গিত স্পষ্ট করেননি।
সৈয়দ আশরাফকে হঠাৎ দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করার পর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা বৃহস্পতিবার প্রকাশ্যে মুখ না খুললেও শুক্রবার তারা সাংবাদিকদের সামনে কথা বলতে শুরু করেছেন। অবশ্য সবাই বলছেন, কে কোথায় মন্ত্রী থাকবেন, তা একান্তই প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার।
সাংবাদিকদের প্রশ্নে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শুক্রবার সকালে বলেন, ‘হয়তো তিনি (প্রধানমন্ত্রী) মনে করেছেন, সে (সৈয়দ আশরাফ) অতিরিক্ত ভার বহন করছেন। দলে আরো ভালো করে বেশি সময় দেয়ার জন্য এটা (দপ্তরবিহীন করা) হতে পারে।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ দুপুরে কুষ্টিয়া শহরে নিজের বাসায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘দল এবং মন্ত্রিপরিষদ_ দুটি আলাদা বিষয়। প্রধানমন্ত্রী দেশ পরিচালনা করেন। … প্রধানমন্ত্রী নিজেই জানেন কখন কাকে কীভাবে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগানো যাবে।’
তবে রদবদলের বিষয়টি সাবধানে এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, ‘দপ্তর বণ্টনের বিষয়ে কোনো কথা বলার সুযোগ নেই।’



মন্তব্য চালু নেই