এমন সাকিবকেই দেখতে চায় বাংলাদেশ

তার মেধা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন না কেউ। অতি বড় সমালোচকও তার সামর্থ্য নিয়েও সংশয় দেখান না। সবার জানা, সাকিব আল হাসান বল ও ব্যাট হাতে অনেক বড় পারফরমার। সবাই মানেন, নিজের দিনে অনেক বড় কিছু করার সামর্থ্য আছে তার।

যেমন উইকেটেই খেলা হোক। প্রতিপক্ষ দলে যত বড় মাপের বোলারই থাকুন না কেন, সাকিব সামর্থ্যের পুরোটা উপহার দেয়া মানেই বড়সড় কিছু। তার সামর্থ্যের সেরাটার প্রয়োগ ঘটার অর্থ বল ও ব্যাট হাতে মাঠ মাতানো। কিছু একটা ঘটে যাওয়া। তার প্রমাণ আছে ভুরি ভুরি।

এই তো মাস দুয়েক আগে ওয়েলিংটনে দলের বিপদে কী ব্যাটিংটাই না করেছেন সাকিব! যে নিউজিল্যান্ডের প্রচণ্ড বাতাস- কনকনে ঠাণ্ডা আর ফাস্ট বোলারদের দাপুটে বোলিংয়ে অনেক বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানের বুক কাপে, সেখানে সাকিবের বুক চিতানো ব্যাটিংয়ে উল্টো নাভিশ্বাস উঠেছে কিউই ফাস্ট বোলারদের।

সমস্যা একটাই: অতি মাত্রায় হাত খুলে খেলার প্রবণতা। আর সব সময় একই অ্যাপ্রোচ-অ্যাপ্লিকেশন। উইকেট যত কঠিনই হোক না কেন, ফাস্ট বোলিং ফ্রেন্ডলি কিংবা স্পিনারদের স্বর্গ- যাই হোক না কেন, সাকিব উইকেটে গিয়ে তার মতোই খেলার চেষ্টা করেন।

দলের অবস্থা যত খারাপই থাকুক- সাকিবের ব্যাটিং শৈলি, অ্যাপ্রোচ-অ্যাপ্লিকেশন সব সময় এক। যথারীতি ইতিবাচক। অনেক বেশি আক্রমণাত্মক। পি সারায় গতকাল পড়ন্ত বিকেলে দল যখন মাত্র ৭ বলে ৭ রানে তিন উইকেট হারিয়ে ধুঁকছিল, ঠিক তখন ব্যাটিংয়ে নেমে সেই চিরচেনা সাকিবের বলগাহীন ব্যাট চালনা!

উইকেটে গিয়েই এদিক-ওদিক ব্যাট ছোড়া। ডিপ মিড-উইকেট আর ফাইন লেগে ফিল্ডার ওৎ পেতে থাকা দেখেও হাওয়ায় ভাসিয়ে পুল খেলতে যাওয়া। ভাগ্যগুণে দুইবার ক্যাচ আউটের হাত থেকে বেঁচে আট বলে ১৮ রানের হার নামা ইনিংস খেলে সাজঘরে ফেরত আসা।

দ্বিতীয় দিন শেষ ১৫ মিনিট সাকিবের অমন ব্যাট ছোড়া দেখে আশাবাদী হওয়ার বদলে সংশয়ে পড়েন ভক্তরা। বলতে থাকেন, এভাবে খেললে কি আর হবে? এখন খেলতে হবে ঠাণ্ডা মাথায় ধৈর্য ধরে। লম্বা সময় ক্রিজে থেকে বড় ইনিংস গড়তে হবে। সাকিব নট আউট। সঙ্গে অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম।

আশাবাদি হবার সবচেয়ে বড় রসদ। এই সেদিন ওয়েলিংটনে শ্রীলঙ্কার চেয়ে ঢের শক্তিশালী, সমৃদ্ধ আর ধারালো বোলিংয়ের বিরুদ্ধে যে জুটির আছে রেকর্ড ৩৫৯ রান- তারা ক্রিজে। কিন্তু সাকিবের অতিমাত্রায় আত্রমণাত্মক মেজাজ আর হাত খুলে খেলা দেখে আশাবাদী ভক্তর সংখ্যা কমেই গেল। কিন্তু আজ সকাল থেকেই সাকিবের অন্যরূপ।

আগের দিন বিকেলের অসংযত সাকিব অনেকটাই সংযত। সংযমী। এলোমেলো ব্যাট ছোড়া আর নেই। যে বল যেভাবে যেখানে খেলা উচিত, সেখানে সেভাবেই খেলার চেষ্টা। এক রাতের ব্যবধানে তার ব্যাটিং অ্যাপ্রোচের বদল কতটা? একটা ছোট্ট পরিসংখ্যানেই মিলবে তার প্রমাণ।

আগের দিন মাত্র ৮ বলে ১৮ রান করার সাকিব আজ পঞ্চাশে পৌঁছতে খেললেন ৬৯ বল। মানে শুক্রবার সকালে ৩২ রান আসলো প্রায় দ্বিগুণ ৬১ বলে। শুধু পঞ্চাশে গিয়ে থেমে যাওয়া নয়। দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষে মাথা নিচু করে সাজঘরে ফেরা নয়।

সাকিব দেখালেন, একটু সংযত হয়ে বলের মেধা-গুণ বিচার করে ভালো বলকে সমীহ দেখিয়ে আর আলগা ডেলিভারিগুলোকে স্কোরিং শট হিসেবে বেছে নিতে পারলে আমি অনায়াসে শতরান করতে পারি। করলেনও তা-ই।
দলের প্রয়োজনে আরও একবার হাসলো ব্যাট।

চা বিরতির ঠিক বিশ মিনিট আগে পূর্ণ হলো ক্যারিয়ারের পাঁচ নম্বর আর শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে প্রথম শতক। ২৩৬ মিনিটে, ১৪৩ বলে নয় বাউন্ডারিতে তিন অঙ্কে পৌঁছে যাওয়া। চায়নাম্যান বোলার লক্ষ্মণ সান্দাকানকে ফাইন লেগে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে শতরান পূর্ণ করার পর একদমই ভাবলেশহীন।

আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠা, শূন্যে লাফিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়া কিছুই নেই। তার চেয়ে বরং সঙ্গী মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতের উচ্ছ্বাস ও আবেগটাই বেশি ছিল। তাইতো সেঞ্চুরি পূরণের পর সাকিবকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন অনুজপ্রতিম মোসাদ্দেক।
তারপর অবশ্য বেশিক্ষণ উইকেটে থাকতে পারেননি। সান্দাকানের বলে মিডঅনের মাথার ওপর দিয়ে হাঁকাতে গিয়ে মিডঅনেই ক্যাচ তুলে ফেরত আসা। চা বিরতির ১০ মিনিট আগে সাজঘরে ফেরত আসার আগে সাকিব শুধু শতরানই করলেন না। ষষ্ঠ ও সপ্তম উইকেটে একজোড়া বড় জুটির মূল রূপকারও হলেন।

সপ্তম উইকেটে অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের সাথে ৯২ রানের পার্টনারশিপে শ্রীলঙ্কার ৩৩৮ রানের কাছাকাছি চলে যাওয়া। আর সবশেষে অভিষেক হওয়া মোসাদ্দেকের সাথে অষ্টম উইকেটে ১৩১ রানের বড় জুুটি। একটা কঠিন সত্য আরও একবার হলো প্রতিষ্ঠিত; সাকিব দায়িত্ব নিয়ে খেললেই পারেন।

তার দায়িত্ব সচেতনতাই তার সাফল্যের মূল। টেকনিক শতভাগ পরিপাটি ও ব্যাকরণ সন্মত নয়। তাতে কী? জাভেদ মিয়াঁদাদের মতো বিশ্ববরেণ্য ব্যাটসম্যানের ব্যাটিং টেকনিক নিয়েও তো কত প্রশ্ন আছে। কিন্তু তাই বলে তার কার্যকারিতা নিয়ে তো আর কোনো প্রশ্ন নেই।

সাকিবের বেলায়ও তা-ই। তার আছে বুক ভরা সাহস। হাজারো প্রতিকূলতা তাকে দমাতে পারে না। ভয়-ডর নেই তার অভিধানে। প্রতিপক্ষকে শাসন করার মানসিকতাও আছে। খালি একটু বেশি শটস খেলার প্রবণতা। স্কোয়ার কাট, ফ্ল্যাশ আর পুল বেশি খেলা।

অতিমাত্রায় আত্রমণাত্মবক মানসিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই সাকিব ‘ট্রু চ্যাম্পিয়ন।’ যার প্রমাণ মিলল আজ কলম্বোর পি সারায়। সব সংশয় কাটিয়ে সাকিব একটু সংযত হয়ে খেললেন। আর তাতেই দেখা মিলল শতরানের। লঙ্কান বোলিং-ফিল্ডিং হলো হতোদ্যম। অাগের দিন শেষ বিকেলে অনিশ্চয়তার মেঘে ঢাকা পড়া বাংলাদেশের ভাগ্যাকাশে আবার দেখা মিলল সম্ভাবনার সূর্য। এমন সাকিবকেই যে সব সময় চায় বাংলাদেশ।



মন্তব্য চালু নেই