এলএন গ্যাসে কর অব্যাহতি মিলছে

তরলকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনায় কর অব্যাহতি দিতে যাচ্ছে সরকার। এরফলে বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিকে প্রদত্ত কর মওকুফ সুবিধার মতোই আর্থিক সুযোগ পাবে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে চুক্তিবদ্ধ সিঙ্গাপুরভিত্তিক অ্যাস্ট্রা অয়েল অ্যান্ড এক্সিলারেট কনসোর্টিয়াম।

গত সপ্তাহে এক জ্বালানি বিভাগে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে অর্থ বিভাগকে অনুরোধ করেছে জ্বালানি বিভাগ। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণকে এগিয়ে নিতেই এমন সিদ্ধান্ত বলে জানিয়েছেন জ্বালানি বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

গত বছর জুনে অনুস্বাক্ষরকালে সময় এক্সিলারেট টার্মিনাল স্থাপনের জন্য বিদেশ থেকে যন্ত্র আমদানির বিষয়ে কর ও ভ্যাট না দেয়ার শর্ত দেয়। পেট্রোবাংলা তাতে নীতিগত সম্মতিও দেয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে কোম্পানিটির সঙ্গে প্রকল্পের টার্মশিট চুক্তি করেছে পেট্রোবাংলা। তবে এখনো চূড়ান্ত চুক্তি সই হয়নি।

বিদ্যুৎখাতে বেসরকারি অংশগ্রহণ ও বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে ‘বেসরকারি খাত বিদ্যুৎ উৎপাদন নীতিমালা ১৯৯৬’ প্রণয়ন করে সরকার। ওই নীতিমালায় ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য আয়কর, কাস্টমস ও মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ইত্যাদি মওকুফসহ অন্যান্য আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করার কথা বলা হয়েছে। এর আওতায় ১৯৯৯ সাল থোকে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো বিশেষ সুবিধা ভোগ করে, যা ২০০৯ সালে কিছুটা রহিত করা হয়। তবে পরে আবারো সুযোগ পায় আইপিপি উদ্যোক্তারা।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ২০১১ সালের জুলাইয়ে জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী যেসব বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানি ২০১৩ সালের ১ জুলাইয়ের আগে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করেছে, সেগুলোর আয়ে শর্তসাপেক্ষে কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ৩ স্তরে দেয়া এই সুবিধা হলো বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু থেকে প্রথম ৫ বছরে শতভাগ কর অব্যাহতি, পরবর্তী ৩ বছর ৫০ শতাংশ এবং এর পরের দুই বছর ২৫ শতাংশ হারে আয়কর অব্যাহতি পাবে আইপিপি কেন্দ্রের মালিকেরা।

উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর জ্বালানি সঙ্কট মোকাবেলায় কক্সবাজারের মহেশখালীতে লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল তৈরির উদ্যোগ নেয়।

২০১১ সালে টার্মিনালের জন্য আগ্রহপত্র (ইওআই) চেয়ে বিঞ্জপ্তি দেয়া হয়। তখন ১০টি আন্তর্জাতিক কোম্পানি আগ্রহ দেখায়। এরমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ইউএস অ্যাস্ট্রা ওয়েল অ্যান্ড এক্সিলারেট এনার্জিসহ চারটি কোম্পানিকে প্রাথমিকভাবে বাছাই করে পেট্রোবাংলা। কিন্তু ওই মেয়াদে তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার।

২০১৪ জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ পুনরায় সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোর সংক্ষিপ্ত তালিকায় এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর গতবছরের ২৬ জুন অনুস্বাক্ষর ও এ বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি টার্ম শিট চুক্তি করে পেট্রোবাংলা। এখন সরকারি ক্রয় কমিটির অনুমোদনক্রমে এক্সিলারেটের সঙ্গে ১৫ বছরের জন্য টার্মিনাল ব্যবহারের চুক্তি (টিইউএ) স্বাক্ষরিত হবে ৷

আগামী মাসে মন্ত্রিসভা কমিটিতে এমন প্রস্তাব যেতে পারে বলে সূত্র জানিয়েছে। চূড়ান্ত চুক্তির ১৮ মাসের মধ্যে এক্সিলারেট টার্মিনাল নির্মাণ করবে। টার্মিনাল নির্মাণ শেষে ২০১৭ সালের শুরুর দিক থেকে গ্যাস সরবরাহ শুরু হবে। প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার ঘনমিটার এলএনজি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন টার্মিনালটি থেকে দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাবে।

অ্যাস্ট্রা অয়েলকে টার্মিনাল নির্মাণ ও অন্যান্য খরচ হিসেবে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের জন্য শূন্য দশমিক ৪৭ ডলার করে দিতে হবে পেট্রোবাংলাকে। টার্মিনালটি নির্মাণ করার জন্য কোম্পানিটি প্রায় ৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। ১৫ বছরে বিনিয়োগ ও লাভ তুলে নেবে এই কোম্পানি। এরপর তারা টার্মিনাল বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করবে। এলএনজি আমদানির জন্য ইতোমধ্যে কাতারের সঙ্গে দুই দফা সমঝোতা চুক্তি করেছে বাংলাদেশ।

মহেশখালীর গভীর সমুদ্রে স্থাপিত এ টার্মিনাল থেকে এলএনজিকে গ্যাসে রূপান্তর করে চট্টগ্রামে আনতে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) ৯১ কিলোমিটার সরবরাহ লাইন স্থাপন করবে। টার্মিনাল নির্মাণ শুরু হলে মহেশখালী থেকে আনোয়ারা পর্যন্ত পাইপ লাইন নির্মাণ কাজ শুরু করবে জিটিসিএল।

এ উদ্যোগটির পাশাপাশি জ্বালানি বিভাগ ভূমিবেষ্টিত (ল্যান্ড বেজড) আরও দুটি টার্মিনাল নির্মাণের কার্যক্রম শুরু করেছে। জ্বালানি সরবরাহ বিশেষ আইন-২০১০ এর আওতায় দরপত্র ছাড়াই এ দুই প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। এ বিষয়ে বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে দর কষাকষি করতে গত ৪ নভেম্বর জ্বালানি সচিবকে আহ্বায়ক করে নয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

টার্মিনাল দুটি মহেশখালী এবং পটুয়াখালীর পায়রা বন্দর এলাকায় নির্মাণ করা হবে। পরিকল্পনা অনুসারে প্রতিটি টার্মিনাল ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশন (পুনরায় গ্যাসে রূপান্তর) ক্ষমতার হবে। ভূমি বেষ্টিত এলএনজি টার্মিনালের প্রাক-সাম্ভাব্যতা যাচাইয়ে পরামর্শক নিয়োগে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহায়তা মিলবে। পায়রা বন্দর এলাকায় টার্মিনাল নির্মাণে ভূমি অধিগ্রহণে নৌ ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের সহায়তাও চেয়েছে জ্বালানি বিভাগ।

জানা গেছে, অনেক বিদেশি কোম্পানি টার্মিনাল নির্মাণে জ্বালানি বিভাগের কাছে আগ্রহ প্রকাশ করে। এরমধ্যে ভারতের রিলায়েন্সসহ চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের অনেক কোম্পানি রয়েছে।

অন্য দিকে বিদ্যুৎ বিভাগের পাওয়ার সেলও মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে একটি ভূমিবেষ্টিত এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। বছরে ৩৫ লাখ টন এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশনের ক্ষমতাসম্পন্ন টার্মিনাল নির্মাণে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। ১৫টি প্রতিষ্ঠান আগ্রহ দেখিয়েছে। এর মধ্য থেকে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত তালিকা করেছে পাওয়ার সেল। এগুলো হলো ভারতের সর্ববৃহৎ এলএনজি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান পেট্রোনেট এলএনজি, অ্যাংলো-ডাচ সুপার মেজর শেল, চীনা হুয়াংকিউ কনট্রাকটিং অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বেলজিয়ামের ট্র্যাক্টেবেল ইঞ্জিনিয়ারিং ও জাপানের মিত্সুই। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরাকরি পর্যায়েও এলএনজি আমদানির অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে ৷

সরকার আশা করছে, ২০১৭ সালের দিকে দেশে এলএনজির ব্যবহার শুরু হবে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এলএনজির কারণে গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। কারণ দেশীয় গ্যাসের চেয়ে এলএনজির সরবরাহ মূল্য বেশি হবে।

বর্তমানে দেশে গ্যাসের ইউনিট প্রতি গড় দাম দুই থেকে তিন ডলার। এলএজির ব্যবহার শুরু হলে এ মূল্য ৬ থেকে ৭ ডলার পড়বে বলে খাত সংশ্লিষ্টদের ধারণা। দেশের গ্যাস ও আমদানি করা এলএনজির দাম সমন্বয়ের জন্য বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন কাজ করছে।



মন্তব্য চালু নেই