‘এ রায় সভ্যতার পথে আরেক ধাপ’

একাত্তরের বদরপ্রধান জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ সর্বোচ্চ আদালতে বহাল থাকায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী, মুক্তিযোদ্ধা ও বিশিষ্টজনেরা।

তারা মনে করেন, ‘বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধপরাধী নেই’ বলে মুজাহিদ যে দাম্ভিকতা দেখিয়েছিলেন, এ রায়ের মধ্যে দিয়ে তার অবসান হল।

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ মঙ্গলবার এ মামলার চূড়ান্ত রায় দেয়। একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যায় ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফঁসির আদেশ এই রায়ে বহাল রাখা হয়।

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরীন আফরোজ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ‘পূর্ণতার দিকে’ অগ্রসর হওয়াকে বাংলাদেশের ‘সভ্যতার দিকে’ এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেন।

তিনি বলেন, “প্রতিটি রায়ের মাধ্যমে আমরা ধাপে ধাপে সভ্যতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।

এক প্রশ্নের জবাবে তুরীন আফরোজ বলেন, “আমাদের দেওয়া তথ্য-উপাত্ত ও সাক্ষীর মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালে ইতোমধ্যে আল বদর প্রধান হিসাবে মুজাহিদের ভূমিকা প্রমাণিত হয়েছে। তার যে জঘন্য নিষ্ঠুর ভূমিকা রয়েছে সেটি প্রমাণিত হয়েছে।

“শুধু সাক্ষীর মাধ্যমে নয়, আল বদরের বইয়ে তার (মুজাহিদের) যে ভাষণ রয়েছে, সব কিছুর ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনালে যেভাবে তিনি আল বদর কমান্ডার হিসাবে প্রমাণিত হয়েছেন, আজ তার ভূমিকা উচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল।”

প্রসিকিউশনের এ আইনজীবী বলেন, “বুদ্ধিজীবী হত্যার মতো জঘন্য অপরাধের বিচার এত দেরিতে হলেও তাতে আমরা খুশি।”

ট্রাইব্যুনালের আরেক প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সিমন বলেন, “জামায়াত ‍বুদ্ধিজীবীহত্যায় নিজেদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করত, নিজামীরা অস্বীকার করত। আজ প্রমাণিত হয়েছে বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে তারা সম্পূর্ণরূপে জড়িত। অর্থাৎ, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর হিসাবে তারা ১৯৭১ সালে কাজ করেছে।”

ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি হিসাবে মুজাহিদের ভূমিকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “ছাত্রসংঘই আল বদর তৈরি করেছে, নেতৃত্ব দিয়েছে। এই প্রশ্নের উত্তর বারবার ডিফেন্স দিতে পারেনি। আজ প্রমাণিত হয়েছে, এই বাহিনী তারাই তৈরি করেছে। আর ছাত্রসংঘ সভাপতি হিসাবে মুজাহিদ আল বদর প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।”

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে এই প্রসিকিউটর বলেন, “আমরা এই রায়ে খুশি। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে জাতি বেরিয়ে আসছে। অসম্পূর্ণ বিচারও আমরা সম্পূর্ণ করতে পারব।”

ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক মো. আবদুল হান্নান খান রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “আমাদের বুদ্ধিজীবী হত্যার উনি (মুজাহিদ) ষড়যন্ত্রকারী, এই হত্যার নীলনকশার দায়িত্ব তার ছিল, সেটা আমরা তদন্তে প্রমাণ করতে পেরেছি।

“….এই জাতিকে বুদ্ধিহীন মেধাশূন্য করার একটা বিশেষ পরিকল্পনা তাদের ছিল। এই রায়ের মাধ্যমে একটা ইতিহাসকে কলঙ্কমুক্ত করার প্রক্রিয়ার আমরা এগিয়ে গেলাম।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, “এই আল বদর কমান্ডার আবার বাংলাদেশের মন্ত্রী হয়েছিল, তার গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়েছিল।এটা আমাদের দুর্ভাগ্য।

“এই দুর্ভাগ্য নিয়ে আমরা বহু বছর অপেক্ষা করেছি, যেন তার রায় হয়। সেখানে মৃত্যুদণ্ড বহাল আছে, তাই আমরা আনন্দিত।”

মুজাহিদের নির্দেশে একাত্তরে সুরকার আলতাফ মাহমুদ, গেরিলা যোদ্ধা জহিরউদ্দিন জালাল ওরফে বিচ্ছু জালাল, শহীদজননী জাহানারা ইমামের ছেলে শাফি ইমাম রুমি, বদিউজ্জামান, আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল ও মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদসহ কয়েকজনকে ঢাকার নাখালপাড়ায় পুরনো এমপি হোস্টেলে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। বাকিদের হত্যা করা হলেও জালাল বেঁচে যান। এ মামলায় তিনিও সাক্ষ্য দিয়েছেন।

আপিলের রায়ের পর জালাল সাংবাদিকদের বলেন, “এই রায়ে আমি খুশি। রায় কার্যকর হলে যদি আমার সহযোদ্ধা বদি-রুমী-আজাদ ভাই, আলতাফ মাহমুদ ভাইয়ের আত্মা শান্তি পায় তাহলে আরও খুশি হব।”

এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “কুখ্যাত মুজাহিদ বলেছিল, বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নাই। তাদের জামায়াত শিবির বলেছিল, আমরা যুদ্ধাপরাধী না। আজ সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর তা তাদের মেনে নেয়া উচিত।

“….এই আল বদর যে ভিক্টোরি দেখিয়েছিল, আমরা রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা সেই ভিক্টরি ভ্যানিশ করে দিলাম। আর কোনোদিন তার আঙুল উঠবে না। জামায়াতে ইসলামী-যুদ্ধাপরাধী কেউ এই মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে আঙুল উঁচাতে পারবে না।”বিডিনিউজ২৪



মন্তব্য চালু নেই