ওষুধের বিকল্প যত চিকিৎসা পদ্ধতি

ওষুধের বিকল্প চিকিৎসাপদ্ধতি বলতে বোঝায় ওষুধের পরিপূরক চিকিৎসা পদ্ধতি। অর্থাৎ যে ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতিতে ওষুধের ব্যবহার না করে, বিকল্প পদ্ধতি বা সম্পূরক প্রাকৃতিক কোনো পদ্ধতি দিয়ে সম্পূর্ণ চিকিৎসা করা হয়, তাই ওষুধ-বিকল্প চিকিৎসা। যেমন- আকুপাংচার,আকুপ্রেসার, রিফ্লেক্সোলজি, ইয়োগা, সাইকোথেরাপি, মেডিটেশন, রেইকি, ফিজিওথেরাপি, মাডথেরাপি, ইমেজথেরাপি, মিউজিকথেরাপি, কালারথেরাপি, নাম্বারথেরাপি, ম্যাগনেটথেরাপি ইত্যাদি। আসুন এইসব পদ্ধতি কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে জেনে নিই।

আকুপ্রেসার
শরীরের কিছু নির্দিষ্ট বিন্দুতে নির্দিষ্ট নিয়মে চাপ প্রয়োগের (আঙুল বা কাঠি দিয়ে) মাধ্যমে রোগ নির্ণয়, নিরাময় ও প্রতিরোধ করার বিস্ময়কর চিকিৎসা পদ্ধতির নাম আকুপ্রেসার। প্যারালাইসিস, মাইগ্রেন, হৃদরোগ, আথ্রাইটিস, লিভাররোগ, ব্যাকপেইন, স্পন্ডিলাইসিস, পারকিনসন প্রভৃতি রোগে খুব ভালো ফল পাওয়া যায়।

আকুপাংচার
এটি একটি প্রাচীন চীনা চিকিৎসাপদ্ধতি। এ-পদ্ধতিতে শরীরের কিছু নির্দিষ্ট বিন্দুতে নির্দিষ্ট নিয়মে সরু লম্বা সুচ ফুটিয়ে চিকিৎসা করা হয়। বর্তমানে চীনে যেকোনো রোগের জন্য আকুপাংচার চিকিৎসার প্রয়োগ করা হয়। ব্যথাসহ শারীরিক যেকোনো সমস্যা সমাধান করা যায় আকুপাংচার চিকিৎসার মাধ্যমে।

রিফ্লেক্সোলজি
যে-পদ্ধতিতে হাত ও পায়ের নির্দিষ্ট কিছু বিন্দুতে চাপ প্রয়োগ করে রোগ নির্ণয়, নিরাময় ও প্রতিরোধ করা যায় তাই রিফ্লেক্সোলজি। এ-পদ্ধতিতে যেকোনো রোগ ভালো করা যায় এবং রোগী নিজেই নিজের চিকিৎসা করতে পারে।

কালার থেরাপি
আমাদের হাতে ও পায়ে যে সকল আকুপয়েন্ট আছে সেখানে কিছু নির্দিষ্ট কালার লাগানোকেই কালার থেরাপি বলে। একেক কালারে একেক রাসায়নিক পদার্থ থাকে এবং সেখান থেকে নির্দিষ্ট রাসায়নিক পদার্থ আমাদের ত্বকের ভিতরে প্রবেশ করে রোগ মুক্ত করে। কালার থেরাপি দেহের ভারসাম্য রক্ষা করে, প্রতিটি রংয়ের নিজস্ব শক্তি আছে, যা দেহে সাতটি চক্রের সামঞ্জস্য রক্ষা করে।

নম্বর থেরাপি
আমাদের হাতে ও পায়ে যে সকল আকুপয়েন্ট আছে সেখানে কিছু নির্দিষ্ট কালার দিয়ে নির্দিষ্ট সংখ্যা বসানোকেই নম্বর থেরাপি বলে। এই চিকিৎসা খুব দ্রুত ফল প্রদান করে।

ম্যাগনেট থেরাপি
আমাদের হাতে ও পায়ে যে সকল আকুপয়েন্ট আছে সেখানে এবং শরীরের অন্যকোনো স্থানে ম্যাগনেট বসিয়ে চিকিৎসা করাকেই ম্যাগনেট থেরাপি বলে। ম্যাগনেটের চৌম্বকশক্তি দেহে রক্তপ্রবাহকে প্রভাবিত করে এবং মাইগ্রেন ও হাড়ের ব্যথা উপশম করে।

যোগ ব্যায়াম
যোগ শব্দটি সংস্কৃত যুজ ধাতু থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ বাঁধা বা সংযুক্ত করা। যোগ বলতে বোঝায় বুদ্ধি, মন, আবেগ ও ইচ্ছাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা। মহর্ষি পতঞ্জলি বলেছেন, যোগ হলো সেই ক্রিয়া যার সাহায্যে ইন্দ্রিয়কে সংযত করে আত্মার সুপ্ত শক্তিকে জাগ্রত করা হয় এবং তা বিভিন্ন আসন, প্রাণায়াম, মুদ্রা ও বন্ধের মাধ্যমে। যোগ আত্মার সাথে মন ও মনের সাথে শরীরের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা সৃষ্টি করে।

মেডিটেশন
কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে মন স্থির করাই মেডিটেশন। মেডিটেশন এমন এক মাধ্যম যেখানে মস্তিষ্কের কম্পাঙ্ককে কমিয়ে আনা হয় এবং এর মাধ্যমে অনেক কঠিন ও জটিল রোগ একেবারেই নিরাময় করা সম্ভব। মনোসংযোগের মাধ্যমে শরীরের নির্দিষ্ট অংশের সমস্যার সমাধান করে।

রেইকি
জাপানি শব্দ রেইকি এক বিকল্প প্রাকৃতিক চিকিৎসাপদ্ধতি। যা রোগারোগ্য ছাড়াও নতুন জীবনীশক্তিতে ভরপুর করে নবোৎসাহ-উদ্দীপনায় কর্মক্ষম করতে সহায়তা করে। মস্তিষ্কের তরঙ্গকে প্রভাবিত করে, দেহে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

মিউজিক থেরাপি সঙ্গীত বা শ্রুতিমধুর শব্দের মাধ্যমে চিকিৎসা হল মিউজিক থেরাপি। এটা মস্তিষ্কের উদ্দীপনাকে কমিয়ে রাখে। এর মাধ্যমে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও নান্দনিক স্বাস্থ্যের উন্নতি সম্ভব। হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, অনিদ্রা, মানসিক চাপ ও ভয় কমাতে সাহায্য করে।

ইমেজ থেরাপি
বিভিন্ন ছবির (ফটোগ্রাফি, পেইন্টিং) মাধ্যমে চিকিৎসা প্রদান পদ্ধতিই ইমেজ থেরাপি। এই থেরাপি ক্রনিক এলার্জি, আমবাত, হাঁপানি ও চর্মরোগ কমায় এবং স্ট্রেস কমিয়ে মনকে প্রফুল্ল করে তোলে।

সাইকো থেরাপি
মনস্তত্ববিদ বা অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য প্রদানকারীর সাথে কথা বলার মাধ্যমে রোগীর মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনই মূলত সাইকোথেরাপি। সব বয়সী মানুষের মনোরোগের জন্য খুব ভালো কাজ করে এই থেরাপি।

আয়ুর্বেদ
আয়ু এবং বেদ এ দুটি শব্দের সংযোগে আয়ুর্বেদ শব্দ উৎপন্ন হয়েছে। আয়ু অর্থ জীবিতকাল বা সময় এবং বেদ অর্থ জ্ঞান। মানুষের জীবিতকাল সম্বন্ধে যে জ্ঞান তাকেই আয়ুর্বেদ বলে। ভেষজ প্রয়োগের মাধ্যমে বায়ু, পিত্ত, কফ রোগের এই তিন কারণ উদঘাটন এবং মূল উৎপাটন আয়ুর্বেদের মূল কাজ।

মাড থেরাপি
কাদা প্রকৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এর গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থ মানবস্বাস্থ্যের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। দীর্ঘ সময়ের জন্য আর্দ্রতা ধরে রেখে শরীরের বিষক্রিয়া শুষে এই পদ্ধতিতে রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময় করা সম্ভব। এই থেরাপি ত্বকের মৃতকোষ দূর করে নরম কোমল ত্বক প্রকাশ করে, শরীরকে বিষমুক্ত করে, ত্বকের দাগ কমায়, ঘামের দুর্গন্ধ দূর করে।

ফিজিওথেরাপি
ফিজিওথেরাপি একটি বিশেষায়িত চিকিৎসা পেশা। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকগণ রোগীর এসেসমেন্ট, রোগনির্ণয়, চিকিৎসা, পুনর্বাসন, পুনর্স্থাপন, রোগপ্রতিরোধ ও স্বাস্থ্যের উন্নতি করে থাকেন। ফিজিওথেরাপির মূল উদ্দেশ্য হলো অসুস্থতা, আঘাত এবং অক্ষমতার ক্ষেত্রে শরীরে পূর্বাবস্থা ফিরিয়ে আনা।

ওষুধ-বিকল্প চিকিৎসার গুরুত্ব
চিকিৎসক ও ওষুধে উপর নির্ভর করতে হয় না।
মানুষ নিজের শরীর সম্পর্কে ধারণা রাখে ও ভালো কিছুর চর্চা করতে পারে; যেমন- ধ্যানচর্চা, যোগ ব্যায়াম, মেডিটেশন, আকুপ্রেসার ইত্যাদি।

শরীরের নিয়ন্ত্রণশক্তি, শক্ত মজবুত হাড় গঠন, টিস্যু গঠন, উপকারী হরমোন নিঃসরণ প্রভৃতি শারীরিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়।
মানসিক উদ্বেগ, উত্তেজনা হ্রাস পায়। ফলে মানুষের মধ্যে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়।
সববয়সী মানুষের মনোদৈহিক রোগ মুক্ত করে।
শরীরের ফাংশন বা কর্মকাণ্ড সব সময় সচল ও সক্রিয় রাখে, ফলে নিরোগ ও সুস্থদেহের অধিকারী হওয়া যায়।

সুফল
সম্পূর্ণ ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত।
আর্থিক খরচ খুবই কম, তাই যে কেউ অনায়াসে চিকিৎসা করাতে পারে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগী নিজেই নিজের চিকিৎসা করতে পারে।
ভেষজ ব্যবহার শরীরে প্রাকৃতিক নিরাময় প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে।
ওষুধ-বিকল্প চিকিৎসায় শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়, ফলে সুস্থ জীবনযাপন করা যায়।



মন্তব্য চালু নেই