কওমি মাদরাসায় মেয়েদের বিজ্ঞান-দর্শন পড়া মানা!

ইসলামে জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক নর-নারীর জন্য অবশ্য কর্তব্য (ফরজ) হলেও এক্ষেত্রে বৈষম্য করছে কওমি মাদরাসাগুলো। যদিও তারাই একমাত্র সঠিক ইসলামি শিক্ষা দিচ্ছে বলে দাবি করা হয়। বাংলাদেশের সংবিধানেও শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। একারণে সাধারণ মাধ্যমে পড়াশুনায় ছেলে-মেয়ে সমান সুযোগ পায়। কিন্তু কওমি মাদরাসায় একজন ছাত্রকে দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স সমমান) শেষ করতে ১২ থেকে ১৩ বছর লাগে। সেখানে একজন নারী শিক্ষার্থীর লাগে মাত্র ৬ থেকে ৭ বছর।

কোরআন-হাদিসের প্রচার-প্রসারের পাশাপাশি ইসলামি আদর্শ, সাম্য-ভ্রাতৃত্বের শিক্ষায় মানব জীবন গঠনের নির্ভরযোগ্য শিক্ষাঙ্গন কওমি মাদরাসা। এই ধারণা গত দুই শতাধিক বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এই মাধ্যমে পড়াশোনায় ছেলে-মেয়েদের জন্য রয়েছে পৃথক সিলেবাস। ফলে নারী শিক্ষার্থীরা পরিপূর্ণ কোরআন-হাদিসের পাশাপাশি দর্শন, বিজ্ঞানসহ বেশ কিছু বিষয়ে জ্ঞানার্জন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ কারণে কওমি মাদরাসা পড়ুয়া নারী শিক্ষার্থীদের সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়া প্রবল আকাঙ্ক্ষা থাকলেও পুরুষদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দাওরায়ে হাদিস শেষ করতে একজন ছাত্রকে ১২-১৩ বছর পড়াশোনা করতে হয়। এ দীর্ঘ সময়ে কোরআন, হাদিস, ফিকাহ, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, বিজ্ঞান, আরবি, উর্দু ও ফারসি সাহিত্যেসহ প্রায় ১০০টি বিষয়ে বিস্তারিত পাঠদান করা হয়। বিশেষ কিছু বিষয়ে থাকে পর্যাপ্ত দিকনির্দেশনা ও গবেষণার সুযোগ। এছাড়া গণিত ও কম্পিউটার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পাঠদান করা হয়। অথচ নারীদের ছয়-সাত বছরের মধ্যেই দাওরায়ে হাদিস শেষ করানো হয়। তাদের দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, বিজ্ঞান, উর্দু, ফারসি ও আরবি সাহিত্যের বিষয়গুলো বাদ দিয়ে; নামমাত্র পরিসরে বাংলায় অনুবাদ করা কোরআন, হাদিস ও ফিকাহ শাস্ত্রের ৩০-৩৫টি বই পড়ানো হচ্ছে। যার ফলে ইসলামি জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রেও বৈষ্যমের শিকার হচ্ছে নারী শিক্ষার্থীরা।

তারপরও ইসলামের গভীর জ্ঞান অর্জন তথা প্রকৃত কোরআন হাদিস ফিকাহসহ অন্যান্য বিষয়ে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও পরিপূর্ণতা লাভ করতে দরসে নেজামি তথা কওমি সিলেবাসের বিকল্প নেই বলে মনে করেন জামিয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদরাসার মুহাদ্দিস মুফতি ফয়জুল্লাহ।

তিনি বলেন, ‘পরিপূর্ণ আলেম হতে গেলে যে শিক্ষা দরকার তা একমাত্র দরসে নেজামির সিলেবাসে বিদ্যমান। কেউ যদি কাটছাট করে; বিষয়য়াদি কমিয়ে নতুন সিলেবাস তৈরি করে তাহলে পূর্ণ আলেম হওয়া অসম্ভব। কারণ কওমি সিলেবাস এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে; সেখান থেকে যদি কোনো একটি বিষয় বাদ দেয়া হয়, তাহলে অর্জিত জ্ঞানে ঘাটতি থাকবেই।’

তার দাবি, কওমি শিক্ষা পদ্ধতিটি পরীক্ষিত। প্রায় ২০০ বছর যাবৎ তারা এর সুফল পাচ্ছেন। তবে এ পদ্ধতিকে আধুনিক বা আরো যুগোপযোগী করতে সংস্কার করা যেতে পারে; কিন্তু সংস্কারের নামে বাদ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, ‘বর্তমানে নারী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে যেটুকু হচ্ছে তা একেবারে না হওয়ার চেয়ে অবশ্যই ভালো। তবে কওমি সিলেবাসের আওতায় পুরো শিক্ষাপদ্ধতিটা পরিচালনা করা গেলে কেউই পিছিয়ে থাকবে না বলে আমি মনে করি।’

এদিকে নারীদের জন্য পাঠক্রম সংক্ষিপ্ত করার সপক্ষে যুক্তি হিসেবে নরশিংপুর দারুল উলুম মাদরাসার শিক্ষা সচিব মাওলানা ইদ্রিসুর রহমান বলেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অপ্রতুলতা, নারীর শারীরিক গঠন, প্রাতিষ্ঠানিক অব্যস্থাপনা, সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে স্বল্প সময়ে জরুরি কিছু পাঠদান শেষে তাদের কোর্সের সমাপ্তি টানা হয়।’

তিনি বলেন, ‘মহিলা মাদরাসা খুবই কম, চাইলেই যে কেউ তার নিজের বাসা-বাড়ির আশপাশে মহিলা মাদরাসা খুঁজে পান না। এ পরিস্থিতিতে অধিকাংশ অভিভাবকরা দূরের প্রতিষ্ঠানে যেতে বাধ্য হন। একটি মেয়েকে প্রায় ১৩ বছর বাড়ির বাইরে রেখে পড়াশোনা; আমাদের সমাজে এটা খুবই কঠিন ব্যাপার।’

অবশ্য মাওলানা ইদ্রিসুর রহমান এও স্বীকার করেন যে, অল্পকিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই অব্যবস্থাপনার কারণে সঠিকভাবে শিক্ষাকার্যক্রম এগিয়ে নিতে পারছে না। নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও তেমনভাবে গড়ে উঠছে না। তার সঙ্গে পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা; যেমন মেয়েকে বেশি পড়িয়ে কী হবে? তার চেয়ে বরং মানসম্মানে বিয়ে দিয়ে বিদায় করতে পারলেই হলো। দায়িত্বশীলদের এমন আচরণে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে মেয়েরা। তার সঙ্গে শারীরিক গঠনের একটা ব্যাপার, এসব কারণে সংক্ষিপ্ত কোর্সের মাধ্যমে নারীদের শিক্ষা দেয়া করা হয়ে থাকে। যোগ করেন মাওলানা ইদ্রিস।

তবে নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাদের শিক্ষার প্রতি প্রবল আগ্রহ এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠার প্রতি আকাঙ্ক্ষার বিষয়। কওমি সিলেবাস প্রণেতাদের সঙ্গে এই শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গিরও ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। তাদের অধিকাংশেরই পড়াশোনার প্রবল ইচ্ছা। তাদের দাবি, যতদ্রুত সম্ভব সম্পূর্ণ কওমি সিলেবাসের অধীনে যেন নারীদেরও পাঠদান চালু করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাদেরকে ততোটুকু পড়ানো হয় যতোটুকু জানলে কালেমা, নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত তথা ইসলামের ভিত্তিগুলো জানা যায়। তার ওপর আমল করা যায়। কিন্তু কোরআন, হাদিস, ফিকাহ বা অন্যান্য বিষয়ে আমাদের আগ্রহ থাকার পরও ছোট সিলেবাস ও সময় স্বল্পতার কারণে সবিস্তারে জানার সুযোগ নেই। যদি আমাদেরকে সম্পূর্ণ কওমি সিলেবাসে পড়ানো হয় তাহলে আমরাও অনেক বেশি পড়ার সুযোগ পাবো।’

আরেক শিক্ষার্থী ফাতেমা খাতুন বলেন, ‘শিক্ষা গ্রহণ করে আমাদের জন্য মহিলা মাদরাসায় শিক্ষা প্রদান ছাড়া কোথাও কাজের সুযোগ নেই। পুরুষরা পুরুষদের মাদরাসায় যেমন পড়াতে পারে তেমনি মহিলা মাদরাসায়ও পড়ায়। মসজিদে তাদের সুযোগ রয়েছে। আমারদের জন্য এক মহিলা মাদরাসাই। সেখানেও সুযোগ ততোটা নেই। কারণ সেখানে পুরুষ শিক্ষকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে হয়।’

সবশেষে তিনি অত্যন্ত খেদের সঙ্গে বলেন, ‘সবমিলিয়ে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীকে পড়াশোনা শেষ করে স্বামীর সংসারে থাকতে হয়। সংসারই যেহেতু; সেক্ষেত্রে এ সিলেবাসটাই আমি মনে করি ঠিক আছে।’

প্রসঙ্গত, বর্তমানে সারা দেশে মহিলা কওমি মাদরাসার সংখ্যা আড়াইশ’র বেশি নয়। যেখানে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষের হিসাবে মোট কওমি মাদরাসা ৩ হাজার ২৫৮টি। তবে বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা হবে অন্তত ১৫ হাজার।

এই বৈষম্য নিয়ে কথা হয় মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারেসীনে আরাবিয়্যার সহকারী মহাসচিব মাওলানা আবুল ফাতাহ মোহাম্মদ ইয়াহহিয়ার সঙ্গে। তিনি জানালেন, এ পদ্ধতিটা পরীক্ষামূলক। পারিবারিক ও সামাজিক দিকগুলো বিবেচনা করে এ পদ্ধতির বাস্তবিকপরীক্ষা চলছে। কিন্তু বাস্তবে দুইশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই সিলেবাস চলছে।

মাওলানা আবুল ফাতাহ যুক্তি দিয়ে বলেন, ‘সামাজিক ও পারিবারিক দিকগুলো যেমন, আমাদের সমাজে বা পরিবারে একটি মেয়ের বিয়ের বয়স ১৬ থেকে শুরু করে ১৮ বছর। এর মধ্যে বেশিরভাগ মেয়ের বিয়ে-শাদি হয়ে যায়। আমরা চিন্তা করলাম এমন যদি হয় তারা পড়াশোনা শেষ করল, বিয়ের সময়টাও হলো অর্থাৎ ১৬-১৮ এ বয়সটার মধ্যে। সেই ভাবনা থেকে মূলত আমরা কওমি সিলেবাস থেকে অতীব জরুরি বিষয়গুলো নির্দিষ্ট করে শিক্ষানীতিটা প্রবর্তন করি। এখন নারীদের পড়াশোনার ইচ্ছা আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। তারা জানতে চায়, জানাতে চায়। স্বাবলম্বী হতে চায়। সে কারণে পড়তে চায়।’

তিনি স্বীকার করেন, ‘এ শিক্ষা পদ্ধতিটা নারীদেরকে পিছিয়ে দিচ্ছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে তারা বৈষ্যম্যের শিকার হচ্ছেন। বিষয়টা আমরা উপলদ্ধি করে পদক্ষেপ নিয়েছি। বোর্ড কর্তৃপক্ষ চেয়েছে নারী-পুরুষ সমান শিক্ষা পদ্ধতি মেনে পড়াশোনা করবে। মহিলা কওমি মাদরাসা অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে আমরা কয়েক দফা বসেছি, আলোচনা করেছি। তাদের কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব কথাবার্তা ও অসহযোগিতার কারনে প্রক্রিয়াটা ধীর গতিতে এগুচ্ছে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে চাই পূর্ণাঙ্গ সিলেবাস প্রণয়ন করতে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সবার জন্য সমান শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।’বাংলামেইল



মন্তব্য চালু নেই