কতৃপক্ষের অব্যবস্থাপনায় ন্যুব্জে পড়েছে কুমেক হাসপাতাল

মাসুদ আলম, কুমিল্লা : দালাল সিন্ডিকেট, চিকিৎসক ও নার্সদের দৌরাত্ম্য এবং দুঃসহ দুর্গন্ধসহ নানা সমস্যায় ন্যুব্জে পড়েছে বৃহত্তর কুমিল্লায় ১৯৯২ সালে আত্মপ্রকাশ করা কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। বর্তমানে হাসপাতাটিতে অসহায় ও মুমূর্ষু রোগীদের রোগীদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে! এমনকি সর্বত্র দালালের উৎপাত এখন চরম আকার ধারণ করেছে।

হাসপাতালের অধিকাংশ শৌচাগারের চিত্র ভয়াবহ। কোনোটির দরজা নেই, আবার কোনোটির দরজা থাকলেও ছিটকিনি নেই। ফোরে ময়লা ভেসে থাকায় শৌচাগারে পা রাখা কষ্টকর। পদে পদে হয়রানি ছাড়াও রয়েছে কিছু ডাক্তারের ব্যক্তিগত দালাল। তারা সরকারি হাসপাতাল থেকে ডাক্তারদের ব্যক্তিগত ক্লিনিকে রোগী নেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। এছাড়াও হাসপাতালের প্রত্যেকটি বিভাগের সিনিয়র ডাক্তারের নাগাল পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠেছে বলে রোগীদের অভিযোগ।

সরেজমিন দেখা গেছে, হাসপাতালগুলোর আঙ্গিনা, দেয়াল, টয়লেটসহ নানা ব্যবহার্য জিনিস ঠিকমতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখছে না কর্তৃপক্ষ। সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটি দিন দিন নোংরা, অপরিষ্কারসহ সবগুলো বিভাগের টয়লেট ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সরেজমিনে আরো দেখা যায় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ঢুকতেই বহুদিনের দুর্গন্ধযুক্ত ময়লার ড্রাস্টবিন রোগী ও তাদের স্বজনেরা নাকে কাপড় চেপে চলাচল করতে হয়। সেখানে বাতাসে ভাসছে দুঃসহ দুর্গন্ধ। একই অবস্থা ক্যাজুয়েলিটি, বার্ন, শিশু ও মহিলা ওয়ার্ডে অবস্থা আরও করুণ। একদিকে রোগিরা সব ধরণের ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়। একটি সূত্র জানায়, এই হাসপাতালে দালালের অভ্যর্থনায় রোগীদের দিন শুরু হয়। অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া নিতে দালাল, ওষুধ কিনতে গেলে দালাল, রক্ত কিনতে গেলে দালাল, টেস্ট করাতে, সিট পেতে দালাল ও লাশ ছাড়াতে গেলেও দালালের দৌরাত্ম্য দেখা মিলে।

মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে সিট না পেয়ে ফ্লোরে শুয়ে আছেন জেলার মুরাদনগন উপজেলার থেকে আসা হুমাউন কবির। তিনি বিদ্যুৎস্পর্শে হাত ও শরীর পুড়ে বার্ন ইউনিটে ছুটে আসেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, অসহায় হয়ে সরকারি চিকিৎসা নিতে এই হাসপাতালে আসা। কিন্তু এখানে দেখছি চিকিৎসার নামে ওপেন সিক্রেট চাঁদাবাজি চললেও আমরা অসহায়। ডাক্তারদের নাগাল পাওয়া দুষ্কর। একবার পাওয়া গেলে ইচ্ছে মত ওষুধ লিখে দেয়! পরে নার্সরা এগুলো নিয়ে যায়। শুধু তাই নয় সময়মতো থাকার জায়গা পরিষ্কার না করায় ময়লা গুলো পচে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়। এদিকে অতিরিক্ত ময়লা ভেসে থাকায় টয়লেটে যাওয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে।

হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের দফতর-শাখা সর্বদাই দায়িত্বহীনতা, ফাঁকিবাজির প্রতিযোগিতা চলছে। হাসপাতালের মহিলা (গায়নি) বিভাগসহ অধিকাংশ সিনিয়র ডাক্তারদের ভাড়াটে বেতনভুক্ত ২০/২৫ জন দালাল রয়েছে। যাদেরকে দিয়ে ব্যক্তিগত ও প্রাইভেট চেম্বারে রোগি সংগ্রহ করে। চিকিৎসকদের এসব বেতনভূক্ত দালালচক্র সরকারি হাসপাতালে সব ধরনের পরীক্ষার উন্নত ব্যবস্থা নেই! এমন প্রশ্ন উঠিয়ে রোগীদের সঙ্গে আঁতাত করে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকে ও ডায়গনস্টিক সেন্টারে পাঠিয়ে দেন। এতে করে ঐ চিকিৎসকরা ৫০%-৬০% পর্যন্ত কমিশন পেয়ে থাকেন। চিকিৎসকদের কমিশনের বিষয়টি এখন ‘ওপেন সিক্রেট’ হলেও রোগীরা এ ক্ষেত্রে অসহায়।

চৌদ্দগ্রাম থেকে আসা মহিলা বিভাগের রোগীদের শারমিন পারহানার অভিযোগে জানা গেছে, ডাক্তার, নার্স রোগীদের সেবাদানের চেয়ে তাদের ব্যক্তিগত কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। মহিলা ডাক্তার, নার্সরা নিজেই মানসিক রোগী হয়ে পড়েছেন। তাদের কাছে রোগীর সেবার চেয়েও প্রেমিকের ফোনে কল বড় হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন রোগিদের ওষুধ নার্সরা চুরি করে বাসায় নিয়ে যায়। ফলে অনেক সময়ই ওষুধ সংকটে পড়তে হয় হাসপাতালের রোগিরা।

কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ ইমারজেন্সি বিভাগে চিকিৎসারত নুর হোসেনের স্বজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন- কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ গরিব ও দুঃখিদের কশাই খানা। হাসপাতালের বিভিন্ন কর্মকর্তা সরকারী চিকিৎসা দেওয়ান নামে রোগীদের সাথে কশাইদের মত আচারণ করে অর্থের বিনিময়ে কাজ করে। অর্থ ছাড়া একটি ঔষুধ পাওয়া যায় না! আবার চিকিৎসা।

কুমিল্লার সিভিল সার্জন ডা: মুজিবুর রহমান বলেন, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনের বেশির ভাগ ফার্মেসি দালালের মাধ্যমে ওষুধ বিক্রি করে মানুষকে হয়রানি করছে। এ নিয়ে সেখানে আমরা একাধিকবার অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় করেছি।

তিনি জানান, দালালের উৎপাত রোধে সিসি ক্যামরা বসানো হয়েছে। বর্তমানে তাদের উৎপাত কিছুটা কমে এসেছে। দালালদের ধরতে গেলে তারা রোগীদের আত্মীয় পরিচয় দেন।

এ ব্যাপারে কুমেক হাসপাতালের পরিচালক ডা. শপন কুমার দত্ত জানান, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হচ্ছে মুমূর্ষু রোগীদের শেষ আশ্রয়স্থল। এ হাসপাতালে বেশিরভাগ সময় জরুরি রোগীদের নিয়ে আসা হয়। কখনও কখনও রাস্তায়ই মারা যাচ্ছে এরকম রোগীও আনা হয়। অভিযোগ পেলেই আমরা দালাল সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে থাকি। এ পর্যন্ত চলতি বছরে একাধিক অভিযানে দালাল সিন্ডিকেটের ১৫ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত দালালদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করা হয়েছে।

এদিকে হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতা নিয়ে তিনি বলেন, চেষ্টা করি প্রত্যেকটি শৌচাগার পরিষ্কার রাখতে। তবে কুমেক হাসপাতালের সবগুলো বিভাগে অনিয়ম, দালালেল সিন্ডিকেট ও দুর্গন্ধ মুক্ত রাখতে সিসি ক্যামরার আওতাধীন আনা হবে।



মন্তব্য চালু নেই