কনসালট্যান্টরা পড়াবেন মেডিকেল শিক্ষার্থীদের

ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের এক সহকারী অধ্যাপককে গত ২৫ জানুয়ারি বদলি করা হয় মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে তিনি চিঠি দিয়ে জানান, ৩০ জানুয়ারি নতুন কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু কর্মস্থলে তাকে পাওয়া যায়নি। মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ তার অনুপস্থিতির কথা জানিয়ে চিঠি দেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে।

গত ২৭ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পারসোন্যাল অধিশাখা-১ থেকে পাঠানো এক চিঠিতে ওই সহকারী অধ্যাপককে দ্রুত নতুন কর্মস্থলে নিয়মিত উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে দীর্ঘদিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার কারণ ব্যাখ্যা দিতে বলা হয় তাকে। এ রকম তিনশ’র বেশি চিকিৎসক বছরের পর বছর রাজধানীতে অবস্থান করছেন।

এদিকে ঢাকার বাইরের ১৮টি মেডিকেল কলেজে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার পথে। এসব কলেজের শিক্ষা কার্যক্রমের সংকট দূর করতে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জেলা সদর ও জেনারেল হাসপাতালের জুুনিয়র ও সিনিয়র কনসালট্যান্টরাই মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের পাঠদান করবেন। কনসালট্যান্টদের দিয়ে এমবিবিএস ও বিডিএস কোর্সের শিক্ষার্থীদের পাঠদানের এ সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘শিক্ষক সংকটের কারণে মেডিকেল কলেজগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তাই জুনিয়র ও সিনিয়র কনসালট্যান্টরা আপাতত ওইসব মেডিকেল কলেজে বিষয়ভিত্তিক পাঠদান করবেন। ঢাকার বিভিন্ন কর্মস্থলের অতিরিক্ত চিকিৎসকদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তাদের বদলির পর কনসালট্যান্টদের পাঠদান থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে।’ বিধি অনুযায়ী, কনসালট্যান্টরা জেলা সদর ও জেনারেল হাসপাতালের রোগী চিকিৎসার পাশাপাশি বিভিন্ন প্যারামেডিকস কোর্সের ক্লাস ও পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। তাদের দিয়ে পাঠদানের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় আপত্তি জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, ‘এমবিবিএস ও বিডিএস কোর্সে পড়ানোর মতো সহকারী, সহযোগী ও অধ্যাপক থাকার পরও তাদের কাজে লাগাতে না পারলে তা সরকারের ব্যর্থতা। কেউ আদেশের ব্যত্যয় ঘটালে আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে।’ যে কোনো মূল্যে ঢাকার বিভিন্ন কর্মস্থলে থাকা অতিরিক্ত চিকিৎসকদের বদলির মাধ্যমে এ সংকট দূর করার আহ্বান জানান তিনি।

কেন এই সংকট : ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে তিন শতাধিক সহকারী, সহযোগী ও অধ্যাপক ওএসডি পোস্টিং নিয়ে বছরের পর বছর অবস্থান করছেন। চিকিৎসক ও শিক্ষক সংকটে থাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে বদলি করা হলেও উচ্চ পর্যায়ে লবিং-তদবির করে তারা তা প্রত্যাহার করাচ্ছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, স্বাচিপ নেতাদের বিরোধিতাসহ উচ্চ পর্যায়ে লবিং-তদবিরের কারণে ওএসডি সংযুক্তি নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে এই অতিরিক্ত চিকিৎসকরা তাদের অবস্থান নিশ্চিত করছেন। কাউকে বদলি করা হলেই স্বাচিপের নেতারা তার পক্ষে তদবিরে নামছেন। অনেকে বদলিকৃত কর্মস্থলে যোগদান করে মন্ত্রণালয়ে চিঠি ইস্যু করলেও সেখানে থাকছেন না। এমনকি সরকার রাজধানীর বাইরের মেডিকেল কলেজে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ নিয়োগের লক্ষ্যে প্যানেল গঠনের জন্য আবেদন আহ্বান করলেও সাড়া দিচ্ছেন না তারা।

অবশ্য স্বাচিপ সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেছেন, ‘ঢাকার বাইরে কোনো চিকিৎসকের বদলি ঠেকাতে স্বাচিপের পক্ষ থেকে তদবির করা হয়েছে_ এমন প্রমাণ কেউ দিতে পারবে না। ঢাকা থেকে বাইরের চিকিৎসকদের মেডিকেল কলেজে বদলি করা হলে স্বাচিপ তা সমর্থন করবে।’ এদিকে চিকিসক সংকটে ঢাকার বাইরের ১৮টি মেডিকেল কলেজে পাঠদান বন্ধ হওয়ার পথে। এসব কলেজে বেসিক সায়েন্সের কোর্স অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, ফার্মাকোলজি, মাইক্রোবায়োলজি, এপিডেমিওলজি, কমিউনিটি মেডিসিন, ফরেনসিক মেডিসিনসহ বিভিন্ন কোর্সে পড়ানোর শিক্ষক নেই। সম্প্রতি এসব মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষরা বিষয়টি জানিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিলে সংকটের সামগ্রিক ভয়াবহতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

সরকারের সিদ্ধান্ত, ক্লাস নেবেন কনসালট্যান্টরা : এ প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, জেলা ও সদর জেনারেল হাসপাতালের জুনিয়র ও সিনিয়র কনসালট্যান্টদের মেডিকেল কলেজে বিষয়ভিত্তিক পাঠদানে নিয়োগ করা হবে। এ জন্য তাদের অতিরিক্ত ভাতা দেওয়া হবে।

যে ১৮টি মেডিকেল কলেজ এ সিদ্ধান্তের আওতায় রয়েছে সেগুলো হলো : মুগদা মেডিকেল কলেজ, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ, দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ, যশোর মেডিকেল কলেজ, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ, পাবনা মেডিকেল কলেজ, জামালপুর মেডিকেল কলেজ, টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ (গাজীপুর), শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ (সিরাজগঞ্জ), মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ, রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ, পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ (কিশোরগঞ্জ), শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজ (গোপালগঞ্জ) এবং নোয়াখালী মেডিকেল কলেজ। এসব মেডিকেল কলেজ সংশ্লিষ্ট জেলার সদর বা জেনারেল হাসপাতালের কনসালট্যান্টরা বিষয়ভিত্তিক একাডেমিক কার্যক্রমে অংশ নেবেন।

সরকারি অনমনীয়তায় যোগ দিলেও কর্মস্থলে অনিয়মিত :সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ১১ চিকিৎসককে রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে বদলির আদেশ জারি করে। তাদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজে (ঢামেক) রেডিওথেরাপি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মুকিতুল হুদাকে খুলনা মেডিকেল কলেজে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ওএসডি সংযুক্ত ঢামেকের নেফ্রোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক (চলতি দায়িত্ব) ডা. ফেরদৌস কামাল ভঁূইয়াকে বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ওএসডি সহযোগী অধ্যাপক ডা. শরিফুল ইসলামকে শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজে ডেন্ট্রিস্ট্রি বিভাগে, ঢামেকের ফার্মাকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক (চলতি দায়িত্ব) ডা. হাসানুর রহমানকে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে, জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক অফথালমোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আশিকুর রহমান আকন্দকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ওএসডি করে শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজে সংযুক্ত করা হয়েছে।

আদেশ জারির পর এসব চিকিৎসক তা স্থগিতের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ওই আবেদন মঞ্জুর না করে তাদের বদলি করা কর্মস্থলে দ্রুত যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেন। অতিরিক্ত তিন শতাধিক চিকিৎসক রাজধানীতে :দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের তিন শতাধিক চিকিৎসক ওএসডি সংযুক্তি নিয়ে রাজধানীর সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে বছরের পর বছর অবস্থান করছেন।

রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল এবং জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ওএসডি সংযুক্তি নিয়ে চাকরি করছেন_ এমন চিকিৎসক রয়েছেন ২৩১ জন। তাদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ৭৩ জন, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ৭৬ জন, মিটফোর্ডে ৩৯ জন এবং হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ৪৩ জন চিকিৎসক রয়েছেন।

এ ছাড়া বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, ক্যান্সার, নাক-কান-গলা, কিডনি, চক্ষু বিজ্ঞান, নিউরোসায়েন্স ও মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, জাতীয় অর্থোপেডিক পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল) এবং মুগদা ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালসহ বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে শতাধিক চিকিৎসক কর্মরত রয়েছেন বলে জানা গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. দীন মো. নূরুল হক বলেন, ‘ঢাকায় থাকা অতিরিক্ত চিকিৎসকদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এরই মধ্যে মুগদা থেকে প্রায় ১৫ জনকে রাজধানীর বাইরে বদলি করা হয়েছে। অতিরিক্ত থাকা অন্যদের বিষয়েও শিগগির সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

যে কারণে ঢাকা ছাড়তে চান না চিকিৎসকরা : রাজধানীতে কর্মস্থল হলে চিকিৎসকরা প্রাইভেট প্র্যাকটিস, বিভিন্ন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে খণ্ডকালীন পাঠদান এবং পরামর্শক হিসেবে যুক্ত থেকে বাড়তি অর্থ আয়ের সুযোগ পান। সন্তানের লেখাপড়া ও পরিবার-পরিজন নিয়ে একসঙ্গে থাকার যুক্তিও দেখান কোনো কোনো চিকিৎসক। কেউ কেউ ক্ষমতাসীন দলের চিকিৎসক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকার সুবাদে বিভিন্ন একাডেমিক ও প্রশাসনিক পদে নিযুক্ত হন। ঢাকার বাইরে এ ধরনের সুযোগ পাওয়া যায় না কিংবা অনেক কম। এসব কারণে চিকিৎসকরা ঢাকার বাইরে যেতে চান না।-সমকাল



মন্তব্য চালু নেই