কমছে আবাস, মানুষের দাক্ষিণ্যে বাঁচবে বন্যপ্রাণী?

আদি থেকে এ পর্যন্ত পৃথিবীতে আসা মোট প্রাণীকূলের প্রায় ৫০ শতাংশ বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। কালের বিবর্তনে বাংলাদেশ ভূ-খণ্ড থেকেও বিলুপ্ত হয়েছে বহু বন্যপ্রাণী। তবে বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ অন্যান্য দেশে এখনও টিকে আছে। এছাড়া এমন আরো একশ’টি প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়ার প্রহর গুণছে।

বিশ্বায়নের এই যুগে মানুষের উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ডে সংকুচিত আসছে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। ফলে পাল্লা দিয়ে কমছে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা। অবশিষ্ট প্রাণীগুলোর অবস্থাও বিপন্ন। ফলে অদূর ভবিষ্যতে মানুষের দয়া দাক্ষিণ্যে বেঁচে থাকবে ভাগ্যবান বন্যপ্রাণীরা। অন্তত: এমন ধারণাই করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে গত ৩ মার্চ বিশ্বব্যাপী পালিত হলো আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী দিবস। বাংলাদেশে আগামী ১২ মার্চ দিবসটি পালিত হবে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘বন্যপ্রাণীর ভবিষ্যৎ আমাদের হাতেই’।

বাংলাদেশে বাঘ, হাতি, হনুমান, উল্লুক, শকুন, গেছো ব্যাঙ, মেছোবিড়াল, শুশুক, সজারু ইত্যাদি প্রাণীর সংখ্যা ক্রমাগত কমছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। শুধু শিকারই নয়, এর কারণ হিসেবে পরিবেশ ও বন্যপ্রাণীবিদরা বলছেন, প্রতিনিয়ত বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ও প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস।

বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হওয়া বন্যপ্রাণীর মধ্যে রয়েছে, বনগরু/বান্টেং (THE BANTENG), বুনো মোষ (THE WILD BUFFALO), জলার হরিণ (THE SWAMP DEER), বামন শূকর, হরিণের মত দেখতে কৃষনোসার (THE BLACKBUCK) ,নীলগাই (THE BLUEBULL), নেকড়ে (THE WOLF), ডোরাকাটা হায়েনা(THE STRIPED HYENA), মালয়ী সুর-ভালুক (THE MALAYAN SUN BEAR), গণ্ডার(THE RHINOCEROS), বনগরু (THE INDIAN BISON/ GAUR)।

বন্যপ্রাণীর করুণ পরিণতি নিয়ে প্রাণীবিদ ড. আনিসুজ্জামান খান বলেন, ‘মানুষের দয়া-দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভর করে বর্তমানে বন্যপ্রাণী বেঁচে আছে। কারণ, সারা পৃথিবীতে মর্ডানাইজেশন, ইন্ডাস্ট্রিলাইজেশনের ফলে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর আবাসভূমি ও প্রজননক্ষেত্রে কমে আসছে।’

পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় এখনই বন্যপ্রাণীর আবাসভূমি ধ্বংসের এই মহাষজ্ঞ রহিত করার সময় এসেছে এবং তা খুবই দ্রুত সময়ে করা প্রয়োজন বলেও দাবি করেছেন এই প্রাণীবিদ।

তিনি বলেন, ‘এভাবে বন্যপ্রাণীর আবাসভূমি যেমন- জঙ্গল, নদী, সাগর যদি দ্রুত কমতে থাকে তবে আরও বহু বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হবে। মানুষের একটি ছোট্ট বাড়ি হলে চলে, তবে যেমন হাতি, গণ্ডার, বাঘ এবং ওয়াইল্ড বাফেলোসহ এই ধরণের প্রাণীদের আবাসস্থলের জায়গা অনেক বড় হয়।

তিনি জানান, বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের আগ্রহ কম। যেমন বর্তমানে সাগর ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় মানুষের চাপ তুলনামূলকভাবে কম। এছাড়া এ অঞ্চলে পর্যাপ্ত ভূমিও ঠিক রয়েছে। কিন্তু প্রাকৃতিক যে বন ছিল তা অনেকাংশেই উজাড় হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। অথচ এ বিষয়ে সরকার ওয়াকিবহাল। প্রতিবেশ ও ভূমির ভারসাম্য রক্ষায় বন্যপ্রাণী বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে বন, নদী, খাল, বিল ও সাগর ইত্যাদি রক্ষায়ও পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

পরিবেশবিদদের মতে, বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্র অঞ্চলেও রয়েছে নানা ধরণের প্রাণী। যা এখনো অনাবিষ্কৃত। এজন্য অনুসন্ধান ও গবেষণার স্বার্থে আধুনিক জাহাজ, ডুবুরি ও যন্ত্রপাতিও নেই। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০১৪ ও ১৫তে বিশেষভাবে জীববৈচিত্র ও বন্যপ্রাণীসংরক্ষণের কথা উল্লেখ রয়েছে। এজন্য ন্যাশানাল বায়োডাইভার্সিটি এন্ড অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে ড. আনিসুজ্জামান খান বলেন, এগুলো বাস্তবায়নে সাংগঠনিক কোনো কাঠামো নেই। এক হলো- ন্যাশানাল বায়োডাইভার্সিটি রক্ষা ও সারাদেশে বন্যপ্রাণী দেখভাল করতে পরিবেশ অধিদফতরের লোকবল ও কার্যক্রম নেই। অথচ সংস্থাটি ন্যাশনাল বায়োডাইভার্সিটির তত্ত্বাবধায়ক ও নিমন্ত্রণকর্তা। দুই হলো- বন বিভাগ, তারা বন রক্ষা না করে বনের গাছ কেটে ব্যবসা করায় ব্যস্ত। তাহলে অভয়ারণ্য-ন্যাশনাল পার্ক রক্ষা ও পরিচালনা করবেকারা?

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘সরকার বন্যপ্রাণীর জন্য যে ৩৮টি অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছে তা কার্যকরি অর্থে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই বলা যায়, বন্যপ্রাণীরা অভয়ারণ্যেও নিরাপদ নয়।’

এই প্রাণীবিদের দাবি, এই ৩৮টি অভয়ারণ্যের জমির পরিমাণ দেশের মোট জমির ১ শতাংশেরও কম। বাকি ৯৯ শতাংশ বিল, খাল, নদী, বন, বাড়ির পেছনের ঝোঁপ-ঝাড়। এগুলো রক্ষায় কিন্তু সরকারের কোনো পরিকল্পনা বা প্রোগ্রাম নেই।

একদিকে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ও সংখ্যা যেমন কমে আসছে অপরদিকে সুখের খবর হচ্ছে, বর্তমানে সাধারণ মানুষের মাঝে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের কারণে সচেতনতার হারও বৃদ্ধি পেয়েছে,বলেন ড. আনিসুজ্জামান খান।

তিনি বলেন, মিডিয়ার কারণে আগের চাইতে সচেতনতার মাত্রা বেড়েছে। এটির ইন্ডিকেটর হলো, আগে আমাদের দেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের কথা আমরা শুধু গুটি কয়েক বায়োলজিস্ট, পরিবেশবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিকরা বলতাম। কিন্তু এখন সাধারণ মানুষও পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী রক্ষার দাবি জানাচ্ছে। যা বোঝা যায়, সুন্দরবনে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বিরোধীতায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে। যা কিন্তু বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্যই।

ড. আনিসুজ্জামানের মতে, যদিও দেশেবন্যপ্রাণী রক্ষায় আইন আধুনিকায়ন করা হয়েছে। কিন্তু এটাকে বাস্তবায়ন করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে বা কোষাগার থেকে যে বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন তা গুরুত্ব পাচ্ছে না। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে যে মৌলিক তথ্য গবেষণা করা প্রয়োজন তা কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক অর্থে নেই। যদিও বাংলাদেশে স্বপ্রণোদিত হয়ে এ কাজটি গুটিকয়েক পরিবেশ পাগলাটে বিশেষজ্ঞরা করে আসছে। এছাড়া একটা প্রজাতি সত্যিকার অর্থে বিলুপ্তি হচ্ছে কিনা এজন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে গবেষণা করে বের করতে হবে। এসব কাজ আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারত, শ্রীলংকা এমনকি পাকিস্তানেও আছে। কিন্তু বাংলাদেশে তা খুবই দুর্বল। এছাড়া স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে এক ডজনেরও বেশি বিরল প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে। তবে এ সংখ্যা নিয়েও দ্বিমত রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঘ, ভাল্লুক, বন গরু এবং ছাগলসহ আরও বহু বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে বলে যে তথ্য দেওয়া হচ্ছে তা মোটা দাগে বলা হচ্ছে এবং জরিপ করে বলা হচ্ছে।প্রিয়.কম



মন্তব্য চালু নেই