কাপ্তাইয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায় চীন

কাপ্তাই (কর্ণফুলি) জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে নতুন করে আরো দু’টি ইউনিট নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে এক চীনা কোম্পানি। গত ৬ মার্চ পাওয়ার চায়না নামের প্রতিষ্ঠানটি বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠানো প্রাথমিক প্রস্তাবে এ আগ্রহের কথা জানায়। প্রস্তাবটিকে জরুরি উল্লেখ করে এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বিদ্যুৎ সচিব মনোয়ার ইসলামকে নির্দেশও দিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

পাওয়ার চায়না গত ৬ মার্চ দেয়া তাদের চিঠিতে জানিয়েছে, কোম্পানিটির ৭০ বিলিয়ন ডলারের নিজস্ব বিনিয়োগ স্বক্ষমতা রয়েছে। তাদের ১৫ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রও রয়েছে। এর মধ্যে কম্বোডিয়া, লাওসসহ বিভিন্ন দেশে স্থাপিত পাঁচটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে, যাদের উৎপাদন ক্ষমতা ৮৫৪ মেগাওয়াট। তারা নকশা প্রণয়ন, বিনিয়োগ, কেন্দ্র নির্মাণ ও সংরক্ষণে কাজ করে। কোম্পানিটি ১১০ দেশে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছে। গত বছর তারা মুনাফা অর্জন করেছে ২৪ বিলিয়ন ডলার।

তবে এ প্রস্তাবের বিষয়ে দু’টি ভিন্ন মত রয়েছে। খাত সংশ্লিষ্টদের অনেকেই বলছেন, পানির স্বল্পতায় বছরে অধিকাংশ সময়ই কাপ্তাই কেন্দ্রটি পূর্ণ ক্ষমতায় চালানো সম্ভব হয় না সেখানে নতুন ইউনিট স্থাপন অর্থনৈতিকভাবে যুক্তি সঙ্গত নয়। আরেক পক্ষ বলছে, বছরের চার-পাঁচ মাস কাপ্তাই হ্রদে পানির পরিমাণ বেড়ে যায়। এ অতিরিক্ত পানি দিয়ে নতুন ইউনিট চালানো সম্ভব। বছর কয়েক আগে দেয়া জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) একটি প্রস্তাবেও এমন ধারণা দেয়া হয়েছিল। সেখানে নতুন ইউনিট স্থাপনের স্থান সম্পর্কেও বলা হয়।

সূত্র জানায়, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ১৯৬২, ১৯৭৬ ও ১৯৮৪ সালে তিন দফায় ২৪২ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পাঁচটি ইউনিট স্থাপন করা হয়। প্রথম দু’টির উৎপাদান ক্ষমতা ৪৬ মেগাওয়াট করে। বাকি তিনটার উৎপাদন ক্ষমতা ৫০ মেগাওয়াট। অবশ্য বিগত বছরগুলোতে পানির স্বল্পতায় বছর জুড়ে সব ইউনিট চালানো সম্ভব হয়নি।

সূত্র আরো জানায়, কাপ্তাই হ্রদের ৭০ ফুট থেকে ১০৯ ফুট পর্যন্ত পানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। কিন্তু গত ১০ বছরের মধ্যে কেবলমাত্র ২০০৭ এবং ২০১৫ সালের কয়েকদিন পানির প্রবাহ রিজার্ভার উপচে পড়েছে। ২০১৪ সালেই পানির উচ্চতা ছিল মাত্র ৮৯ ফুট। বিগত অনেক বছর ধরেই এ অবস্থা চলেছে। এতে মৌসুমের শেষ দিকে কেন্দ্রর কয়েকটি ইউনিট বন্ধ রাখতে হয়। তবে ২০১৫ সালে পুরো বছরই এ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদনের হার ছিল ভালো।

গত জুলাই থেকে এ কেন্দ্র থেকে গড়ে প্রতি মাসে ১৬ কোটি ৮৮ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হচ্ছে। গত বুধবার চারটি ইউনিট চালু ছিল। যা দিয়ে ১৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।

কাপ্তাই কেন্দ্রের মালিক বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, ‘হ্রদে যে পরিমাণ পানি থাকে তা দিয়ে সারা বছর ধরে পাঁচটি ইউনিট চালানো সম্ভব হয় না। নতুন করে ইউনিট নির্মাণ করলে পৃথক বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু বছরের অধিকাংশ সময় তা বন্ধ থাকবে। এতে সংরক্ষণ এবং পরিচালনায় ব্যয় বেড়ে যাবে। ফলে এখন ২৭ পয়সায় (প্রতি কিলোওয়াট/ঘণ্টা) যে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে তা আর পাওয়া যাবে না। যা দেশের সামগ্রিক বিদ্যুতের দামের ওপর প্রভাব ফেলবে।’

তবে কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কাজ করেছেন পিডিবির এমন একজন প্রকৌশলী ভিন্ন মত প্রকাশ করে বলেন, ‘জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এ অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টি হয় তখন হ্রদে পানির পরিমাণ বেড়ে যায়। এ সময় অতিরিক্ত পানি কর্ণফুলী নদীতে ছেড়ে দেয়া ছাড়া বিকল্প থাকে না। এ বাড়তি পানিতে বছরের অর্ধেক সময়ও যদি নতুন দুই ইউনিট চালানো যায় তবে তা লাভজনক হবে।’

কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশেও (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম এ বিষয়ে বলেন, ‘আমাদের দেশে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের খুব বেশি সুযোগ নেই। তারপরও নতুন প্রস্তাবনা খতিয়ে দেখা উচিত। কারণ যতো সস্তায় বিদ্যুৎ পাওয়া যায় গ্রাহকের জন্য ততোই মঙ্গল। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের নূন্যতম সুযোগ যদি থাকে আর সেটা যদি অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হয়, তাহলে তা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যও ইতিবাচক হবে।’

উল্লেখ্য, সরকারেরও পরিকল্পনা রয়েছে কাপ্তাই কেন্দ্রে দুটি নতুন ইউনিট নির্মাণের। ১৯৯৮ সালেও এমন একটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এ সময় বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে ঋণের প্রতিশ্রুতি মিলেছিল বলেও জানা যায়। ইউনিট স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাই ও স্থান নির্ধারণের কাজও সম্পন্ন হয় তখন। কিন্তু নির্মাণ কাজ শুরু করতে গেলে স্থানীয় অধিবাসী ও জনপ্রতিনিধিরা বাধা দেয়। কারণ তাদের আশঙ্কা নতুন ইউনিট বসানো হলে কাপ্তাই হ্রদে আরো বেশি পানি ধারণ করতে হবে এবং বর্ষার সময় অনেক নতুন এলাকা পানিতে প্লাবিত হয়ে ঘরবাড়ি ও আবাদি জমি ডুবে যাবে। ফলে উদ্যোগটি থেমে যায়।’

পরবর্তিতে জাইকা এ প্রকল্পে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখায়। জাইকা ২০১৪ সালের দিকে এখানে ৪০ মেগাওয়াট করে দু’টি ইউনিট বসানোর প্রস্তাব দেয়। অর্থায়নও তারাই করতে চায়। তবে উৎপাদিত বিদ্যুতের ২০ ভাগ স্থানীয় ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে বিতরণের শর্ত দিয়েছিল দাতা সংস্থাটি। জাপানের একটি বিশেষজ্ঞ দল সে সময় কাপ্তাই এলাকায় এ সংক্রান্ত প্রাথমিক জরিপও চালিয়েছিল। তারা বলেছিল, কাপ্তাইয়ের পাশেই ১২০ মিটার উচ্চতার জমি রয়েছে। যার তিন দিকই পাহাড় দিয়ে ঘেরা। শুধু একপাশে বাঁধ দিয়ে নতুন ইউনিট বসানো যাবে। পরবর্তিতে অবশ্য প্রস্তাবটির অগ্রগতির কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এ কেন্দ্রের আরেকটি বড় সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে হ্রদে ড্রেজিং না করা। এতে হ্রদের তলদেশে মাটি জমে দিন দিন পানির ধারণক্ষমতা কমে যাচ্ছে।

প্রসঙ্গত, গত পঞ্চাশের দশকে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কর্ণফুলি নদীর রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই অংশে বাঁধ নির্মাণ করে। এটি মাটি ভরাট করে নির্মিত ৬৭০ দশমিক ৬ মিটার দীর্ঘ একটি বাঁধ। বাঁধটি ৪৫ দশমিক ৭ মিটার উঁচু। এ বাঁধের ফলে ১৭২২ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের হ্রদের সৃষ্টি হয়। বর্ষণ বেশি হলে আশপাশের আরও প্রায় ৭৭৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়।

অবশ্য পানি নির্গমণের জন্য বাঁধে ১২ দশমিক ২ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১১ দশমিক ৩ মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট মোট ১৬টি গেট রয়েছে। তবে এ প্রকল্পের কারণে সে সময় হাজার হাজার লোক ঘরবাড়ি, আবাদি জমি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়। বর্তমানে অবশ্য এখন থেকে গড়ে দেড়শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যোগ হয় জাতীয় গ্রিডে।



মন্তব্য চালু নেই