কার নির্দেশে খুন, জেনেও বলছে না পুলিশ!

১৫ ঘণ্টা আপনাকে কী জিজ্ঞাসা করা হলো? আপনি কি কোনো কাগজে সই করেছেন? আবার কি যেতে বলা হয়েছে আপনাকে? এ রকম অনেক প্রশ্নের একটিরও জবাব দেননি আলোচিত পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার।

বাবুলের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন বললেন, ‘স্যারেরা কথা বলতে না করেছেন। কিছু বলা ঠিক হবে না।’ জামাতার প্রতি অগাধ আস্থা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফের। বললেন, ভালো কাজের কারণে অনেকে পেশাগত দিক থেকে বাবুলকে অনেকে ঈর্ষা করেন। বাবুল সেই ঈর্ষার শিকার। এই কথোপকথন গতকাল রোববারের, মোশাররফ হোসেনের খিলগাঁওয়ের ভুঁইয়াপাড়ার বাসায়। এখানেই বাবুল তাঁর দুই সন্তানকে নিয়ে অবস্থান করছেন।

জামাতার প্রতি শ্বশুরের যত আস্থাই থাকুক না কেন, স্ত্রী মাহমুদা খানম (মিতু) হত্যা মামলার তদন্তকারীদের সন্দেহের তির বাবুলের দিকেই। এই সন্দেহের কারণেই গত শুক্রবার গভীর রাতে শ্বশুরবাড়ি থেকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বাবুলকে। বাড়ি ফিরে আসার পর থেকে তিনি কারও দেখা দিচ্ছেন না, কথাও বলছেন না। বাড়িতে দিন-রাত পুলিশ পাহারা দিচ্ছে।

তবে বাবুলকে জিজ্ঞাসাবাদ নিয়ে নানা কথা শোনা যাচ্ছে পুলিশ কর্মকর্তাদের ভেতরেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এ মামলার তদন্ত ‘ভাড়াটে খুনি’ ধরা পর্যন্তই থেকে যাবে। কিন্তু খুনিদের কে ভাড়া করল? সেই প্রশ্নের জবাব কেউ কখনো জানবে না। গতকাল রোববার এ মামলার দুই আসামি ওয়াসিম ও আনোয়ার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন, তাতেও মেলেনি কার নির্দেশে এই খুনের ঘটনা ঘটেছে।

বাবুলকে জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, জিজ্ঞাসাবাদ থেকে তাঁরা এমন সব তথ্য পেয়েছেন, যা শুনে নিজেরাই বিস্মিত হয়েছেন। কিন্তু বাহিনীর ভাবমূর্তির কারণে তাঁরা সেসব তথ্য প্রকাশ করতে পারছেন না।

৫ জুন এই হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই সরকারের মন্ত্রী ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলে আসছিলেন, জঙ্গিরাই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
এ কারণে দেশব্যাপী এক সপ্তাহ জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালানো হয়। কিন্তু তদন্তের একপর্যায়ে এসে জঙ্গিদের সংশ্লিষ্টতার ধারণা উবে যায়। এখন বলা হচ্ছে, এ হত্যাকাণ্ডে কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। বরং ভাড়াটে খুনিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বাদী বাবুল আক্তারকে সন্দেহ করা হচ্ছে।

জবানবন্দি দেওয়ার পর চট্টগ্রাম আদালত থেকে বেরিয়ে আসছেন মাহমুদা খানম হত্যা মামলার দুই আসামি আনোয়ার (বাঁয়ে) ও ওয়াসিম। ছবিটি গতকাল রাত সাড়ে নয়টায় চট্টগ্রাম আদালত ভবন থেকে তোলা ষ সৌরভ দাশ‘পেশাদার অপরাধী’ মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিমই এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানমকে গুলি করে হত্যা করেছেন। গতকাল চট্টগ্রামে সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি করেন মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. ইকবাল বাহার। তবে কার নির্দেশে ও কী কারণে মাহমুদাকে খুন করা হয়েছে, তা তিনি বলেননি। হত্যাকাণ্ডে ওয়াসিমের সহযোগী মো. আনোয়ারকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ইকবাল বাহার বলেন, মোটরসাইকেল অরোহী যে তিন যুবক হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন, তাঁদের একজন ওয়াসিম। আর আনোয়ার ঘটনাস্থলের আশপাশে ছিলেন।

গতকাল ওয়াসিম ও আনোয়ারকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম মোহাম্মদ হারুন অর রশিদের আদালতে হাজির করে পুলিশ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার মো. কামরুজ্জামান বলেন, গত শনিবার ওয়াসিমকে নগরের বাকলিয়া এলাকা থেকে এবং আনোয়ারকে ফটিকছড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওয়াসিমের বাড়ি রাঙ্গুনিয়ার রাজানগর গ্রামে, বাবার নাম আবদুল নবী। আর আনোয়ারের বাড়ি ফটিকছড়ির রাঙ্গামাটিয়া গ্রামে, বাবার নাম শামসুল আলম।

৫ জুন সকালে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় চট্টগ্রামের জিইসি এলাকায় গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন মাহমুদা খানম। ঘটনার পর পুলিশ জানায়, জঙ্গি দমনে বাবুল আক্তারের সাহসী ভূমিকা ছিল। এ কারণে জঙ্গিরা তাঁর স্ত্রীকে খুন করে থাকতে পারে। হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল অজ্ঞাতপরিচয় তিন ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করেন।

পুলিশ কমিশনার ইকবাল বাহার বলেন, খুনে অংশ নেওয়া আসামিরা সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। তাঁরা পেশাদার অপরাধী। কার নির্দেশে তাঁরা খুনে অংশ নিয়েছিলেন তা বলা যাচ্ছে না। সম্ভাব্য সব বিষয় সামনে রেখে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না। হত্যাকাণ্ডে সাত-আটজন অংশ নেন। বাকি আসামিদেরও শনাক্ত করা গেছে। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্রটি উদ্ধার করা যায়নি।

কমিশনার আরও বলেন, ‘মাহমুদা হত্যাকাণ্ড টার্গেট কিলিং। কারা, কেন করিয়েছে, বলা যাচ্ছে না। নিশ্চিত না হয়ে বলা যাচ্ছে না জঙ্গি, চোরাচালানি কিংবা বিরোধী কোনো গোষ্ঠী এই ঘটনা ঘটিয়েছে কি না।’ কেন কার নির্দেশে পেশাদার অপরাধীরা মাহমুদাকে খুন করেছেন, সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তদন্ত শেষ হলে বলতে পারব।’

গত শুক্রবার রাতে বাবুল আক্তারকে বাসা থেকে পুলিশ পাহারায় ডেকে নিয়ে ঢাকায় ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ প্রসঙ্গে পুলিশ কমিশনার বলেন, বাবুল আক্তার মামলার বাদী। তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতে তাঁকে আনা হয়েছে। ঘটনার পর থেকে বাবুল আক্তারের নিরাপত্তায় পুলিশ পাহারা রয়েছে। তাঁকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে কি না, এর জবাবে তিনি বলেন, নজরদারিতে কেন রাখা হবে? কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে সরাসরি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়া হচ্ছে বাবুল আক্তারের শ্বশুরের এ অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘তিনি কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে বলেছেন, জানি না। মামলার যাতে সুষ্ঠু তদন্ত হয় সেই চেষ্টা করা হচ্ছে।’

পুলিশ কমিশনার বলেন, গ্রেপ্তার দুই আসামি আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে অনেক তথ্যই দিয়েছেন। তদন্তের স্বার্থে বলা যাচ্ছে না। তাঁরা হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন।

ঘটনার পর গ্রেপ্তার আবু নছর ওরফে গুন্নু ও শাহজামান ওরফে রবিনের কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি বলে জানান পুলিশ কমিশনার। পুলিশের সংগ্রহ করা ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, মাহমুদা খানম তাঁর ছেলেকে নিয়ে ও আর নিজাম রোডের বাসা থেকে বের হয়ে জিইসি মোড়ের দিকে যাচ্ছিলেন। একই সময় রাস্তার অপর প্রান্তে জিন্স প্যান্ট ও চেক শার্ট পরা এক যুবককে মুঠোফোনে কথা বলতে দেখা যায়। তিনি সড়ক বিভাজক অতিক্রম করে মাহমুদার পিছু নেন এবং ঘটনাস্থলের দিকে এগিয়ে যান।

ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, তিন যুবক প্রথমে মাহমুদা খানমকে মোটরসাইকেল দিয়ে ধাক্কা দেন। মোটরসাইকেলটিতে বসা (চালকসহ) তিন যুবকের মধ্যে দ্বিতীয়জন মাহমুদার বুকে, হাতে ও পিঠে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করেন। তৃতীয়জন পিস্তল দিয়ে গুলি করেন। ৪০ থেকে ৫০ সেকেন্ডের মধ্যে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। সূত্র: প্রথম আলো



মন্তব্য চালু নেই