কিছু বুঝে ওঠার আগেই অস্ত্রধারীরা হামলা চালায়

ঘড়ির কাটায় তখন রাত সাড়ে দশটা। অবরুদ্ধ হলি আর্টিজান বেকারির কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন একদল পুলিশ। ছোট একটা হ্যান্ড মাইক দিয়ে আর্টিজান চত্বরে ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে এক কর্মকর্তা জিম্মিকারীদের উদ্দেশ্যে বলছিলেন- ‘ভেতরে কে কে আছেন, বের হয়ে আসুন’।

বাক্যটি একবার বলতে না বলতেই দুম দুম করে ফাটানো হলো বোমা। ভেতর থেকে ছোড়া হলো গুলি। পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। বাকিরা দৌড়ে পিছু হটলেন।

এখানেই আহত হওয়ার পর হাসপাতালে নেওয়া হলে মারা যান ডিবির সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দীন খান।

প্রত্যক্ষদর্শী একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘দেখলাম বিস্ফোরণের পরে সালাহউদ্দীন স্যার দুই পা হেঁটে রাস্তার ওপর পড়ে গেলেন। আমরা কেউ ভয়ে তাঁকে ধরতেও যাইনি। আামি দৌড়ে এলাম।’ তিনি বলেন, এভাবে আঘাত আসতে পারে তা কখনো ভাবেননি তিনি। বিষয়টা এ রকম ছিল যেন তাঁরা কোনো সাধারণ দাঙ্গা দমনে যাচ্ছেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অস্ত্রধারীরা হামলা চালিয়ে বসে। পুলিশের ওই দলটিতে থাকা প্রায় সবাই কমবেশি আহত হন। আহত হওয়ার পরে কয়েকজনকে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়াতে দেখা যায়।

বেশ কিছুক্ষণ মাটিতে পড়ে থাকার পরে পুলিশের একটি গাড়ি নিয়ে গিয়ে সালাহউদ্দীন খানকে উদ্ধার করে পাশের ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়। এরপর থেকেই মূলত কর্মকর্তারা আরও সতর্ক হন। এ সমস্ত ঘটনা মোকাবিলার জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশ বিশেষায়িত ইউনিট সোয়াত গঠন করেছিল। সোয়াত ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায় রাত ১১ টা ১৯ মিনিটে। সোয়াতের কর্মকর্তাদের কিছু প্রস্তুতি নিতে দেখা যায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে তাঁরাও অপেক্ষমাণদের সারিতে যুক্ত হন।

র‍্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে এসে অভিযানের সমন্বয় ও নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।

রাত ১২টার দিকে পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, রক্তপাত না ঘটিয়ে বিষয়টির সুরাহা করার জন্য ওপর থেকে বলা হয়েছে। কিন্তু সে পন্থাটা কী তা কেউ জানেন না।

রাত একটার দিকে কর্মকর্তাদের ব্যস্ত দেখা গেল ঘটনাস্থলের মানচিত্র তৈরি, রেস্তোরাঁ ভবনটির খুঁটিনাটি তথ্য নিতে। এ জন্য তাঁরা ওই রেস্তোরাঁ থেকে বের হতে পারা কর্মীদের সাহায্য নিচ্ছিলেন।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহস্রাধিক সদস্য ঘটনাস্থলে এলেও তারা আসলে কী করছেন তা বোঝা যাচ্ছিল না। একজন কর্মকর্তা বলেন, অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেছেন, মনে হয় অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই।

কর্মকর্তাদের অপেক্ষা যেন সহ্য করতে পারছিলেন না ভেতরে আটকে পড়াদের স্বজনেরা। তাঁরা বারবারই পুলিশের নিরাপত্তা সীমা অতিক্রম করে ভেতরে ঢুকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছিলেন।

রাত দেড়টার দিকে ঢাকা মহানগর ডিবির যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেনকে আটকে এক মা জানতে চান, ‘আপনারা কী করছেন। ভেতরে আমাদের ছেলেমেয়েরা কেমন আছে।’ আবদুল বাতেন ওই নারীকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে বলেন, ‘ভেতরের সবাই নিরাপদে আছে বলে আমরা মনে করছি।’ ওই নারী কিছুতেই হাল ছাড়ছিলেন না। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তারাই বা কী করবেন।

রাত যত গড়াতে থাকে, আটকে পড়া ব্যক্তিদের স্বজনদের ভিড় ততই বাড়তে থাকে। এদের মধ্যে অনেক নারী ও বৃদ্ধও ছিলেন। এর মাঝেই হঠাৎ করে বৃষ্টি নামে। লোকজন দৌড়ে আশপাশের ভবনগুলোতে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু নিরাপত্তারক্ষীরা দরজা খুলছিলেন না। এক মিনিটের মধ্যেই অবশ্য থেমে যায় বৃষ্টি।

এর মধ্যেই সেখানে আসেন আর্টিজান বেকারির কর্মী সুমন হক। জিম্মিকারীরা রেস্তোরাঁটিতে ঢোকার পরে সুমন দোতলার ছাদ থেকে লাফিয়ে বের হয়েছিলেন। সুমন বলেন, রাত সাড়ে আটটার কিছু পরে রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়ে অস্ত্রধারীরা। ঢুকেই তাঁরা আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়া শুরু করে। অস্ত্রধারীরা ঢোকার পরেও তিনি সেখানে প্রায় ২৫ মিনিট ছিলেন। এরপর কোনোরকমে দোতলার ছাদ থেকে লাফিয়ে বের হয়ে আসতে সক্ষম হন।

বনানীর ৭৮ নম্বর সড়কের মাথায় দাঁড়িয়ে যখন সুমন এসব কথা বলছিলেন তখনই এক নারী ছুটে এসে জিজ্ঞেস করেন ‘ভেতরে সবাই ভালো আছে তো। আপনি দেখেছেন তো ওরা ভেতরে কাউকে কিছু করেনি? ওরা কী চায়, আমাদের ছেলেমেয়েদের কাছে ওরা কী চায়।’ প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন সুমন। অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি কী করে বলব বলেন। ভেতরে আমারও অনেক সহকর্মী রয়েছেন। তাদের কী অবস্থা তাই জানি না।’

আর একজন লোক জানান, তাঁর ছেলে গতকালই ফিরেছে কানাডা থেকে। বন্ধুদের সঙ্গে একটা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সেখানে গিয়েছিল। এরপর আর কোনো খোঁজ নেই। এক ভারতীয় দম্পতি অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছিলেন তাঁদের স্বজনের জন্য।

আর্টিজান বেকারির কর্মী সুমন জানান, ভেতরে ২০ জনের মতো বিদেশিসহ সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ জনের মতো জিম্মি রয়েছেন। তিনি বলেন, তাঁদের রেস্তোরাঁয় মূলত বিদেশি নাগরিক ও দেশি বিত্তবান ব্যক্তিরাই আসেন।



মন্তব্য চালু নেই