কিশোরগঞ্জ উপজেলায় সমতল জমিতে চা চাষে ব্যাপক সাফল্য

খাদেমুল মোরসালিন শাকীর, কিশোরগঞ্জ (নীলফামারী) প্রতিনিধি: পতিত জমিগুলো পরিণত হয়েছে দুটি পাতা একটি কুড়িঁর ফসল চা চাষের জমিতে। পাহাড়ী এলাকার ফসল হলেও সমতল ভূমিতে দেখা দিয়েছে চা চাষের সাফল্য। তামাক চাষ খ্যাত সমতল ভূমিতেও চা চাষ শুরু হওয়ায় কৃষকদের মাঝে এ নতুন ফসল চাষে আগ্রহ সৃষ্টি যেমন হয়েছে, তেমনি পড়েছেও ব্যাপক সাড়া।

সবুজের সমারেহ কাইজেন টি গার্ডেন দেখার জন্য কিশোরগঞ্জ উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষজন প্রতিদিন বাগানের দিকে ছুটছে। চা পাতার সবুজ চাদরে ঢেকে গেছে গোটা উপজেলা পরিষদ চত্বর। অনেকে আবার সেলফি ও ফটো তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। উপজেলার প্রায় ১৭ একর পতিত জমিতে সৃজিত চা বাগানগুলো সবুজ-সতেজ আর কর্মচঞ্চল হয়ে উঠছে। ১ বছর ৬ মাসে চা পাতা তোলা, উৎপাদন ও বাজারজাত শুরু হওয়ায় এ ফসল কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও উন্নয়নের প্রতীকি ফসলে রুপ নেয়ার উজ্জল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

অন্যান্য ফসলের চেয়ে চা চাষে অধিক মুনাফা হওয়ায় দুটি পাতা একটি কুড়িঁর খ্যাত নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার পরিচিতি ঘটার উম্মোচন দ্বার হয়েছে। চা বাগান থেকে চা পাতা উত্তোলন শুরু হওয়ায় সনাতন পদ্ধতিতে চা প্রক্রিয়াজাত করে কাইজেন টি নামে বাজারজাত শুরু হয়েছে। স্থানীয় বাজারে ধীরে ধীরে এর কদরও বাড়ছে। তামাক চাষীদের চা চাষের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও উদ্বুদ্ধকরণ করে চা চাষ ব্যাপক হারে করে এ উপজেলাকে অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলা যাবে বলে অনেকের ধারণা।

কিশোরগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চত্বর প্রায় ২২ একর জমি নিয়ে অবস্থিত। পতিত জমিগুলো ব্যবহারের লক্ষ্যে পঞ্চগড়ে চা বোর্ডের কর্মরত কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে প্রথমে মাটি পরীক্ষা করে দেখা যায় এ এলাকার মাটি চা চাষের উপযোগি। তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার পুনর্বাসিত ভিক্ষুক-দরিদ্র মানুষদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও উপজেলার অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রাথমিক ভাবে ১ বিঘা জমিতে প্রায় ২ হাজার চা চারা রোপন করে চা চাষ করে আশাতিত ফল পায়। চা চারা রোপনের অল্প দিনে চা গাছ গজাতে শুরু করে।

পরবর্তীতে আরো চারা এনে উপজেলা পরিষদের পতিত প্রায় সাড়ে ৪ একর জমিতে চা চাষ শুরু করে। চা চাষ বৃদ্ধির লক্ষে পতিত প্রায় ৯ একর জমিতে চা চাষ শুরু করে। উপজেলার কেশবা গুচ্ছগ্রাম সংলগ্ন পতিত প্রায় ৩ একর জমিতে করা হয়েছে চা চাষ। এছাড়া চাষ করা হয়েছে মাগুড়া ইউনিয়নে তহশিল অফিসের ১ বিঘা ও উপজেলা ভূমি অফিসের ১৫ শতাংশ পতিত জমিতে। চা চাষের সাফল্য দেখে এ এলাকার কৃষকদের বিষবৃক্ষ তামাক চাষের পরিবর্তে চা চাষের দিকে আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

শুরু যেভাবে : নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলায় কর্মসংস্থানের তেমন সুযোগ না থাকায় উপজেলার পুনর্বাসিত ভিক্ষুক-দরিদ্র মানুষজন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকটসহ বিভিন্ন সরকারী দপ্তর, ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে কি করে খাবে এ কথা ব্যক্ত করতেন। এসব ব্যক্তির কর্মসংস্থানের কথা চিন্তা করে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ২০১৫ সালে উপজেলা পরিষদের সিদ্ধান্তে ও জেলা প্রশাসনের পরামর্শে পরিষদের পতিত জমিতে চা চাষ শুরু করে।

কর্মসংস্থান সৃষ্টি : চা বাগান গুলো পুনর্বাসিত -দরিদ্রদের কর্মসংস্থানে পরিণত হয়েছে। কেউ এসে যদি বলতো কি করে খাবো তাকে ঘন্টা প্রতি ২০ টাকা করে শ্রমের মূল্য দিয়ে বাগানে কাজ করানো জন্য লাগানো হয়। দিনে ৮ ঘন্টা কাজ করে ১৬০ টাকা করে পারিশ্রমিক পায়। চা বাগানের ফলে অলস হাত গুলো কর্মের হাতে পরিণত হয়েছে। ফলে ওই পরিবারগুলোতে শুরু হয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। সৃজিত বাগানগুলোতে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৩৫ জনের কর্মসংস্থান সৃস্টি হয়েছে।

উন্নয়নের প্রতীকি ফসল : চা একটি অভিজাত ও দীর্ঘজীবি ফসল। চা চারা একবার রোপন করলে আনুমানিক ৭০ বছর কমপক্ষে ৫০ বছর উৎপাদন ক্ষমতা থাকে। বানিজ্যিকভাবে ৫০ বছর পাতা উত্তোলন করা যায়। চা চারা রোপনের ৩ বছর পর থেকে প্রতি বছরে একরে আনুমানিক ২ লক্ষ ৭০ হাজার থেকে ২ লক্ষ ৯০ হাজার টাকার পাতা উত্তোলন হয়। খরচ যেয়ে বছর ১ লক্ষ ৮০ হাজার থেকে ২ লক্ষ টাকা লাভ হয়। যা অন্যান্য ফসল থেকে আসে না। এছাড়া অন্যান্য ফসলে কোন বছরে কৃষকরা লাভের মুখ দেখতে পারে আবার কোন বছর লোকসান হয়। সেখানে চা চাষ প্রতি বছর একরে ১ লক্ষ ৮০ হাজার থেকে ২ লক্ষ টাকা লাভ দেয়। অন্যদিকে যে জমিতে কোন ফসল হয় না অথবা দিনের পর দিন পরে থাকতো এরকম পতিত জমিতে উৎপাদিত হচ্ছে চা গাছ। লোকসান বিহীন ফসলের চাষ, পতিত জমিগুলো ব্যবহার আর কর্মসংস্থান সৃস্টি হওয়ায় চা চাষ উন্নয়নের প্রতীকি ফসলের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

তামাকের পরিবর্তে চা চাষ : বিষবৃক্ষ তামাক চাষ খ্যাত এলাকা নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলা। তামাক চাষের ফলে এলাকার ধানসহ বিপুল পরিমাণ আবাদি জমি চলে যাচ্ছে তামাক চাষের কবলে। এতে জমি হারাচ্ছে উর্বরতা। তামাক চাষের ফলে তামাক চাষী, পরিবারের সদস্য ও পার্শ্ববর্তী লোকজনের স্বাস্থ্যহানিসহ নানা রকম রোগে ভুগতে থাকে। তামাক চাষ ক্ষতিকারক বুঝতে পেরে কৃষকরা তামাক চাষের পরিবর্তে পরিবেশ বান্ধব চা চাষের আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে জানা গেছে। এ ফসল এ এলাকার জন্য তামাকের বিকল্প ফসলে রুপান্তর হবে এমটাই ভাবছে অনেকে।

স্থানীয়ভাবে উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ : চা চারা রোপনের ১ বছর ৬ মাস থেকে চা পাতা উত্তোলন যোগ্য হওয়ায় তা তুলে সনাতন পদ্ধতিতে চা তৈরি করা শুরু হয়েছে। কাচাঁ পাতা উত্তোলন করে প্রথমে বাছাই করা হয়। এর কাঁচা পাতা ঢেঁকি দিয়ে পিসিয়ে তা ভাজা হয়। ভাজা চা পাতার গুরাগুলো পরিস্কার করে চা তৈরি করা হয়। তাজা পাতা তাজা খ্রান সমৃদ্ধ চা প্যাকেটজাত করে স্থানীয় বাজারে কেজি প্রতি ৩ শত টাকা বিক্রি শুরু হয়েছে।
কাইজেন টি ঃ স্থানীয়ভাবে তৈরিকৃত চায়ের নাম দেয়া হয়েছে কাইজেন টি। কিশোরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন অফিসসহ বাজারের দোকানগুলোতে কাইজেন টি বাজারজাত শুরু হওয়ায় এলাকার মানুষজন তা কিনে খাচ্ছে। এর কদরও দিন দিন বাড়ছে। তাজা পাতার তাজা চায়ের স্বাদে এলাকার মানুষ এ চা দিব্বি কিনছে।
উপজেলা পরিষদে চা বাগান হওয়ায় গোটা উপজেলা পরিষদ চত্বর চা পাতার সবুজ চাদরে ছেয়ে গেছে। প্রতিদিন কৃষকরা এ নতুন ফসলের চাষ পদ্ধতি জানার জন্য কাইজেন টি গার্ডেনের তদারককারী মোঃ রমজান আলী কাল্টুর কাছে আসছে বলে জানান। এছাড়া পার্শ্ববতী উপজেলার লোকজনও এ বাগান দেখার জন্য আসছে বলেও জানা গেছে। এদিকে চা বাগান পুনর্বাসিত ভিক্ষুকদের কর্মের স্থানে পরিণত হয়েছে। কাজ করে তারা তাদের পরিবারের আর্থিক চাহিদা মেটাতে পারছে বলে জানান। কাইজেন টি গার্ডেনে কর্মরত ভেড়ভেড়ী গ্রামের পুনর্বাসিত ভিক্ষুক ফাতেমা জানান- চা বাগানে কাজ করে ঘন্টা প্রতি ২০ টাকা দরে কাজ করে দিনে ১৬০ টাকা পাচ্ছি। এ অর্থ দিয়ে পরিবারের ছেলে-মেয়েকে নিয়ে সুখে দিন কাটাচ্ছি। কেশবা গ্রামের পুনর্বাসিত ভিক্ষুক শাহিনা জানান- কোন প্রশিক্ষণ ছাড়াই দেখে দেখে চা বাগানে কাজ করা শিখেছি। বর্তমানে পরিবারে কোন অভাব নেই।

কাইজেন টি গার্ডেনের তদারককারী মোঃ রমজান আলী কাল্টু জানান- কোন প্রশিক্ষণ ছাড়াই প্রথমে ১ বিঘা জমিতে চা চাষ শুরু করা হয়। এরপর বাংলাদেশ চা গবেষনা ইন্সটিটিউটের পঞ্চগড়ে কর্মরত সিনিয়র ফার্ম এসিস্টেন্ট মোঃ জায়েদ ঈমাম সিদ্দিকীর পরামর্শে অবশিষ্ট জমিতে চা চাষ করা হয়। ১ বছর ৬ মাসে পাতা উত্তোলন শুরু হওয়ায় তা সনাতন পদ্ধতিতে চা প্রক্রিয়াজাত করে স্থানীয় বাজারে বিক্রী করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ চা গবেষনা ইন্সটিটিউট পঞ্চগড়ে কর্মরত্ব সিনিয়র ফার্ম এসিস্টেন্ট মোঃ জায়েদ ঈমাম সিদ্দিকীর কাছে মুঠোফোনে এ এলাকার চা চাষ সর্ম্পকে জানতে চাইলে তিনি জানান- এ এলাকার মাটি চা চাষের জন্য খুবেই উপযোগী। চা চারা রোপন থেকে ১০০ বছর বেঁচে থাকে। তবে বানির্জিকভাবে ৫০ বছর পাতা উত্তোলন করা যায়। রোপনের ৩ বছর পর থেকে পাতা উত্তোলনের কথা থাকলে ১ বছর ৬ মাসে এ এলাকায় পাতা উত্তোলন করাযায়। বছরে একর প্রতি ২ লক্ষ ৭০ হাজার থেকে ২ লক্ষ ৯০ হাজার টাকার পাতা উত্তোলন সম্ভব। খরচ যেয়ে বছরে মুনাফা হবে ১ লক্ষ ৮০ হাজার থেকে ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত। কিশোরগঞ্জ উপজেলায় চা চাষ শুরু হওয়ার খবর পেয়ে বাংলাদেশ চা বোর্ডের পরিচালক মহোদয় কয়েক দফায় কিশোরগঞ্জ উপজেলার চা বাগান পরিদর্শন করেছেন বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের নর্দান বাংলাদেশ প্রজেক্টের কিশোরগঞ্জ উপজেলায় কর্মরত প্রকল্প প্রকৌশলী আবু হেনা মোঃ ময়নুল ইসলাম জানান- চা চাষের জন্য এ এলাকার মাটি খুবেই উপযোগি। পাহড়ী অঞ্চলে যেখানে ৩ বছরে পাতা উত্তোলন শুরু হয়, সেখানে এ এলাকায় ১বছর ৬ মাসে পাতা উত্তোলন হচ্ছে। চলতি বছরে কিশোরগঞ্জ উপজেলায় কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে ১ লক্ষ্য চা চারা রোপনের জন্য বিতরণ করার টার্গেট নেয়া হয়েছে। উপজেলা পরিষদে সরকারীভাবে চা নার্সারী তৈরির কাজও শুরু হয়েছে। এছাড়া আগামী ২০২০ সালের মধ্যে নীলফামারী জেলায় ২৫ হেক্টর জমি চা চাষের আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে বাংলাদেশ চা বোর্ডের। তিনি আরো জানান- চা চাষ বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও পরিচালক খূবেই আন্তরিক। তিনি আরো জানান- তামাক চাষের বিকল্প হিসেবে চা চাষে বাংলাদেশ চা বোর্ড নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এখ পর্যন্ত ৬ জন তামাক চাষী চা চাষের জন্য নিবন্ধন করেছে বলেও তিনি জানান।

চা চাষের ফলে কি পরির্বতন হয়েছে এমন প্রশ্নের উত্তরে উপজেলা নির্বাহী অফিসার এসএম মেহেদী হাসান জানান- চা চাষের ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আনুমানিক ৫০ জন পুনর্বাসিত ভিক্ষুকের কর্মসংস্থান সৃস্টি হয়েছে। তাছাড়া তামাক চাষের বিকল্প হিসেবে চা চাষে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চলছে। ইতোমধ্যে কয়েকজন তামাক চাষী চা চাষের অভিমত ব্যক্ত করেছে ও নিবন্ধনও করেছেন।

চা চাষ কেন এ প্রশ্নের উত্তরে সাবেক উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও বর্তমান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, নড়াইল মোঃ সিদ্দিকুর রহমান জানান- পুনর্বাসিত ভিক্ষুকদের কর্মসংস্থান, কিশোরগঞ্জ উপজেলার আর্থিক উন্নয়ন ও উপজেলা পরিষদের আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে চা চাষ শুরু করা হয়েছে। চা বাগানের নাম কাইজেন টি গার্ডেন রাখার উদ্দেশ্য জানতে চাইলে তিনি জানান- কাইজেন জাপানী শব্দ। কাই শব্দের অর্থ- ছোট আকারে পরিবর্তন আর জেন শব্দের অর্থ- ভালো। এককথায় কাইজেন শব্দের অর্থ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আকারে ভালোর জন্য পরিবর্তন।

উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ রশিদুল ইসলাম জানান- চা চাষ একদিকে যেমন উপজেলা পরিষদের রাজস্ব বৃদ্ধি করবে অন্যদিকে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। আমাদের চা চাষে সাফল্য দেখে অনেক কৃষক তামাক চাষের পরিবর্তে চা চাষের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। এছাড়া চা চাষে আমরা কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি। চা চাষের ফলে এ উপজেলার আমুল উন্নতি হবে।



মন্তব্য চালু নেই