কিসের টানে আইএসে যোগ দেয় তরুণরা?

”আমরা তোমাদের রোম জয় করব, তোমাদের ক্রুশগুলো সব ভেঙে ফেলব এবং তোমাদের নারীদের দাসী বানাবো, মহান আল্লাহ তায়ালার অনুমতিতেই আমরা এসব করব। আল্লাহ তায়ালাই আমাদের এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন; তিনি মহিমান্বিত এবং তিনি তার প্রতিশ্রুতি পালনে কখনোই ব্যর্থ হন না। আমরা যদি এসব করতে না পারি তাহলে আমাদের সন্তান এবং তাদের সন্তানরা এসব করে দেখাবে এবং তারা তোমাদের সন্তানদের দাস হিসেবে বাজারে বিক্রি করবে।”

ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্ট (আইএসআইএল বা আইএস) এর ম্যাগাজিন ‘দাবিক’ এ প্রকাশিত পশ্চিমের প্রতি এই হুমকি মধ্যযুগীয় হুমকির মতোই শোনায়, আসলেই তাই, কারণ এরা মধ্যযুগীয়ই বটে। ম্যাগাজিনটির নামকরণ করা হয়েছে সিরিয়ার একটি স্থানের নামে। প্রাচীন অনেক মুসলিম কিংবদন্তি মতে, এই দাবিক নামক স্থানেই মুসলিম ও কাফের বা অবিশ্বাসীদের মাঝে এক চূড়ান্ত প্রলয়ঙ্করী যুদ্ধ হবে।

কিন্তু ২০১৪ সালে এসে এমন মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কেন কেউ সন্ত্রাসী হয়ে উঠছে তা অনেকের কাছেই বোধগম্য নয়। আইএসআইএল সম্পর্কে প্রচলিত একটি সাধারণ ধারণা, সংগঠনটি ধর্মান্ধ ও মানসিকভাবে বিকৃত লোকদের নিয়ে গড়ে উঠেছে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, বেশির ভাগ জঙ্গিই চিকিৎসাগতভাবে উন্মাদ নয়। তবে এদের অনেকেই নিরক্ষর; অন্তত ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞানের বিষয়ে এদের অনেককেই নিরক্ষরই বলা চলে।

মানুষের চরমপন্থী হয়ে ওঠার পেছনে যেসব কারণের কথা বলা হয় তার একটি হলো, নিশ্চয় বিশেষ কোনো একটা অস্বাভাবিকতা বা পাগলামি এবং বিশেষ কোনো বিকারগ্রস্ততার কারণেই লোকে চরমপন্থী হয়ে ওঠে। তবে বাস্তব তথ্য-উপাত্ত থেকে অবশ্য এই বিষয়টা আসলে কী তা কখনোই বের করে আনা সম্ভব হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ ম্যারিল্যান্ডের ন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম ফর দ্য স্টাডি অফ টেররিজম অ্যান্ড রেসপন্স টু টেররজিম এর ড. টনি লেমিয়াক্সও এমনটাই জানিয়েছেন।

বহুল প্রচলিত একটি ধারণা হলো, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং ব্যক্তিগত জীবনে দারিদ্র্যের কষাঘাতে অনেকে চরমপন্থী হয়ে ওঠেন। ”যারা সন্ত্রাসী হয়ে ওঠেন তাদের বেশির ভাগই বেকার, সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন যারা সমাজবিচ্যুত হয়েছেন,” এমনটাই লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অফ কংগ্রেসের রেক্স হাডসন। ১৯৯৯ সালে ‘দ্য সোসিওলজি অ্যান্ড সাইকোলজি অফ টেররিজম’ নামের একটি গবেষণাপত্রে এ কথা বলেন রেক্স হাডসন।

কিন্তু আইএসআইএল সারা বিশ্ব থেকেই জাতীয়তা ও শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে তাদের সদস্য সংগ্রহ করতে পারছে। এ থেকেই প্রমাণিত হয়, দারিদ্র্য বা সামাজিক বিচ্ছিন্নতাই কারো চরমপন্থী বা সন্ত্রাসী হয়ে ওঠার প্রধান কারণ নয়।

আর ব্যক্তিগত স্বার্থ ছাড়াও হাজার হাজার নারী পুরুষ ঠিক কিসের টানে চরমপন্থী ও সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোতে যোগ দেয় তা খতিয়ে বের করাটাও একটু কঠিনই বটে। কারণ একেকজনের উদ্দেশ্য একেক রকম।

”চরমপন্থী হয়ে ওঠার পেছনে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা সার্বজনীন কোনো কারণ নয়। অনেক নিঃসঙ্গ সন্ত্রাসীর ক্ষেত্রেই হয়তো এ কথাটি খাটে। কিন্তু অনেক সন্ত্রাসীরই পরিবার-পরিজন, সহকর্মী ও পাড়া-প্রতিবেশী আছেন। এদের মাঝে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের প্রতি এক ধরনের মোহ ও উৎকল্পনা কাজ করে। আর সেই মোহ ও উৎকল্পনার প্রতি এক অপ্রতিরোধ্য এবং অজানা আবেগের টান থেকেই মুলত এরা ‘ঐতিহ্যগত’ সামাজিক পরিমণ্ডল থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নেয়,” এমনটাই মত দিয়েছেন ড. জন হোরগান, যিনি ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস এর সেন্টার ফর টেররজিম অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ বিভাগে কর্মরত আছেন।

ড. টনি লেমিয়াক্স বলেন, ”দীর্ঘদিন ধরেই একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, একজন সন্ত্রাসীর নিশ্চয়ই বিশেষ কোনো প্রোফাইল বা পরিচিতি আছে। কিন্তু বছরের পর বছর চেষ্টা করেও তা বের করা সম্ভব হয়নি বরং পণ্ডশ্রম হয়েছে শুধু।”

কিন্তু আইএসআইএল কেন এত সংখ্যক বিদেশি নাগরিককে তাদের দলে ভেড়াতে সক্ষম হয়েছে তার যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ রয়েছে।

আইএসআইএল যে পরিমাণ জনবল, সম্পদ ও অস্ত্রশস্ত্র অর্জন করেছে তা এর আগে আর কোনো ইসলামী সন্ত্রাসী সংগঠনের হাতে দেখা যায়নি। এমনকি লেবাননভিত্তিক শিয়া মুসলিমদের সংগঠন হিজবুল্লাহর মতো শক্তিশালী আঞ্চলিক সংগঠনকেও ছাড়িয়ে গেছে আইএস এর সক্ষমতা। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এক নতুন ধরনের রাষ্ট্র গড়ে তোলার স্বপ্ন। আর এই রাষ্ট্র গড়ে তোলার ধারণাটিই আইএসকে বিশেষ বাস্তব ন্যায্যতা দিয়েছে।

”আল-কায়েদা কখনোই আইএস এর মতো স্বভূমি গড়ে তুলতে পারেনি। আইএসআইএল কোনো ধারণা গ্রহণ করার পর সেটির বাস্তাবায়নও ঘটিয়েছে। এ ছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রেও বিজয় লাভের মাধ্যমে এবং ভূমি দখল করে নিজেদের সক্ষমতা ও সম্ভাবনা প্রদর্শন করেছে আইএস,” বলেছেন লেমিয়াক্স।

আর আইএসআইএল যে উচ্চমানসম্পন্ন গণমাধ্যম কার্যক্রম চালায় তাও সম্ভবত কোনো এক অসাধারণ মেধাবী আমেরিকান নাগরিকের মাথা থেকে এসেছে; যা নজিরবিহীন।

”এমন নয় যে, এর আগে আর কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন মানুষের মাথা কেটে তা ভিডিও করে প্রচার করেনি। গত একদশক ধরেই আমরা এমন বহু ঘটনা দেখে এসেছি। কিন্তু নতুন যা ঘটছে তা হলো, এত সংখ্যক ভিডিও এর আগে আর কখনো প্রকাশ করা হয়নি। আর নিষ্ঠুরতাও এমনভাবে মাত্রা ছাড়িয়ে যায়নি। মাত্র এক বছরেই ক্রুশবিদ্ধকরণ, গণহারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর, লোককে দিয়ে নিজেদের কবর খোঁড়ানোর মতো এতটা লোমহর্ষক দৃশ্যের ভিডিও আগের কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনই প্রচার করেনি,” বলেন লেমিয়াক্স।

এই বীভৎসতা প্রদর্শনের মাধ্যমে আইএস যুদ্ধক্ষেত্র এবং বিজিত অঞ্চলের জনগণের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী নজিরবিহীন প্রচারণা পেয়েছে। আর এই ব্যাপক প্রচারণাই জঙ্গি সংগঠনটির সদস্য সংগ্রহে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।

লেমিয়াক্স বলেন, ”আইএস যে বর্বরতা প্রদর্শন করেছে তা দেখে অনেকেরই মনে হতে পারে শুধু সহিংসতার জন্যই বু্ঝি সহিংসতা করা হচ্ছে। কিন্তু এর মাধ্যমে আইএস মূলত সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালিয়েছে। জেমস ফলির শিরশ্ছেদের ভিডিও প্রচার করে আইএস আন্তর্জাতিকভাবে যতটা পরিচিতি পেয়েছে তা এর আগে আর কখনো পায়নি সংগঠনটি। আর এতে শক্তিশালি কোরিওগ্রাফির যে নমুনা দেখানো হয়েছে তাও নজিরবিহীন।”

তবে আইএস এর প্রচারণার এই কৌশল যে গড়পড়তা সব মানুষকেই আকৃষ্ট করবে তা নয়। লেমিয়াক্স বলেন, কেউ যখন আইএস এর প্রচারণায় গভীরভাবে মগ্ন হয় তখন তারা বিষয়টিকে একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে শুরু করে। আর আইএস ইহকাল ও পরকালে যেসব পুরস্কারের কথা বলে সে সবের লোভেও অনেকে এর প্রতি আকৃষ্ট হয়।

”আইএস এর প্রচারণার একটি কথোপোকথন এমন, এখানকার জীবন অতটা খারাপ নয়; এখানে ভালো পরিস্থিতিই বিরাজ করছে। এখানে আসলে তুমি বিয়ে করতে পারবে এবং এই নতুন স্থান ও ধারণার অংশ হতে পারবে। আর আইএস যে নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করছে তাকে গণহত্যা হিসেবে বিবেচনা না করে বরং একে একটি ন্যায্য লড়াই হিসেবে গণ্য করা হয়। ধারণাটি হলো এমন যে, তুমি সিরিয়া ও ইরাকে এসে এই বিশাল অনুপাতের সংঘাতে অংশগ্রহণ করতে পারো, ইতিহাসে ঘটে চলা তাৎপর্যপূর্ণ কিছু একটার অংশ হতে পারো,” বলেন লেমিয়াক্স।

সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে মাইকেল মোহাম্মদ নাইট তার আমেরিকান ক্যাথলিক স্কুল ছেড়ে পাকিস্তানের একটি মাদ্রাসায় পড়তে যাওয়ার পেছনের কারণ ব্যাখ্যা করেন। কিসের টানে তিনি পাকিস্তানের মাদ্রাসায় পড়তে যান সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে মাইকেল বলেন, ”কোরআন শিক্ষার কোনো পাঠচক্রে পড়া কোনো কোরআনের আয়াত আমাকে এই যুদ্ধে যোগদানে উদ্বুদ্ধ করেনি। বরং আমার আমেরিকান মূল্যবোধই আমাকে এ কাজে অনুপ্রাণিত করেছে। আমেরিকানরা যেমন করে দেশের প্রতি তাদের ভালোবাসা ও মনের টান থেকেই মার্কিন সেনাবাহিনীতে কাজ করতে যায় তেমনি আমিও নিপীড়নের বিরুদ্ধে এবং অপরের নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষায় লড়াইয়ের জন্য আমার ব্যক্তিগত আকুতি থেকে এতে যোগ দিয়েছি।”

এমনও হতে পারে যেসব তরুণ কখনোই তাদের দেশের জন্য হয়ে লড়াই করার সুযোগ পায়নি তারা হয়তো কোথাও না কোথাও নিজেকে সম্পৃক্ত করতে চাইছে এবং বিশ্বাস করার জন্য কিছু একটার অনুসন্ধান করছে। আর এ থেকে, কেন হাজার হাজার পশ্চিমা মুসলিম তাদের আরাম-আয়েশের জীবন ছেড়ে ইরাক ও সিরিয়ায় আইএস এর সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দিতে গেছে তারও একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে।
ব্যক্তিগত প্রেরণা যাই হোক না কেন, বাস্তবতা হলো আইএসআইএল এর সদস্য সংগ্রহের কৌশল খুব ভালোভাবেই কাজ করছে। আর যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের সঙ্গে যেভাবে এর যুদ্ধ বেড়ে চলেছে সেটাই হয়তো চায় আইএস।

লেমিয়াক্স বলেন, ”আইএস যে বয়ানে প্রচারণা চালায় তার মধ্যে খাবি না খেয়ে বরং আমাদেরকে এর পাল্টা বয়ান খাড়া করার ব্যাপারে পরিষ্কার করে চিন্তা করতে হবে। আর আইএস আসলে সর্বব্যাপী একটি যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে চাচ্ছে। এর জন্যই আইএস প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে; এই সর্বব্যাপী যুদ্ধ বাধানোই তাদের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।”

সূত্র : বিজনেস ইনসাইডার



মন্তব্য চালু নেই