কীভাবে বাঁধা পেরোতে হয় : জানালেন বেয়ার গ্রিলস

বেয়ার গ্রিলস দুঃসাহসী এক অভিযাত্রীর নাম। ডিসকভারি চ্যানেলের ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড অনুষ্ঠানের সঞ্চালক হিসেবেই তিনি বহুল পরিচিত। যুক্তরাজ্যে তিনি সবচেয়ে কম বয়সে প্রধান স্কাউট স্বীকৃতি পেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের জিকিউ সাময়িকীতে তিনি লিখেছেন, কীভাবে বাঁধা পেরোতে হয়।

আমার মনে আছে, তখন আমি বেশ ছোট। প্রচণ্ড শীতের সকালে বাবা আমাকে সমুদ্রের পাড়ে ঘোড়ায় চড়াতে নিয়ে গেলেন। প্রথমে আমাদের ঘোড়া খানিকটা দুলকি চালে হাঁটল, এরপর একসময় দৌঁড়াতে শুরু করল। ঘোড়ার গতির কারণে আমি কিছুক্ষণ পরপর ঘোড়ায় বাঁধা বসার আসন থেকে শূন্যে উঠে যাচ্ছিলাম। বেশ লাগছিল। মনে হচ্ছিল আমি উড়ছি। কিন্তু হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমি নিজেকে ঠাণ্ডা, নরম বালুর মধ্যে আবিষ্কার করলাম।

বাবা মুখে বড় একটা হাসির রেখা টেনে হাততালি দিতে দিতে আমার কাছে এগিয়ে এলেন। বললেন, ‘তুমি কতটা ভালো অশ্বারোহী, সেটা মূল কথা নয়। বরং কতবার পড়ে গিয়ে তুমি কতবার আবার ঘোড়ার পিঠে উঠে বসেছ, সে সংখ্যাটাই বড়। অশ্বারোহন আর জীবন—দুটো ক্ষেত্রেই এটা তোমার কাজে আসবে।’

বাবা সেদিন আমাকে জীবনের মূল মন্ত্রটাই ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি জানতেন, যদি কেউ প্রথম একটা কিছু শুরু করে, তবে কাজের কোনো এক মোড়ে এসে সে ওই নরম বালুতে নিজেকে আবিষ্কার করবেই। এটাকে বরং সুলক্ষণ হিসেবেই ধরে নেওয়া উচিত। অর্থাৎ তুমি যা করছ, তা নিশ্চয়ই অনেক বড় কিছু। কেননা, একটা সহজ পথ তোমাকে কখনো বড় কিংবা চমকপ্রদ কিছুর কাছে

নিয়ে যাবে না। বরং একটা ভয়ানক পথই অনেক অসাধারণ কিছু উপহার দিতে পারে। তাই আমাদের যোগ্যতা এটাই যে আমরা বারবার পড়ে গিয়েও আবার নতুন করে শুরু করলাম। যেমনটা ঘোড়ায় চড়তে গিয়ে আমরা করে থাকি। জীবনটাও অশ্বারোহনের মতোই।

আমি অনেকটা সময় যুক্তরাজ্যের স্পেশাল এয়ার সার্ভিসের প্রশিক্ষণ নিয়েছি। সেখানে গিয়ে দেখলাম কাজটা মোটেও সহজ নয়। বরং আমার দেখা সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল এটি। মাসের পর মাস প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর যখন কেউ তোমাকে জানাবে, তুমি আসলে তাদের যোগ্য হয়ে উঠতে পারছ না, তখন এটা খুবই মর্মাহত করবে। তখন দুটো উপায় ছিল, প্রশিক্ষণটা ছেড়ে দেওয়া কিংবা সেই নরম বালু থেকে উঠে দাঁড়ানো।

মনে করতে পার যেটা হচ্ছে না সেটা ছেড়ে দেওয়া ভালো। বেশির ভাগ সচেতন মানুষ তাই-ই করবে। কিন্তু আমি আবার নরম বালুর ওপর ভর করে উঠে দাঁড়ালাম। আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম—আমি নিজেকে যোগ্য করে তুলব। যদিও অনেকটা সময় লেগেছিল আমার। কিন্তু আমি পেরেছিলাম। এবং সেদিন আমি আরেকটি বিষয় জানতে পেরেছিলাম, সব সময় শক্তি কিংবা তোমার সামর্থ্য কতটুকু, সেটাই যথেষ্ট নয়। বরং তোমার মনে কতটুকু বিশ্বাস আছে, তাও জরুরি। নিজেকে জিজ্ঞেস করো, বারবার পড়ে যাওয়ার পরও কি তুমি উঠে দাঁড়াবে? বারবার?

হাল ছেড়ো না। কেননা, একেকটি ব্যর্থতা নতুন সাফল্যের কাছে এগিয়ে যাওয়ার একেকটি ধাপ। কারণ, যখন তুমি হাল ছেড়ে দেবে, তখনই তোমার কাঙ্খিত জিনিসটি তুমি হারাবে। এবং ঠিক তখনই তুমি হেরে গেলে। তুমি যদি কিছু চালিয়ে যাও, সেটাতে আর যা-ই হোক, একটা ফল পাবেই।

উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, ‘সাফল্যের যোগ্যতা হচ্ছে একটি ব্যর্থতা থেকে আরেকটি ব্যর্থতার কাছে ধরা দেওয়া, কিন্তু একই রকম উদ্যম নিয়ে।’ আমি যখন ফিরে তাকাই, তখন আমি অসংখ্য ভুল দেখতে পাই। একই সঙ্গে অনেক অর্জনও চোখে পড়ে। পৃথিবীতে অনেকে আছে, যারা তোমার সমালোচনা করবে। নতুন ব্যবসা শুরু করা, ম্যারাথনে অংশ নেওয়া কিংবা পদোন্নতি—যা-ই হোক না কেন। তোমাকে অবশ্যই বাঁধার সম্মুখীন হতে হবে। এবং সেখান থেকেই স্বপ্নটাকে ছিনিয়ে আনতে হবে।

তাই বলি, লেগে থাকো। মনে রেখ, কেউই বাঁধা ছাড়া কিছু করতে পারেনি। বড় কিছু করতে হলে অবশ্যই অনেক বাজে কিছুর মধ্য দিয়েই যেতে হবে। তবে যখন তুমি কিছু অর্জন করবে, তখন কেউ সেই বাঁধার কথা জানবে না। শুধু জানবে, তোমার কথা। তোমার অর্জনের কথা। তুমি পড়ে যাবে; আবার উঠে দাঁড়াবে। যেমনটি চার্চিল বলেছিলেন, ‘তুমি যখন সবচেয়ে বাজে মুহূর্তের মধ্য দিয়ে যাচ্ছ, তখনও থেমো না। চলতে থাকো।’

সব শেষে বলতে চাই, তুমি অবশ্যই অনেক ভালো কিছু পাবে যদি তুমি চেষ্টা করো। পড়ে যাও, আবার উঠে দাঁড়াও এবং চলতে থাকো। কিছু না কিছু তোমার জন্য থাকবেই। অনেকে তোমার স্বপ্ন চুরি করতে চাইবে। বলবে তুমি নির্বোধ। অহেতুক ছুটছ। কিন্তু তুমি পার্থক্যটা টের পাবে, যখন তুমি তোমার স্বপ্নচূড়ায় উঠে দাঁড়াবে। বিশ্বাস করো, স্বপ্নের চূড়ায় উঠে দাঁড়ানোর অনুভূতিটা অসাধারণ! প্রথম আলো



মন্তব্য চালু নেই