কুংফু মন্দির শাওলিন

চীনা অ্যাকশান চলচ্চিত্রের কল্যাণে শাওলিন মন্দির এখন বেশ পরিচিত এক নাম। জাপান-চীন-তাইওয়ানের চলচ্চিত্রগুলোতে শাওলিন মন্দিরকে কুংফু শেখানোর বিদ্যালয় হিসেবে দেখানো হলেও, মন্দিরটি মূলত জেন বুদ্ধতত্ত্ব অনুশীলনের অন্যতম তীর্থক্ষেত্র। হেনান প্রদেশের ঝেংঝৌ অঞ্চলে অবস্থিত সং পাহাড়ের সাতটি চূড়ার একটির উপরে প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিরটি। কিন্তু ঠিক কবে, অথবা কোন বৌদ্ধ ভিক্ষু এই মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন তা বলা যায় না। কিন্তু ধারণা করা হয়, মন্দিরটি তৈরি করার পেছনে ভারতবর্ষ থেকে বুদ্ধভদ্র ভিক্ষু নামে এক সন্ন্যাসীর অবদান আছে। অবশ্য, বর্তমানের শাওলিন মন্দির আর বুদ্ধভদ্রের শাওলিন আদর্শগত দিক দিয়ে এক হলেও, কাঠামোগত দিক দিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

সময়টা ৪৯৫ খ্রিষ্টাব্দ। চীনের উত্তরাঞ্চলে তখন উই সাম্রাজ্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ভারত থেকে আসা সন্ন্যাসী বুদ্ধভদ্রকে পছন্দ হয়ে যায় সম্রাটের। পছন্দ হওয়ার কারণে সম্রাট বুদ্ধভদ্রকে তার প্রাসাদেই বৌদ্ধ ধর্মের চর্চা চালাতে বলেন। কিন্তু বুদ্ধভদ্র সম্রাটের আমন্ত্রন প্রত্যাখ্যান করেন এবং পরবর্তী সময়ে সম্রাট তাকে নিজের মন্দির তৈরির অনুমতি ও জায়গা ঠিক করে দেন। আর সেই থেকেই একটু একটু করে বুদ্ধভদ্র তৈরি করলেন গোটা বিশ্ববিখ্যাত শাওলিন মন্দির।

মন্দির তৈরির ত্রিশ বছর পর বোধিভদ্র নামে অপর এক সন্ন্যাসী চীনে আসেন যোগ শিক্ষা দেয়ার জন্য। আজকে শাওলিন মন্দিরে আমরা যে ‘জেন’ বুদ্ধতত্ত্ব দেখতে পাই তাই মূলত বোধিভদ্রের সেই যোগ। গোটা চীন পরিভ্রমন শেষে তিনি আসলেন শাওলিন মন্দিরে এবং সেখানে ভর্তি হতে চাইলেন। কিন্তু মন্দিরের অধ্যক্ষ ফেং ক্যাং বোধিভদ্রকে ছাত্র হিসেবে গ্রহন করতে অস্বীকৃতি জানালেন। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর বোধিভদ্র নিকটবর্তী একটি পাহাড়ের গুহায় চলে যান এবং গুহার দেয়াল সামনে রেখে টানা নয় বছর তিনি ধ্যান করেন। দেয়ালকে সামনে রেখে তিনি এতটাই কঠোর ধ্যান করছিলেন যে দেয়ালে তার ছায়ারও দাগ হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে গুহার দেয়াল থেকে ওই ছায়ার দাগসমৃদ্ধ অংশটি তুলে এনে মূল মন্দিরে রাখা হয়। এখনও শাওলিন মন্দিরে পর্যটকরা ওই ছায়ার দাগটি দেখতে পারেন।

ধ্যানের নয় বছর শেষ হওয়ার পর তিনি যখন মন্দিরে নেমে আসলেন, তখন তাকে মন্দিরে ঢুকতে দেয়া হয়। পাশাপাশি জেন বুদ্ধতত্ত্বের প্রথম কুলপতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় তাকে। মন্দিরে আসার পর তিনি দেখতে পেলেন ওখানকার সন্ন্যাসীরা শারিরীকভাবে শক্ত সামর্থ্যবান নয়। গুহায় থাকাকালীন সময়ে শরীরকে ঠিক রাখার জন্য বোধিভদ্র কিছু শারিরীক কসরত করতেন। শাওলিন মন্দিরের সন্ন্যাসীদের মাঝে তিনিই প্রথম শরীরচর্চার বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করেন এবং আজকের শাওলিন মন্দিরের যে মার্শাল আর্ট আমরা দেখতে পাই, তা মূলত বোধিভদ্রেরই অবদান। ততদিনে গোটা চীনেই মার্শাল আর্ট বেশ জনপ্রিয় এবং প্রয়োগ হচ্ছিল। তেমন অবস্থায় শাওলিন মন্দিরে বোধিভদ্রের কৌশল আর বুদ্ধের জীবনপ্রণালী দুয়ে দিলে তৈরি হয় কুংফু।

কুংফুশরীরকে ঠিক রাখার জন্য কুংফু শুরু হলেও রাষ্ট্রের সুরক্ষার জন্যও শাওলিন সন্ন্যাসীরা প্রায়শই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতেন। শাওলিন ততদিনে তার যোদ্ধা সন্ন্যাসীদের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। চীনের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক চীনা শিশু শাওলিনে আসতে শুরু করেন সুন্দর জীবন যাপনের জন্য। কিন্তু মন্দিরের কঠোর নিয়মকানুন আর নিয়মতান্ত্রিকতার মাঝে অনেকেই টিকতে পারেনি। এরমধ্যে যারা টিকে গিয়েছিল তাদের উদ্দেশ্যে বোধিভদ্রের কিছু বানী ছিল। এরমধ্যে কুংফু নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘নিজের শিক্ষকের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করো না’, ‘তুচ্ছ কারণে লড়াই করো না’, ‘আঘাত করো না’। বোধিভদ্রের শেষের বানীটি শুনে মনে হতে পারে যে, কুংফু শেখা হলো অথচ আঘাত করতে মানা করা হলো এর মানে কি হতে পারে। আসলে বোধিভদ্র তার ছাত্রদের এই বলে শিক্ষা দিয়েছিলেন যে, একেবারে চূড়ান্ত শত্রুটির জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত তার শুধরে যাবার সুযোগ থাকে। তাই শত্রুকে অকেজো এমন কোনো আঘাত না করা থেকে বিরত থাকাই ভালো।

৫৭৪ সালের দিকে সম্রাট উদি বুদ্ধতত্ত্বকে চীনে নিষিদ্ধ করে দেন এবং শাওলিন মন্দির ধ্বংস করে দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ঝিংওয়েন সম্রাটের সময়ে বুদ্ধতত্ত্ব আবারও চীনে প্রতিষ্ঠা পায় এবং শাওলিন মন্দির পুনরায় তৈরি করা হয়। তাং সাম্রাজ্যের টালমাটাল অবস্থায় তেরো জন সন্ন্যাসী তাং সম্রাটের সন্তান লি শিমিনকে শত্রুদের হাত থেকে উদ্ধার করতে সাহায্য করে। এই কারণে লি শিমিন যখন সম্রাট হন তখন শাওলিন মন্দিরকে ‘সুপ্রিম মন্দির’ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয় এবং পরবর্তী কয়েক শতক মন্দিরটি শরনার্থীদের আবাসস্থল হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

মিং সাম্রাজ্যের পতনের পর চিং সাম্রাজ্যের শাসকরা চূড়ান্তভাবে শাওলিন মন্দির ধ্বংস করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। মন্দিরে থাকা সম্পদ এবং অমূল্র সব তথ্যাদি-পুস্তক পুড়িয়ে দেয়া হয়। শাওলিন মন্দিরের যোদ্ধা সন্ন্যাসীদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, এমনকি তাদের অনুসারীদেরও কারাগারে পাঠানো হয়। ওই সময়েই মূলত শাওলিনের সন্ন্যাসীরা চীনের সর্বত্র এবং আশেপাশের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে যান ও বৌদ্ধতত্ত্বের প্রচারে কাজ করেন। এই ঘটনার ঠিক একশ বছর পর শাওলিন মন্দির আবারও তৈরি করা হয় এবং বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়া হয়।

বর্তমানে শাওলিন মন্দিরটি এখনও খোলা আছে এবং চীনের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক শিশুই এখানে শিক্ষার জন্য আসেন। গোটা চীনে এখন শাওলিন মন্দিরের নিয়ন্ত্রনে মোট আশিটি কুংফু স্কুল আছে, যেখানে শিক্ষাগ্রহনের পাশাপাশি কুংফু শিক্ষাও দেয়া হয়। তবে এই স্কুলগুলোর নিয়ম হলো, এখানে শিক্ষাগ্রহন করতে হলে পাঁচ বছর বয়স থেকে শিক্ষাগ্রহন করতে হবে।



মন্তব্য চালু নেই