কুড়িগ্রামে ভয়াবহ বন্যা: পানিবন্দী সাড়ে তিন লাখ মানুষ পড়েছে চরম দুর্ভোগে

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি : গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা মোকাবেলা করছে কুড়িগ্রামের সাড়ে তিন লাখ মানুষ। নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। স্রোতের টানে ভেসে যাচ্ছে ঘর-বাড়ি, স্কুল, প্রতিষ্ঠান। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। পাকা ও কাঁচা সড়ক ডুবে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। সোমবার সকাল থেকে ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েণ্টে বিপদসীমার ৬৯ সে.মি ও ধরলার নদীর পানি সেতু পয়েন্টে বিপদ সীমার ৯৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সরকারি হিসেবে ৯টি উপজেলার ৫৩টি ইউনিয়নের ৬৩ হাজার পরিবারের ৫শত গ্রামের তিন লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। কিন্তু স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানদের দেয়া তথ্য মতে সাড়ে তিন লাখের উপর মানুষ বন্যার পানিতে ভাসছে।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজার রহমান জানান, গত ২৪ ঘন্টায় ব্রহ্মপুত্রে ৮, ধরলায় ২৫, তিস্তায় ৫ ও দুধকুমারে ১৬ সেন্টমিটার পানি বেড়েছে। ফলে সোমবার ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েণ্টে বিপদসীমার ৬৯ সে.মি ও ধরলার নদীর পানি সেতু পয়েন্টে বিপদ সীমার ৯৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যাত্রাপুর বাজারের নিকট বাঁধের ১৫০মিটার ভেঙ্গে যাওয়ায় পানির তোড়ে ১৫টি বাড়ি ভেসেগেছে। চর যাত্রাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি এখন ভাঙ্গনের মুখে। তিনি আরো জানান, ২০০৭ সালের পর কোন বন্যায় পানি এমন উচ্চতায় উঠেনি। গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ এই বন্যায় ২০০ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১০টি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ২২কিঃ মিটার বাঁধ। তবে দ্রুত তা মেরামতের চেষ্টা চলছে।

বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়ায় কুড়িগ্রাম-যাত্রাপুর সড়কে দু’দিন ধরে গরু ও পণ্যবাহী ট্রাকসহ সকল ধরণের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। গত ২৪ ঘন্টায় প্রবল স্রোতের টানে ভেসে গেছে অন্তত অর্ধশত ঘর-বাড়ি। রাস্তা, গুচ্ছগ্রাম ও বাঁধে আশ্রিতদের সংখ্যা বাড়ছে। খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও পয় নিষ্কাশন সংকটের পাশাপাশি বেড়েছে পশু খাদ্যের সংকট। কৃষি বিভাগের মতে প্রায় ১৮ হাজার কৃষকের এক হাজার হেক্টর জমির ফসল নিমজ্জিত হয়েছে।

c6bc15dc-2623-402f-be00-f0a300041e3e

কুড়িগ্রাম ত্রাণ বিভাগের কর্মকর্তা আব্দুল মোত্তালিব মোল্লা জানান, সরকারি হিসাবে ৫৩টি ইউনিয়নের প্রায় পাঁচ শত গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ৭৬৫ বর্গ কিঃ মিঃ এলাকা এখন বন্যার পানিতে ডুবে আছে। বন্যা ও নদী ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার ৬২হাজার ৮৪২টি। এ হিসাবে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। যোগাযোগের রাস্তা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ৩৭২ কিঃ মিটার। এর মধ্যে পাকা রাস্তা ২৭কিঃ মিঃ এবং কাঁচা রাস্তা ৩৪৫ কিঃ মিটার। শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ৯৮টি। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ২২ কিঃ মিটার এবং ব্রীজ ও কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ১১টি। একই সময়ে ফসল নষ্ট হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ১৮ হাজার কৃষক।

সিভিল সার্জন ডাঃ জয়নাল আবেদীন জিল্লুর দাবি করেছেন, বন্যা দুর্গত এলাকায় ৮৫টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, ওর স্যালাইনসহ প্রয়োজনীয় সকল ঔষধ পর্যাপ্ত রয়েছে।

বন্যার ভয়াবহতা এবং সরকারের নেয়া ত্রাণ তৎপরতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় আমলা তান্ত্রিক জটিলতার কারণে দূর্গত এলাকার সঠিক পরিসংখ্যান, ত্রাণ তৎপরতা যথাযথ ভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। আট দিন ধরে পানিবন্দী মানুষের হাতে কাজ নেই। ঘরে খাবার নেই। খাবার থাকলেও নেই জ¦ালানী, তরিতরকারি, লবণ,তেল, মরিচসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। ফলে এখন ঘরে ঘরে খাদ্যের জন্য হা-হা-কার বিরাজ করছে। ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়া সাড়ে তিন লক্ষাধিক মানুষের দিনকাটছে অর্ধাহার-অনাহারে। এখন পর্যন্ত সরকারি ভাবে বন্যাদূর্গত মানুষের জন্য বরাদ্দ মিলেছে মাত্র ১৯২টন চাল ও ৮লাখ ৭৫ হাজার টাকা। যা মাথাপিছু বরাদ্দ দ্বারায় ৫০০গ্রাম চাল ও ২টাকা ৫০ পয়সা। ফলে প্রতিদিন জনপ্রতিনিধিদের বাড়িতে বাড়ছে ভুখা মানুষের ভিড়। আর জনপ্রতিনিধিরা অপ্রতুল ত্রাণ নিয়ে পড়েছে বিপাকে। কাকে ছেড়ে কাকে দিবে। কারণ কম বেশী সবারই প্রয়োজন শুকনা খাবার। ফলে চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা মানুষের চাপ সমলাতে না পেরে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেরাচ্ছেন। এ কথা স্বীকার করেন হাতিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হোসেন, বেগমঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন ও সাহেবের আলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সিদ্দিক মোল্লা।



মন্তব্য চালু নেই