কুড়িগ্রামে লেপ-তোষকে অভাব দূর রফিকুল-মাজেদা দম্পতি’র

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিঃ  কুড়িগ্রামে পোড় খাওয়া দম্পতি রফিকুল মাজেদা। দিনমজুরী করে চলছিল টানাটানির সংসার। এরমধ্যে ঘর আলো করে আসে নতুন অতিথি। ফলে ব্যয় কমাতে এনজিও থেকে ১৫ হাজার টাকা লোন নিয়ে মুরগীর খামার গড়ে তোলেন। ওই কথায় আছে না, গরীবের ভাল মহাজনও চায় না। সেই দশা হল দুজনের।

হঠাৎ করে কনকনে ঠান্ডায় মুরগীগুলো মরতে শুরু করে। কোনভাবেই বাঁচাতে না পেরে চোখে অন্ধকার দেখেন স্বামী-স্ত্রী। ব্যবসায় লস খেয়ে আবার ফিরে যেতে হয় দিনমজুরীর কাজে। এরমধ্যে পরিবারে আরো দু’সন্তান যোগ হয়। ফলে খরচ বাড়তে থাকে। সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর ইচ্ছা থাকলেও কোন অবলম্বন ছিল না আঁকড়ে ধরার। এরমধ্যে দুজনে বুদ্ধি করে শুরু করে লেপ-তোষক বানানোর কাজ। আবারো লোন করা হয় ১৫ হাজার টাকা।

দুজনে খাটতে থাকে গাধার মতো। ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসতে থাকে সংসারে। ছেলেদের স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়। এলাকার মানুষ পরিশ্রমি এই পরিবারটিকে দেখে অবাক হয়ে যায়। অদম্য ইচ্ছা, পরিশ্রম আর সততা থাকলে কী করা যায় তা দেখিয়েছে রফিকুল আর মাজেদা। তারা এখন এই এলাকার সকলের পরিচিত মূখ।
শনিবার সকালে কথা হয় রফিকুল ইসলামে (৩৩) এর সাথে। তাদের বাড়ী কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের সীমান্ত ঘেঁষা ধর্মপুর গ্রামে।

সে জানান, বাবা দেপু মিয়া আমাদের ছোট রেখেই মৃত্যুবরণ করেন। তখন তার ছিল চায়ের দোকানের ব্যবসা। বাবার মৃত্যুর পর আমি লেখাপড়া বাদ দিয়ে কিশোর বয়সে চায়ের দোকানের হাল ধরি। ব্যবসায় কিছুটা উন্নতি হলে বন্ধুদের পরামর্শে এনজিও থেকে লোন নিয়ে মুরগীর খামার গড়ে তুলি।

প্রথম বছর ভালই লাভ করি। কিন্তু কপালে ব্যবসা ছিল না। মুরগীগুলো মারা যেতে থাকে। স্বাস্থ্য বিভাগের পরামর্শ নিয়েও বাঁচাতে পারিনি। ফলে পরিবারসহ নি:স্ব হয়ে যাই। পরে লোন শোধ করতে হোটেল ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে জেলার বাইরে গিয়ে কামলা-কিষাণ দেই। খেয়ে না খেয়ে লোনের টাকা পরিশোধ করি। একটু থেমে রফিকুল জানায়, কারো কাছে হাত পাতিনি। গায়ে-গতরে খেটে সংসারে অন্ন জুটিয়েছি। এরপর সন্তানরা বড় হয়ে যাওয়ায় স্ত্রীসহ পরামর্শ করি ভাল কিছু একটা করার। এভাবেই লেপ-তোষকের ব্যবসায় নেমে পড়ি।

রফিকুলের স্ত্রী মাজেদা জানায়, শুরুটা খুব কষ্টের ছিল। কাঁথা শেলাইয়ের কাজ জানতাম। কিন্তু লেপ-তোষক কিভাবে-কতটুকু পরিমাণ দিয়ে তৈরী করতে হয় জানা ছিল না। আমার স্বামী একটি লেপ-তোষকের কারিগড়ের সাথে কাজ শুরু করে। সেখান থেকে সবকিছু জেনে নেয়। এর ৬মাস পর আমরা এই কাজটা শুরু করি। দুজনের প্রচন্ড ইচ্ছা আর কর্মস্পৃহার মাধ্যমে আমরা অভাবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করি।

বর্তমানে আমাদের পরিবারে স্বাচ্ছন্ন ফিরে এসেছে। নিজেরা লেখাপড়া করতে পারিনি কিন্তু সন্তানদের মানুষ করার চেষ্টা করছি। বর্তমানে বড় ছেলে ৯ম শ্রেণি, ছোট ছেলে পঞ্চম শ্রেণী ও ছোট ছেলে শিশু শ্রেণীতে পড়ছে। ছেলেরাও স্কুল প্রাইভেট পড়ার পাশাপাশি বাবা-মার কাজে সহযোগিতা করে বলে জানান মা মাজেদা বেগম।

বর্তমানে রফিকুল মাজেদা হাতে গড়া প্রতিটি লেপ-তোষক ৬শ থেকে ৭শ টাকা, কোল বালিশ ১শ থেকে দেড় শত টাকা, বালিশ ৭০ থেকে ১শ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। প্রতিদিন ৫ থেকে ৬ টি লেপ-তোষক তৈরী করে তারা। এ ছাড়াও বালিশ, কোল বালিশও তৈরী করা হয়ে থাকে। এজন্য একজন শ্রমিক তাদেরকে সহযোগিতা করছে। বর্তমানে রফিকুল ভ্যানে করে প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জে গিয়ে লেপ-তোষক বিক্রি করছে। শ্রমিককে ২শত টাকা মজুরী দেওয়ার পরও প্রতিদিন গড়ে ৫ থেকে ৭শত টাকা আয় করতে পারছে এই দম্পতি।

এই দম্পতি জানান, আমাদের বড় বেশি আশা নেই। আমাদের মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর পাশে সরকারের কোন ব্যাংক-বীমা এগিয়ে এলে আমরা আরো ভাল করতে পারতাম। এজন্য সহযোগিতা আশা করে এই অদম্য পরিবারটি।



মন্তব্য চালু নেই