কেন পালমিরা অভিমুখে অভিযান?

বাশার আল আসাদের প্রতি সংহতি জানানোর জন্য ভ্লাদিমির পুতিন সিরিয়াতে তার সেনাবাহিনী পাঠাননি। এমনও নয় যে, আসাদকে ক্ষমতায় রাখতে রাশিয়ার সামরিক ঘাটি থেকে বিমানগুলো তারতউস নৌ-ঘাটির আশপাশে উপস্থিতি জানান দিয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের উষ্ণমণ্ডলীয় এলাকায় অবস্থিত নৌ-ঘাটি মস্কোর হাতে আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত পুতিনের চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।

তিনি আসলে একটা জয় চান। সিরিয়ার সেনাবাহিনী বাস্তবেই এই শাসন কাঠামোর বিশেষ একটা অংশ যাদের আইএসআইএস’র বিরুদ্ধে শক্তিশালী লড়াইয়ে অংশ নেয়ার মতো পুনরায় অস্ত্র-প্রশক্ষিণ দেয়া হয়েছে। আর এই বিষয়টির সিম্বলিক মূল্য মধ্যপ্রাচ্য এবং বাকী বিশ্বের কাছে সমান ভাবেই রয়েছে। সেনাবাহিনীর পরিকল্পনা সর্বদাই দেরি করিয়ে দেয়া এবং যে মুহূর্তে আর্টিলারি প্রথম গোলাটি ছোড়ে, সেই পরিকল্পনাও সবসময় ভূলই হয়। সিরিয়াতে যুদ্ধক্ষেত্রের চালচিত্র প্রতিদিন প্রতিরাতে পরিবর্তন হয়। কিন্তু আমি এখন একটি তথ্যসমৃদ্ধ অনুমান করতে চাই এবং আমরা একে অনুমানই বলবো।

নতুন রাশিয়ান ফাইটার বোম্বার, নতুন অ্যান্টি আর্মার মিসাইল এমনকি সম্ভবত রাশিয়ার নির্মিত নতুন টি-৯০ ট্যাংকও মরুভূমিতে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। পালমিরা থেকে মাত্র ৫০ মাইল অর্থাৎ হোমসের পূর্বদিকের মূল সড়কের কাছেই আছে সিরিয়ার সবচেয়ে আধুনিক বিমানঘাটি। আর সিরিয়ার সেনাবাহিনী কয়েক মাস ধরেই এই শহরে আক্রমনের পরিকল্পনা করছিল। এক সপ্তাহ আগেই একটি অপারেশন বাতিল করা হয়েছিল এই সংবাদের ভিত্তিতে যে, আইএসআইএস হয়তো বাকী রোমান শহরটিও গুড়িয়ে দেবে। কিন্তু এখন আর এই চিন্তা কাজে আসছে না। কোনো সেনা অভিযানের মুখোমুখি না হয়েই আইএসআইএস নিজে রোমান মন্দিরগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে।

এখন এটা স্মৃতিচিহ্ন। এই মুহূর্তে আমি আমার তথ্যবহুল অনুমানটি বলবো যা ইতোমধ্যেই উল্লেখ করেছি। এই শাসনের কথা ছিল আলেপ্পোকে দখল হতে না দেয়া। আইএসআইএস আলেপ্পো দখল করে তৎক্ষণাৎ শহরটিকে খিলাফতের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করে। সিরিয়ান সেনাবাহিনীকে লেবাননের দিকে যাওয়ার রাস্তা এবং লেবানন সীমান্তবর্তী কালামুন পাহাড়চূড়া অঞ্চলটি খোলা রাখতে হয়েছে তখনও। তারা আইএসআইএস’র কাছে আর কোনো শহর হারাতে চায়নি। কিন্তু আইএসআইএস থেকে শহর দখলমুক্ত ‘স্বাধীন’ করার তালিকায় তাদের প্রথমে আছে পালমিরা।

আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে হয়তো সেটা হয়েও যাবে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের সবগুলো যুদ্ধই টাইম চার্ট অনুযায়ীই ক্রমান্বয়ে হয়েছে। বর্ষায় ইরাক থেকে বালি-কাদা ধোয়া পানি চলে আসার আগেই আমরা হয়তো নভেম্বর মাসের গোড়ার দিকে সেটা দেখতে পাবো। পালমিরা হলো আদতেই একটা মুক্তা, ওই অঞ্চলের মানুষগুলোর তুলনায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা রোমান স্থাপত্যকলার দিকে যে গোটা বিশ্বের মানুষের উদ্বেগ দৃষ্টি রয়েছে। তাই সবার আগে পালমিরাকেই পুনরায় দখল করতে হবে। কারণ এই শহরটি ধ্বংস করেই গত সপ্তাহে আইএসআইএস ঘোষণা করেছিল যে, এটা তাদের খিলাফতের এক গুরুত্বপূর্ণ বিজয়।

কিন্তু পুতিনের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার নতুন উপস্থিতি প্রমাণ প্রয়োজন হয়ে পরেছে। ওবামা এবং ক্যামেরনসহ বাকী পশ্চিমা নেতারা, যারা গত চার বছর ধরে সিরিয়ায় এলোমেলোভাবে হাতাহাতি করছে আসাদকে না উৎপাটন করতে, না আইএসআইএস’কে পরাজিত করার জন্য। এই অবস্থায় রাশিয়ার পালমিরা জয় করা হবে একটা অপমানকর ঘটনা। মস্কোকে বিশ্বাস করে এবং মনে রাখতে হবে যে, কয়েক মাস আগেই মিসরীয় প্রেসিডেন্ট আল সিসি’র সঙ্গে পুতিনের আলোচনা হয়েছিল। ওখান থেকেই হয়তো তারা পশ্চিমা সমর্থনের বাইরে মধ্যপ্রাচ্য থেকে নেতা নির্বাচনের পরিকল্পনা করেছিলেন।

রাজনৈতিকভাবে অবশ্যই পালমিরা জয়ের ঘটনা আসাদকে তার অর্ধেক সিরিয়া নিয়ে অনেকটাই নিরাপদ করবে। ইতোমধ্যে আমেরিকানরা এবং ব্রিটিশরা সিরিয়ার ভবিষ্যত ‘অর্ন্তবর্তীকালীন’ সরকার নিয়ে বকবক করা শুরু করেছেন, যা আমরা গত কয়েক বছর ধরেই দেখতে পাচ্ছি। দামেস্ক থেকে পুনরায় উৎখাত হওয়ার জন্য পুতিন রাশিয়ার অর্থ সিরিয়াতে ব্যয় করছেন না। তার ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট পালিয়ে গেছে। কিন্তু এই চার বছরে আসাদ কিন্তু একবারও রাশিয়া যাননি। এমনকি ‘অর্ন্তবর্তীকালীন’ প্রেসিডেন্ট থাকার কথাও বলেননি।

কিন্তু পালমিরার পর কি হতে যাচ্ছে? আলেপ্পোর বৃহদাংশ পুর্নদখল করা অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্প। ইদলিব অথবা আইএসআইএস’র রাজধারী রাক্কাই কি দখল করা সম্ভব? মরুভূমি শহর দেইর এজুরে শত্রুবেষ্টিত থাকা সরকরি বাহিনী এখন কিছুটা নিশ্চিন্ত আছে। কিন্তু সিরিয়ার মরুভূমিতে কালো দৈত্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। যদি রাশিয়া এবং সিরিয়া তাদের পরিকল্পনা তৈরি করে থাকে, তাহলে নিশ্চিত থাকতে হবে আইএসআইএস’র অন্য কোনো পরিকল্পনা আছে। সেটা মধ্য দামেস্কে আক্রমনের মতো ঘটনাও হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ তিন বছর আগে বিদ্রোহীদের দামেস্ক দখলের চেষ্টার কথা বলা যেতে পারে।

সিরিয়াতে থাকা আফগান ভূতকে রাশিয়া তাড়াতে পারবে না। আপনি মরুভূমিকে ‘ধরতে’ পারেন না। এমনকি রাশিয়ার নতুন বিমান বাহিনীও আইএসআইএসকে পরাজিত করতে পারে না। অন্তত পক্ষে, সিরিয়ার প্রতিবেশিদের সঙ্গে এবিষয়ে রাশিয়ার কথা আগায়নি। আর এই কারণেই সম্প্রতি বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং পুতিনের সাক্ষাত হয়। এই সাক্ষাতের কারণ ছিল যাতে ইসরায়েল উত্তর-পূর্ব গোলান নিয়ে রাশিয়ার পরিকল্পনাকে ভুল না বোঝে। পুতিন এবং আসাদ দামেস্কের জন্য সংসদীয় গণতান্ত্রিক কোনো পন্থা ভাবছেন না। কিন্তু যদি রাশিয়া আইএসআইএস এবং পুতিনবিরোধী চেচেনদের ঠেকিয়ে দিতে পারে তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোকে সিরিয়ার ভবিষ্যত প্রশ্নে রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতায় বসতে হবে।



মন্তব্য চালু নেই