কেন মুসলিম নিধন দেশে দেশে

প্রতিবেশি দেশ মিয়ানমারের রাখাইন স্টেটে যে রোহিঙ্গা মুসলিম নিধন চলছে তা যে হত্যাযজ্ঞ বা জাতিগত নিধন, জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর এ নিয়ে কোনো সন্দেহ আর নেই। কিন্তু ইসলাম শান্তির ধর্ম হলে এর অনুসারীদের কেন দেশে দেশে এভাবে সন্ত্রাসের শিকার হতে হচ্ছে এর কোনো সদুত্তর বা তা প্রতিরোধে বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো কৌশল ধর্মীয় নেতাদের কাছ থেকেও পাওয়া যাচ্ছে না। যে ধর্ম নিজের আচরণের বিরুদ্ধেই প্রয়োজনে সর্বাগ্রে জিহাদ করার নির্দেশ দিয়েছে সে ধর্মের নামে জিহাদ বা জঙ্গি তৎপরতার পেছনেই বা কারা ইন্ধন দিচ্ছে? কোত্থেকে তারা অস্ত্র ও অর্থ পাচ্ছে? এসব অপতৎপরতার আড়ালে কি শুধুই মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদ হাতিয়ে নেওয়ার অভিলাষ নাকি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে উপনিবেশবাদ টিকিয়ে রেখে ভূ-কৌশলগত অবস্থান বজায় রাখার খায়েশ তা নিয়েও মেধানির্ভর কোনো যৌক্তিক বিশ্লেষণ মুসলমানদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না।

ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া থেকে শুরু করে সবখানেই মুসলিম বিরোধিতা ও একের পর এক নতুন নতুন ফ্রন্ট খোলা হচ্ছে যেমন নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, শিশুদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া, যুবকদের বিভ্রান্ত করে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধকরণ এবং এর পরিণতি সিরিয়া, লিবিয়া, সোমালিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, পাকিস্তান, আফগানিস্তান সহ একের পর এক মুসলিম সংখ্যাগরীষ্ঠ দেশকে সন্ত্রাসের ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত করে তোলা হচ্ছে। সর্বশেষ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের মধ্যে দিয়ে কি দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাসের চালান দেয়া হচ্ছে। ইরাকের মসুলে আইএস জঙ্গি কোনঠাসা হয়ে যাওয়ার পর তা নতুন করে বিশ্বের কোন অঞ্চলে ভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে তা রীতিমত উদ্বেগের বিষয়। আল-কায়েদা, আল-শাবাব, আইএসআইএস নানা নামে ভিন্ন ভিন্ন মর্মে সন্ত্রাসকে পুঁজি করে ধর্মের নামে এই অপতৎপরতা বিশ্বে মুসলিম মানেই জঙ্গি এমন পরিচিতি করে তোলার অপপ্রয়াস এখন অনেকটাই সফল। সন্ত্রাস সন্ত্রাসই এবং তা যে কোনো ধর্মের মানুষ করলেই অগ্রহণযোগ্য, এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না।

gtd-550x348

সাদা চোখে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে কোনো ঐক্য নেই। অধিকাংশ মুসলিম দেশ পরাশক্তি দেশগুলোর সাহায্য ও সহযোগিতা নির্ভর বা ক্ষমতায় টিকে থাকার কৌশল হিসেবে এসব দেশের সরকার কখনো পাশ্চাত্য বা কখনো প্রাচ্যমুখী আশীর্বাদের জন্যে হুকুম তামিল করে মাত্র। সম্পদ সৃষ্টির কৌশল না জানা, নানামুখী গবেষণার প্রচ- অভাব, প্রযুক্তি বিমুখতা ও পুঁজির সঠিক ব্যবহার না করতে পারায় মুসলিম দেশগুলোর ভেতরে বিরাট ধরনের পরনির্ভরতা এখনো কাটেনি। তারপরও সমাজতন্ত্র ফেঁসে যাওয়ার পর পুঁজিবাদ বা বিশ্বায়নের যে হাল তাতে এখনো ইসলাম জীবন ব্যবস্থা হিসেবে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে যুগান্তকারী সমাধান দিতে পারে এবং ইসলামের এ ঘুমন্ত শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে তা বিদ্যমান বৈষম্যপূর্ণ সামাজিক ব্যবস্থার জন্যে বড় ধরনের হুমকি হয়ে উঠতে পারে। বরং বলা চলে ইসলাম সম্পর্কে মানুষের বিশ্বব্যাপী জানার যে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে বা অমুসলিমদের জেনে শুনে মুসলিম হবার যে ধারাবাহিকতা সৃষ্টি হয়েছে তাও এক কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইসলাম বলে, সম্পদের মালিকানা আল্লাহর, হালাল রুজি ইবাদত কবুলের প্রথম শর্ত, সুদহীন অর্থ ব্যবস্থা বা জিরো ইন্টারেস্ট, জমি অনাবাদি না রেখে ভূমিহীনদের তা দিয়ে দেওয়া, অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় না করা এমনি হাজারো জীবন ব্যবস্থাপনার ইসলামি দিকগুলো মোটামুটি মানুষ ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে জানতে ও বুঝতে চাচ্ছে। এবং এর প্রায়োগিক দিক শুরু হলে তা সুনামির মত বিভিন্ন দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনীতিতে আঘাত হানতে শুরু করবে। এই কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্যে বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী গ্রুপ তৈরি করে বিভিন্ন মুসলিম দেশে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। ইসলাম ও মুসলিম মানেই সন্ত্রাস এই বালির বাঁধ দিয়ে ইসলামি জোয়ার প্রতিরোধে ব্যর্থ প্রচেষ্টা এটি কি না তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না কতিপয় মুসলিম দেশে রাজতন্ত্র, গণতন্ত্রের নামে স্বৈরাচার ব্যবস্থা অথবা সামরিক জান্তা টিকে থাকায়।

যেমন মিশরের ইতিহাসে প্রথমবারের মত নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে সামরিক জান্তা ক্ষমতায় যাওয়ার পর বর্তমানে দেশটির অর্থনীতি ও রাজনৈতিক হাল কি হয়েছে তা বিশ্ববাসী দেখছে। মিসরে যদি তা না হত তাহলে মোহাম্মদ মুরসি আদতে ইসলামি শাসন ব্যবস্থার নামে কি উপহার দিতে পারত তার একটা পরীক্ষা এতদিন হয়ে যেত। সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ সরকার নির্বাচিত ও জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেলেও তার পতনের জন্যে জাতিসংঘের অনুমোদনহীন যুদ্ধের নামে সশ্রস্ত্র সন্ত্রাস চালাচ্ছে আইএস জঙ্গিরা। এর পেছনে রয়েছে কয়েকটি আরব দেশ। ইয়েমেনে ক্ষমতা ছেড়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট পালালেও তাকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে সৌদি আরবের প্রত্যক্ষ মদদে সেখানে সামরিক আগ্রাসনে মানুষ মরছে ও দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। বাহরাইন পরিস্থিতি থমথমে। আরব দেশগুলোয় কেন নির্বাচিত সরকার নেই তা নিয়ে পরাশক্তিদেশগুলো কখনো মাথা ঘামায় না, তাবৎ বিশ্বে গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীমূলক নির্বাচনের কথা বললেও সেখানে গণতন্ত্রের কথা বলে না। উল্টো দেশগুলোতে পরাশক্তিদেশগুলো শত শত বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করে। তেলের বাজার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ হয়।

মজার ব্যাপার হচ্ছে আরব দেশগুলোর শাসকরা ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যের জন্যে এক বিরাট হুমকি মনে করে ও ইসরায়েলের সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক বজায় রাখে। ইসরায়েলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে আইএস জঙ্গির তৎপরতা এতদূর গড়িয়েছে যা এখন ওপেন সিক্রেট। এমনকি ইরানকে ঠেকাতে ইসরায়েল মনে করে আইএস জঙ্গিদের ইরাকে টিকে থাকতে হবে। আইএস জঙ্গি গোষ্ঠীর আবু বকর আল বাগদাদি একজন ইহুদি তার প্রমাণ ইউটিউবে মিলেছে। ইরান নিজস্ব প্রযুক্তি ও পুঁজির ব্যবহারে স্থিতিশীলতা তৈরিতে সক্ষম হয়েছে অন্যদিকে জাতিসংঘ সহ পরাশক্তিদেশগুলোর সঙ্গে পারমানবিক শক্তির ব্যবহার নিয়ে একটি সমঝোতা চুক্তিতে যেয়ে দেশটির ওপর অবরোধ তুলে দিতে সমর্থ হয়েছে। কোনো দেশের জনগণের চাওয়া পাওয়ার সঙ্গে একাত্মতা হওয়া আর স্বৈরাচারের সঙ্গে একাত্মতা হওয়ার মধ্যে দিয়ে নিপীড়নকারী শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে জোট বাঁধা কখনো এক হতে পারে না। সিরিয়া, লেবানন, ইরাকের মত দেশগুলোতে ইরানের সমর্থন এতটুকুই। যে ইরাক ইরানের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল সেই ইরান এখন ইরাকের পুনর্গঠনে সাহায্য করছে, জ্বালানি,তথ্য প্রযুক্তি, টেলিযোগাযোগ সহ অন্যান্য সম্পদের যোগান দিচ্ছে।

এর পাশাপাশি পশ্চিমা বিশ্ব থেকে শুরু করে বিশ্বের সর্বত্র ইসলামফোবিয়া মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। সর্বশেষ ব্রিটেনের ম্যানচেস্টারের বোল্টন শহরে গত শনিবার একটি মসজিদ নির্মাণে বাধা দিতে বিক্ষোভে নেমে আসে অনেকে। কি তাদের পরিচয় তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে তারা হিটলারের আমলে নাজি স্টাইলে দুই হাত উপরে তুলে মসজিদ নির্মাণের প্রতিবাদ জানাতে থাকে। তাদের হাতে প্ল্যাকার্ডে লেখা দেখা যায় ‘নো মস্ক হেয়ার’ অর্থাৎ এখানো কোনো মসজিদ নির্মাণ নয় ইত্যাদি। এদের শরীরে হিটলারের ‘স্বস্তিকা’ চিহ্নের উল্কি আঁকা ছিল যা অনেকে দেখাতে থাকেন। অবশ্য একই সময়ে আরেক দল মানুষ ‘ইউনিট এগেইনেস্ট ফ্যাসিজম’ ব্যানারে তাদের বিরোধিতা করে শ্লোগান দিতে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যান বলছে, গত ৫ বছরে ধর্মের নামে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো সন্ত্রাস ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তাতে দেশগুলোতে ৮৭ থেকে ৯৭ ভাগ মুসলমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি এ্যাকাডেমির কাউন্টার টেরিরিজম সেন্টার এক প্রতিবেদন বলে আল-কায়েদা অমুসলিমদের চেয়ে ৭ গুণ বেশি মুসলিমকে হত্যা করেছে। গত বছর জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয় ইরাকে আইএস জঙ্গিরা সবচেয়ে বেশি মুসলিমকে হত্যা করছে। মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল টেরিরিজম ডাটাবেজ তথ্য দিচ্ছে ২০০৪ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরাকে বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি অর্থাৎ ৬০ ভাগ সন্ত্রাসী ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে এবং এ তিনটি দেশই মুসলিম প্রধান।

অবাক হবেন জেনে যে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোয় অধিকাংশ সন্ত্রাসী হামলা ঘটিয়েছে অমুসলিমরা। সড়ক বা অন্যান্য দুর্ঘটনা ও দুর্বিপাকের চেয়ে সন্ত্রাসে মানুষের নিহত হবার ঘটনা বেশি। একই সঙ্গে সন্ত্রাসের চেয়ে একে ভয় পেয়ে নিরব থাকা অবশ্যই সন্ত্রাসের চেয়ে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর ঘটনা হয়ে রয়েছে আমাদের প্রত্যেকের জীবনে।



মন্তব্য চালু নেই