কেমন আছে শহীদ বরকতের স্বজনেরা

মহান ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ আবুল বরকত। আদি নিবাস ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে। লেখাপড়া করতেন ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন তিনি। সমাহিত করা হয় ঢাকারআজিমপুর কবরস্থানে। বরকতকে এদেশে চির নিদ্রায় রেখে স্থির থাকতে পারেনি তার পরিবার। জন্মভূমি ছেড়ে তারাও বাংলাদেশেচলে আসেন। স্থায়ীভাবে আবাস গড়েন রাজধানীর কাছের গাজীপুরের নলজানিতে।

ভাষাশহীদ বরকতের ভাতিজা আলাউদ্দিন বরকত জানান, তার চাচা বরকতের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর থানার বাবলা গ্রামে। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষে ১৯৪৫ সালে তালিবপুর হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন তিনি। ওই সময় কলকাতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া কাছে উচ্চশিক্ষার আর কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় লেখাপড়া ছিল ব্যয়বহুল। মুসলিম ছাত্রদের সেখানে ভর্তিও সহজ ছিল না। তা ছাড়া হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার কারণে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তখন নিরাপদও ছিল না।

এ ছাড়া আবুল বরকতের মামা আব্দুল মালেক ছিলেন ঢাকায় ওয়াপদার পরিচালক (হিসাব)। ওইসব বিষয় চিন্তা করে মামাই আবুল বরকতকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করান। শুরুতে তিনি ওঠেন তার (আব্দুল মালেকের) বাসায়। পরে ছাত্রাবাসে। ১৯৫১ সালে অনার্স (দ্বিতীয় শ্রেণিতে চতুর্থ স্থান) পাস করে তিনি এমএ ভর্তি হয়েছিলেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হলে তিনি তাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের সামনে আমতলায় সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদের ডাকে সমাবেশে যোগ দেন। ১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্র-জনতার সেøাগানে কেঁপে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। পুলিশের সঙ্গে কয়েক দফা বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে উরুতে গুলিবিদ্ধ হয়ে রাত ৮টার দিকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান তার চাচা বরকত। পরে তাকে দাফন করা হয় আজিমপুর কবরস্থানে।

তিনি জানান, দুই ভাই তিন বোনের মধ্যে বরকত ছিলেন সবার বড় ও অবিবাহিত। তিনি শহীদ হওয়ার পর তার বাবা-মাও সিদ্ধান্ত নেন ঢাকায় আসার, যাতে অন্তত বছর বছর বাংলাদেশে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে থাকা ছেলেকে একটু আদর করে আসতে পারেন। কিন্তু ১৯৬৩ সালের ২১ জুলাই বরকতের বাবা শামসুজ্জোহা ভুলু মিয়াও ভারতে মারা যান। পরের বছর ১৯৬৪ সালে বরকতের মা হাসিনা বানু আংশিক সম্পত্তি বিনিময় করে ভারত থেকে সপরিবারে এদেশে চলে আসেন। নিবাস গাড়েন গাজীপুর মহানগরের চান্দনা গ্রামের ‘বাবলা বিথী’তে। শহীদ বরকতের একমাত্র ভাই আবুল হাসনাত ১৯৬৮ সালে এবং মা হাসিনা বানু ১৯৮২ সালে মারা যান।

শহীদ বরকতের ছোট ভাই আবুল হাসনাতের ৩ ছেলে ও ৩ মেয়ে। বাবলা বিথীতে এখন বসবাস করছেন বরকতের তিন ভাতিজা এবং তাদের সন্তানরা। ছেলেদের মধ্যে আলাউদ্দিন বরকত স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তার অপর দুই ভাই আইন উদ্দীন বরকত, জালাল উদ্দিন বরকত ব্যবসায়ী। তাদের তিন বোন (আবিদা সুলতানা, হাবিবা সুলতানা, মনিরা সুলতানা) বৈবাহিক সূত্রে স্বামীর বাড়িতে থাকেন।

১৯৮১ সালে তৎকালীন সরকার ঢাকা-জয়দেবপুর সড়কের চান্দনা গ্রাম সংলগ্ন নলজানি মৌজায় হাসিনা বানুকে ৬৮ শতাংশ জমি দেন। ওই জমির একাংশে পরিবারের সদস্যরা নিজ উদ্যোগে শহীদ বরকত স্মরণে বরকত স্মৃতি পাঠাগার ও একটি মসজিদ এবং অপর অংশে দোকান নির্মাণ করেন। এ জমিরই এক পাশে (পূর্ব-দক্ষিণ) চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন হাসিনা বানু। প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি শাহাদাতবার্ষিকীতে শহীদ বরকত স্মরণে এখানেই পরিবারের পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয় মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, গণভোজ ও আলোচনা সভা। এ বছরও সেসব কর্মসূচির আয়োজন করেছে বরকতের পরিবার।

এ ছাড়া ২০০০ সালে শহীদ আবুল বরকতকে মরণোত্তর একুশে পদক দিয়ে সম্মানিত করা হয়। দেওয়া হয় সম্মানী ভাতাও। রাজধানীর পলাশীর মোড়ে ‘ভাষা শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালা’ নির্মাণ করা হয়। গাজীপুর জেলা শহরে নির্মিত স্টেডিয়ামটির নামকরণ করা হয় ভাষাশহীদ আবুল বরকতের নামে।

বরকতের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভাষাশহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে তাদের যেমন গর্ব আছে, তেমনি রয়েছে কিছু ক্ষোভ এবং অভিমানও। আলাউদ্দিন বরকত বলেন, প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে আয়োজন করা হয় বইমেলার, ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন হয়। শহীদদের নিয়ে চলে নানা আলোচনা অনুষ্ঠান। অথচ যাদের আত্মত্যাগ নিয়ে আয়োজন, তাদের পরিবারের সদস্যদের শহীদ দিবসের জাতীয় অনুষ্ঠানে ডাকা হয় না, এটি খুবই পীড়াদায়ক।

তিনি বলেন, স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসের জাতীয় অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের রাষ্ট্রীয়ভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সম্প্রতি সরকার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সুযোগ-সুবিধা ঘোষণা করেছে। তারা একবার বিনা ভাড়ায় বিদেশে বিমানে ভ্রমণ করতে পারবেন। দেশে রেল ও বিআরটিসি বাসে বিনা ভাড়ায় যাতায়াত করতে পারবেন। একইভাবে বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, একুশে পদক প্রদান অনুষ্ঠান এবং একুশের জাতীয় অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণ এবং পরিবহনে একই ধরনের সুবিধা ৫ ভাষাশহীদ পরিবারের সদস্যদের জন্য ঘোষণা করা হলে তারাও সম্মানিত হতেন।

তিনি জানান, একুশের প্রথম প্রহরে গাজীপুর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানান তারা। সকালে ঢাকার কেন্দ্্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর পর আজিমপুরে বড় চাচা (বরকত) ও বাবার কবর জিয়ারত করে গাজীপুরে এসে মিলাদ মাহফিল ও কাঙালি ভোজের আয়োজন করেন। এভাবেই প্রতিবছর তাদের পরিবারের সদস্যরা ২১ ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করেন।

আলাউদ্দিন বরকত জানান, সামাজিক মর্যাদা নিয়ে বাঁচার মত সামর্থ এ পরিবারের আছে। আমাদের অর্থ চাই না। বরকতসহ অন্য ভাষাশহীদদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা চান তিনি।



মন্তব্য চালু নেই