কেরানি থেকে শিল্পপতি কে এই কাজী শাহ্‌নেওয়াজ?

কাজী শাহ্‌নেওয়াজ। খুলনায় আলোচিত এক শিল্পপতির নাম। গণপূর্ত বিভাগের কেরানি থেকে আজ অগাধ বিত্তবৈভবের মালিক। ঠিকাদারি, পরিবহন ব্যবসা, চিংড়ি ব্যবসা, হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিকারক হিসেবে কাজ করলেও ব্যাংক, বীমা থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ ও চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করে রাতারাতি শত কোটি টাকার মালিক বনে যায় কাজী

শাহ্‌নেওয়াজ। তার এ সব অপকর্ম ফাঁস হয়ে যায় সোমবার সন্ধ্যায় র‌্যাব-এর নকল ওষুধ তৈরির কারখানা ও কোটি টাকার নকল ওষুধসহ গ্রেপ্তার হবার পরে। রাবার গলিয়ে তৈরি করা হতো ক্যাপসুলের ক্যাপ। যা মানব দেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এছাড়া ক্যাপসুলের মধ্যে ভরা হতো আটা, ময়দা ও চালের গুঁড়া। এ সব তথ্য পেয়ে র‌্যাব কর্মকর্তারা বিস্মিত হয়েছেন।কাজী শাহ্‌নেওয়াজকে খুলনার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নাসির উদ্দিন ফারাজীর আদালত কারাগারে প্রেরণ করেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭২ সালে কাজী শাহ্‌নেওয়াজ নড়াইল থেকে এসে ভর্তি হন খুলনার আযম খান কমার্স কলেজে। অসচ্ছলতার কারণে মেস ভাড়া দিয়ে থাকতে না পেরে শরণাপন্ন হন কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ আবুল বাশারের নিকট। তিনি তার পরিবারের অর্থনৈতিক দৈন্যদশার কথা শুনে কলেজ ক্যাম্পাসে অধ্যক্ষের বাসভবনের চিলে কোঠার একটি রুমে থাকতে দেন। ১৯৭৪ সালের দিকে খুলনার গণপূর্ত বিভাগের কেরানির (অফিস সহকারী) চাকরি নেন। এক সময় শাহ্‌নেওয়াজ চাকরির আড়ালে নামে-বেনামে ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেন। একপর্যায়ে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে সরাসরি ঠিকাদারি লাইসেন্স করে ব্যবসায় নেমে পড়েন। ঠিকাদারি ব্যবসা চলাকালীন সময়ে ‘তুলি-বুলি’ নামে ঢাকা-খুলনা পরিবহন সার্ভিস চালু করেন। এ ব্যবসা গুটিয়ে হিমায়িত চিংড়ি মাছ কোম্পানিতে মাছ সরবরাহ শুরু করেন। এ সময় মাছে অপদ্রব্য পুশ করার অভিযোগে মাছ কোম্পানিগুলো তার কাছ থেকে মাছ নেয়া বন্ধ করে দিয়ে তাকে কালো তালিকাভুক্ত করেন। কিন্তু তাতে দমেননি শাহ্‌নেওয়াজ। ব্যাংকের ঋণ নিয়ে নিজেই মাছ কোম্পানি ‘শাহ্‌নেওয়াজ সি ফুডস’ প্রতিষ্ঠা করেন। ৯০’র দশকে তার কোম্পানি থেকে হিমায়িত মাছ সরিয়ে ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করার জন্য অ্যামোনিয়া গ্যাস লিক করেন। তখন পত্র-পত্রিকায় একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। জনতা ব্যাংক থেকে প্রায় দশ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে কৌশলে আত্মসাৎ করেন। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মামলাও করেছিলেন।-মানবজমিন।

জাতীয় পার্টির ক্ষমতার সময় তৎকালীন মন্ত্রী কর্নেল (অব.) গফ্‌ফার ও স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে ছিল তার দহরম-মহরম সম্পর্ক। বিএনপি’র শাসনামলেও মন্ত্রী, এমপিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে দাপটের সঙ্গে অপকর্ম চালিয়ে গেছেন। বিগত জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে কাজী শাহ্‌নেওয়াজ ছিলেন সহ-সভাপতি। পর্যায়ক্রমে তিনি বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি ও খুলনা চেম্বার অব কমার্সের সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। খুলনা ক্লাবের আজীবন সদস্য হিসেবেও রয়েছে তার আধিপত্য।

সোমবার বিকালে তার নকল ওষুধ করাখানায় অভিযানের খবর পেয়ে ছুটে যান তিনি। সেখানে র‌্যাব কর্মকর্তাদের সামনে বলেন, ‘আপনারা কার কেম্পানিতে ঢুকছেন জানেন? সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের অনুমতি নিয়েছেন? এর খেসারত আপনাদের দিতে হবে’। এ সময় র‌্যাব কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। একপর্যায়ে র‌্যাব তাকে গ্রেপ্তার করে।

র‌্যাব জানায়, খুলনার চর রূপসার রপ্তানিযোগ্য হিমায়িত মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান ‘শাহ্‌নেওয়াজ সি ফুডস’ বন্ধ রয়েছে প্রায় ১০ মাস। এই সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির অফিস ভবনের দোতলায় প্রিন্স ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড কোম্পানি নামে একটি প্রতিষ্ঠান হারবাল ওষুধ, কসমেটিক, পাউডার, সিল্কি শ্যাম্পু, সরিষার তেল, হারবাল মেছতা ক্রিম, স্পটক্রিম, চিরতা ক্যাপসুলসহ নানা ধরনের এনার্জি ট্যাবলেট ও ক্যাপসুল উৎপাদন শুরু করে। এই প্রতিষ্ঠানটি শাহ্‌নেওয়াজ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। দেশের বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানির নাম ব্যবহার করে এখানে দীর্ঘদিন ধরে মৎস্য প্রক্রিয়াজাত কারখানার আড়ালে নকল ওষুধের অবৈধ কারবার চলে আসছিলো বলে জানায় র‌্যাব। জীবন রক্ষাকারী এ সকল ওষুধ নিয়ে এ ধরনের প্রতারণায় ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ।

র‌্যাব-এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. ফিরোজ আহম্মেদ জানান, চক্রটি দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে অর্ডার নিয়ে এখানে গোপনে নকল ওষুধ তৈরি করতো। অভিযান শুরুর আগেই চক্রের সবাই পালিয়ে গেছে। র‌্যাব’র অভিযানে ওই প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্যও ভেজাল বলে প্রমাণিত হয়।

যেসব কোম্পানির নাম ব্যবহার করে নকল ওষুধ তৈরি হয়: উদ্ধারকৃত নকল ওষুধের মধ্যে রয়েছে, এসিআই ফার্মাসিউটিক্যালস’র নাম ব্যবহার করে তৈরি করা দুই হাজার ৬০০ পিস নকল ক্যাপসুল ফ্লুক্লক্স ৫০০ এমজি, এছাড়াও ক্যাপসুল ফ্লুক্লক্স ৫০০ এমজি ৫ বস্তা, অপসোনিন ফার্মাসিউটিক্যালস’র এক বস্তা রেনিটিড ১৫০ এমজি, আড়াই লাখ পিচ ক্যাপসুল শেল উইথ ফিলড পাউডার, ট্যাবলেট কনপ্রিরেড চার হাজার পিস, এসিআই ফার্মাসিউটিক্যালস’র ৫০০ এমজি ফ্লুকক্স ক্যাপসুল তৈরির ফয়েল পাঁচ কেজি, এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস’র ৫০০ এমজি ফ্লুক্লক্স তৈরির ফয়েল আড়াই কেজি, প্রিন্স ফার্মাসিউটিক্যালস অ্যান্ড হার্বাল ইন্ডাস্ট্রিজের টেস্টি স্যালাইন দুই শ’ বস্তা, ক্যাপসুলের খালি খোসা তিন লাখ ৫০ হাজার পিস, প্রিন্স গুরু মুভ ক্রিম পাঁচ হাজার ৭৬০ পিস, এছাড়াও নকল ওষুধ তৈরির বিভিন্ন যন্ত্রপাতি উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত মালামালের মূল্য কোটি টাকার ওপরে ।

বিশাল প্রতিষ্ঠানের মূল ফটকে সবসময় কড়া প্রহরা থাকে। প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরে ঢুকে বাঁ-হাতে দোতলা মাছ কোম্পানির সাবেক প্রশাসনিক ভবনে এই নকল ওষুধ তৈরির কারখানা করা হয়েছে। এখানে চালের গুঁড়া ও কেমিক্যাল দিয়ে মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নকল ওষুধ তৈরি করতো। পরে উৎপাদিত নকল ওষুধ মাছ কোম্পানির গাড়িতে করে বিপণন করতো।

র‌্যাব-১ এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. ফিরোজ আহম্মেদ জানান, প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, ঢাকার মিটফোর্ডসহ বিভিন্ন হাসপাতালের সঙ্গে এই চক্রটির যোগাযোগ রয়েছে। তারা ওই সব হাসপাতাল থেকে অর্ডার নিয়ে গোপনে নকল ওষুধ তৈরি করে। অভিযান শুরুর আগেই ওই চক্রের সবাই পালিয়ে গেছে।

খুলনার ড্রাগ সুপার মাহমুদ হোসেন বলেন, কাজী শাহ্‌নেওয়াজ নকল ওষুধ তৈরী ও সংরক্ষণ করে যে অপরাধ করেছেন তা’ আদালতে প্রমাণিত হলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই