ক্রেডিট কার্ড চুরিতে সুন্দরী

আকর্ষণীয় চেহারা। রয়েছে আভিজাত্যের ছাপ। পরিচয়ও দেন সেভাবে। নিজেকে দাবি করেন সাবেক যুগ্ম সচিবের মেয়ে। এই পরিচয় নিয়েই হাজির হন অভিজাত সব অনুষ্ঠানে। চোখ থাকে বিত্তশালী নারীদের হাত ব্যাগে। সুযোগ পেলেই কব্জা করেন ক্রেডিট কার্ড। তারপর দ্রুত সময়ে কার্ড ব্যবহার করে সেরে ফেলেন কেনাকাটা। এই সুন্দরী নারীর নাম জুবাইদা সুলতানা। সর্বশেষ গতকাল দুপুরে চুরির দায়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে তাকে। এ পর্যন্ত চারটি চুরির মামলায় আসামি হয়েছেন তিনি। সাবেক একজন বিচারপতির ক্রেডিট কার্ড চুরির দায়েও কারা ভোগ করেছেন এই নারী।

গত রোববার সন্ধ্যায় গুলশানের আজাদ মসজিদে ঢুকে চুরি করেছেন জুবাইদা। সেখানে নর্দান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মায়ের মৃত্যুতে চলছিল কুলখানি। মসজিদে ঢুকেই তার নজর পড়ে ইপিলিয়ন গ্রুপের পরিচালক কিশোয়ারা জাহানের হাত ব্যাগে। সবাই যখন দোয়ায় মশগুল ঠিক তখন ব্যাগ থেকে পার্টসটি নিয়ে বের হয়ে যান জুবাইদা সুলতানা। সেখান থেকে একটি অটোরিকশা নিয়ে দ্রুত চলে যান পান্থপথের পারটেক্স ফার্নিচারে। ফার্নিচার কর্তৃপক্ষ জানান, সময় তখন প্রায় রাত ৮টা। দোকানে ঢুকে বেশ তাড়াহুড়ো করেই একটি আলমারি ও ওয়্যারড্রব বাছাই করেন। দাম ৬৫ হাজার টাকা। ফার্নিচারের দাম পরিশোধ করতে গিয়েই ঘটে বিপত্তি। ক্রেডিট কার্ডটি পাঞ্চ করার পর ওই কার্ডের প্রকৃত মালিকের ফোনে ৬৫ হাজার টাকা ব্যয়ের ক্রেডিট বার্তাটি পৌঁছে যায়।

তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি জেনে পারটেক্স গ্রুপ কর্তৃপক্ষকে জানান কিশোয়ারা জাহান। পারটেক্স ফার্নিচার কর্তৃপক্ষ জুবাইদাকে তেজগাঁও থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করেন। এ বিষয়ে ইপিলিয়ন গ্রুপের কর্মকর্তা মিজানুর রহমান মেহেদি বাদী হয়ে গুলশান থানায় মামলা করার পর জুবাইদাকে থানায় হস্তান্তর করা হয়। গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সাইফুল্লাহ জানান, চুরির বিষয়টি জুবাইদা স্বীকার করেছেন। তিনি দীর্ঘদিন থেকে ক্রেডিট কার্ড চুরি করে আসছেন।

সূত্র মতে, ২০১০ সাল থেকেই ক্রেডিট কার্ড চুরির হাতেখড়ি জুবাইদা সুলতানার। পরপর কয়েকটি মামলা হওয়ার পরও ক্রেডিট কার্ড চুরিকেই পেশা হিসেবেই বেছে নেন তিনি। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জুবাইদা জানিয়েছেন তার পিতা যুগ্ম সচিব ছিলেন। বড় হয়েছেন মগবাজারের সরকারি বাসায়। লেখাপড়া করেছেন স্নাতক পর্যন্ত। পরিবারের অনিচ্ছাতেই বিয়ে করেছিলেন সাইদুল ইসলাম নামে এক যুবককে। ওই বিয়ের মাধ্যমেই মা-বাবার সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে তার। বিয়ের পর জানতে পারেন স্বামী নেশাগ্রস্ত। কথায় কথায় মারধর করতো জুবাইদাকে। স্বামী সাইদুল থাকতেন দেশের বাইরে। জুবাইদা থাকতেন ঢাকায়। এরমধ্যে একের পর এক পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে যান জুবাইদা। জুবাইদা বলেছেন, অনেকেই তার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করেছেন। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর সংসার ভাঙ্গে ভাঙ্গে প্রায়। এরমধ্যেই ২০১০ সালে রোগাক্রান্ত হয়ে স্বামী সাইদুলের মৃত্যু হয়। জুবাইদা জানান, ছোট বেলা থেকেই বিলাসী জীবনযাপন করতেন তিনি। স্বামীর মৃত্যুর পর অভাব দেখা দেয়। নিজেদের প্রয়োজন ছাড়া আর্থিকভাবে সহযোগিতার হাত কেউ বাড়াননি। এই অবস্থায় বাধ্য হয়েই চুরি করা শুরু করেন। প্রথমবার চুরি করেছিলেন উত্তরার একটি শপিংমলে।

তিনি জানান, তার চেহারা, পোশাক দেখে কেউ চিন্তা করতে পারেন না যে তিনি চুরি করেছেন। এছাড়াও কয়েকটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েও চুরি করেছেন। গুলশানের আমারি হোটেল থেকে এক বিদেশি নারীর ব্যাগ চুরি করেছিলেন জুবাইদা। ২০১৪ সালের ২৭শে জুন একজন সাবেক বিচারপতির ক্রেডিট কার্ড চুরি করেছিলেন তিনি। এ ঘটনায় পুলিশের গুলশান জোনে তখন তোলপাড় শুরু হয়। ঘটনাস্থল বনানী কামাল আতাতুর্ক এভিনিউস্থ কেএফসি। বিকাল ৪টার দিকে স্ত্রী সন্তান নিয়ে ওই বিচারপতি খাবার খাচ্ছিলেন। খাবার শেষে ইস্টার্ন ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বিল পরিশোধ করেন। এই সময়ই কৌশলে ক্রেডিট কার্ডটি নিয়ে যান জুবাইদা। এর কিছু সময় পরে মোবাইল ফোনে ক্রেডিট বার্তা আসে যে, বনানীর ১১ নম্বর সড়কের ফার্মেসি প্লাস থেকে ২০ হাজার ৫ শ’ ২৬ টাকা, গুলশানস্থ অ্যাস্টোরিয়ান থেকে ১৬ হাজার ৯ শ’ ৮৩, পস অ্যান্ড সিল্ক থেকে ২৫ হাজার ৫ শ’ এবং শপার্স ওয়ার্ল্ড থেকে ২১ হাজার ৯ শ’ ৬৬ টাকাসহ মোট ৮৪ হাজার ৯ শ’ ৭৫ টাকার মালামাল ক্রয় করা হয়েছে। ওই দিনই বনানী থানায় একটি জিডি করেন বিচারপতির স্ত্রী।

বিচারপতির ক্রেডিট কার্ড চুরির ঘটনায় গুলশান জোনের পুলিশের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়। যে প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে কেনাকাটা করা হয়েছে ওইসব প্রতিষ্ঠানের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে পুলিশ। এসময় গুলশান এলাকা থেকে সন্দেহভাজন হিসেবে জুবাইদাসহ কয়েক নারীকে আটক করে পুলিশ। আটকের পর সিসি টিভির ফুটেজ দেখে পুলিশ নিশ্চিত হয় বিচারপতির কার্ড চুরি করেছেন এই জুবাইদা। পরবর্তীতে জিজ্ঞাসাবাদে চুরির বিষয়টি স্বীকার করেন। এ ঘটনায় ওই বছরের ২০শে সেপ্টেম্বর জুবাইদা সুলতানাকে আসামি করে মামলা হয়। ওই মামলায় দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলেন তিনি। কয়েক মাস আগে জামিনে বের হয়ে চট্টগ্রামে চলে যান। ঢাকায় ফিরে আবার পুরনো পথে হাঁটা শুরু করেন এই নারী। এ বিষয়ে গুলশান থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) নাজিম জানান, জুবাইদা অনেক কথাই এড়িয়ে যান। চুরি করার কারণ সম্পর্কে তিনি জানিয়েছেন মামলার খরচ চালাতে এখন চুরি করেন তিনি।

জুবাইদা সুলতানা চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার মির্জাপুরের আশরাফ আলীর মেয়ে। বর্তমানে রাজধানীর উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরের ১৩ নম্বর সড়কের দুই নম্বর বাড়ির একটি বাসায় একা বসবাস করেন তিনি।-মানবজমিন



মন্তব্য চালু নেই