গোল্ডেন এ প্লাস নির্যাতন

শাহিনুল ইসলাম আশিক, রাজশাহী ব্যুরো প্রধান: একটি শিশুর প্রথম স্কুল তার মা-বাবা। শিশুর ওপর শিক্ষার চাপ এবং পাঠ্য বইয়ের ভারে ক্লান্ত আমাদের অবুঝ শিশুরা। মা-বাবারা চাই ভালো রেজাল্টা করলেই হবে না, গোল্ডেন এ প্লাস যে ভাবে হোক পেতেই হবে। মাত্রাতিরিক্ত সিলেবাসের ভারে শিশুদের অসহায় কান্না শুনতে পাইনা অভিভাবক ও শিক্ষকরা। আদরের সন্তানকে মানুষ গড়ার নামে কী করছি আমরা? অনুপযোগী বয়সে তাকে স্কুলে দিচ্ছি।

পরীক্ষা নামক যুদ্ধক্ষেত্রটায় ঠেলে দিচ্ছি এতটুকুন শিশুকে। স্কুলে যাওয়া, বাড়ির কাজ, একটু আরবি পড়া, একটু গান শেখা, নাচ শেখা, ক্লাস টেস্ট, পরীক্ষা, প্রাইভেট, কোচিং, গাদা-গাদা ভারী ভারী বইয়ের বোঝাা ইস। পাঁচ-ছয় বছরের একটা শিশুর ওপর কত না মানসিক নির্যাতন। এতটুকুন শিশুর কতটুকু চাপ সইবার ক্ষমতা আছে, আমরা কি একবারও তা ভেবে দেখি।

পাঁচ-ছয় বছরের শিশুকে কাক-ভোরে ঘুম থেকে টেনে তোলা হয়, যখন তার ঘুমের চাহিদা পূরণ হয় নি। ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর-জবরদস্তি করে তাকে স্কুলের জন্য তৈরি করা হয়। কী অসম্ভব নির্মমতাবোধ আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে কোন উচ্চাশায় কে জানে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় অভিভাবকদের নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করা উচিত যে আমার সন্তানকে আমি কিভাবে গড়ে তুলতে চাই।

তাকে শিক্ষিত বোধহীন নাগরিক বানাতে চাই, নাকি মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষিত মানুষ বানাতে চাই। নিশ্চয়ই দ্বিতীয়টি সব বাবা-মায়ের চাওয়া, তাহলে আমরা অসম প্রতিযোগিতার পেছনে কেন দৌড়াচ্ছি। এসব করে করে নিজেদের মানসিক, আর্থিক বিনাশের পাশাপাশি সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি করছি প্রিয় সন্তানের।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ রামেক হাসপাতালের শিশু বিভাগের অধ্যাপক ডা. ছানাউল হক মিঞা বলেন, শিশুদের জন্য উপযোগী এবং সঠিক জীবনচর্চাই হচ্ছে না। এখন আমাদের পরিবারগুলোয় শ্রদ্ধা, স্নেহ-মমতা, সহিষ্ণুতা ও শর্তহীন ভালোবাসার চর্চা নেই। সবাই স্বার্থপরের মতো নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। কথা হচ্ছে শিশুদের শিক্ষাদানের নাম করে তাদের জীবন থেকে নির্মল শৈশবের আনন্দমুখরতা কেড়ে নিচ্ছি।

তিনি আরো বলেন, শিশুদের এতো চাপের কারণে বিভিন্ন সময় নানা সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে আসে। আসনে এতো ছোট বয়সে এতো চাপ তারা সামলাতে পারে না। ‘যেনো বোঝার ওপরে শাসের আটি’ শিক্ষাজীবনে পরীক্ষা থাকবে, পড়াশোনা থাকবে এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু আমাদের এখানে যা হচ্ছে তা রীতিমতো একটা অসম, অনুপযোগী ও বুদ্ধিবৃত্তিহীন অ-প্রতিযোগিতা চাপিয়ে দেয়া ছাড়া আর কিছুই নয়।

বিনোদপুর ইসলামী কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক তাসলিম বলেন, দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার পুরোটাই হয়ে পড়েছে পরীক্ষাকেন্দ্রিক। শিক্ষাব্যবস্থাটা টাকা কামানোর যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। আর এর কবলে পড়ে কোচিংয়ের নামে ৩২ হাজার কোটি টাকা রীতিমতো পকেট কেটে নিয়ে যাচ্ছেন একশ্রেণির শিক্ষা ব্যবসায়ী। তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে সন্তানকে শিক্ষিত বানানোর নামে অসহায়ের মতো টাকা তুলে দিচ্ছেন অভিভাবকরা।

তিনি আরো বলেন, টিউটোরিয়াল, ক্লাস টেস্ট, মডেল টেস্ট, প্রথম সাময়িক, দ্বিতীয় সাময়িক আবার বার্ষিক কত নামের যে পরীক্ষা নামক নিরীক্ষা হচ্ছে এই কোমলমতি বাচ্চাদের ওপর; ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। অবস্থাটা এমন হয়েছে যে, পরীক্ষার ফাঁকে পড়াশোনা করতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। অথচ হওয়া উচিত ছিল, পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে পরীক্ষা দিতে হবে।

বিসিএস আই আর ল্যাবরেটরী হাই স্কুলের ২য় শ্রেণির শিক্ষার্থীর মা সাবিনা আক্তার বলেন, আমরা বাচ্চাদের সব সময় পড়া শোনার ওপর রাখি। আমরা একবারো ভাবি না, আমার বাচ্চাটা এতো বেশি বই পড়তে পারবে কি না। শুধু পড়ো আর পড়ো এমন কথা বলি।

তিনি আরো বলেন, আমাদের বাচ্চাদের সঙ্গে ভালো ভাবে বসে সময় দেই না। তারা কি বলতে চাচ্ছে আমরা তা কখনোই শুনিনা। বাচ্চাদের পড়া-শোনা করতে হবে এটা ঠিক আছে, কিন্তু এতো চাপের মধ্যে না।



মন্তব্য চালু নেই