গোয়েন্দাদের চার প্রশ্নের মুখে ফখরুল-রিজভী-ফালু

আমাদের পর্যায়ের নেতা কোনো কর্মীকে বোমা কিংবা বাসে আগুন দেয়ার নির্দেশ দিতে পারে না। এটা হতে পারে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের কাজ। আবার পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে সরকারপক্ষ বা সুযোগসন্ধানী অন্য কেউ এসব করে থাকতে পারে। জেরার মুখে বারবার এমন কথাই বলছেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) হেফাজতে থাকা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোসাদ্দেক আলী ফালু। জিজ্ঞাসাবাদে ওই তিন নেতা প্রায় এক ও অভিন্ন তথ্য দিয়েছেন। রোববার রাতে বিএনপির তিন নেতাকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করেন গোয়েন্দারা। বিএনপির চেয়ারপারসনের সঙ্গে দেখা করে ফেরার পথে ডিবি পুলিশ চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ের সামনে থেকে মোসাদ্দেক আলী ফালুকে আটক করে। সোমবার তাকে খিলগাঁও থানায় পেট্রলবোমা মেরে গাড়ি পোড়ানো মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

নাম প্রকাশ না করে জিজ্ঞাসাবাদে সংশ্লিষ্ট এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, রোববার রাতে বিএনপির ওই তিন নেতাকে প্রায় চার ঘণ্টা মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ সময় ওই তিন নেতার কাছে ঘুরেফিরে চারটি প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া হয়। প্রশ্নগুলো হল- অবরোধ-হরতালের নামে কারা নাশকতা করছে, নাশকতায় অর্থের জোগানদাতা কারা, তাদের টার্গেট কি এবং বিদেশী কোনো শক্তি তাদের (বিএনপি) মদদ দিচ্ছে কিনা। মিন্টো রোডে গোয়েন্দা কার্যালয়ে এক কর্মকর্তার কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদের সময় পুলিশের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। গোয়েন্দা পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের মুখে তিনজনই নাশকতার সঙ্গে নিজেদের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন। একপর্যায়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আগে থেকে রেকর্ড করা মোবাইলের কিছু কথোপকথন ওই নেতাদের শোনান। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, রেকর্ডকৃত মোবাইল কথোপকথনে নিজেদের কণ্ঠ শোনার পর তারা চুপসে যান।

জেরার একপর্যায়ে রুহুল কবির রিজভী বলেন, আমি বোমাবাজি বা কোনো ধরনের নাশকতার পক্ষে নাই। আমি অসুস্থ মানুষ। বোমা-আগুনের কথা শুনলে আমি ভয় পাই। দলের কিছু নেতা এসবের পক্ষে। তাদের নির্দেশনায় এসব হচ্ছে বা হতে পারে। আমি মাঝেমধ্যে কিছু বিবৃতি দেই এবং তা দলের যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানের নির্দেশে।

ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, অব্যাহত জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। রাগত স্বরে তিনি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বলেন, উই আর পলিটিশিয়ান। লিডার ক্যান নট সে এনি ওয়ার্কার বোম্বিং অর টর্চারিং। এ সময় এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা মির্জা ফখরুলসহ বিএনপির তিন নেতাকে বলেন, আপনাদের এখানে জামাই আদর করতে আনা হয়নি। আর অবরোধ-হরতালের নামে এখন যা হচ্ছে তা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। ফৌজদারি অপরাধ। আমরা আশা করছি, অপনারা তথ্য দিয়ে আমাদের সহযোগিতা করবেন। এ সময় পাশে থাকা আরেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বিএনপি নেতাদের উদ্দেশ করে বলেন, নাশকতা দমনে সরকারের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। আপনারা তথ্য না দিলে আমরাও কঠোর হতে বাধ্য হব।

এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোসাদ্দেক আলী ফালুকে বলেন, আপনি-তো ঘনঘন গুলশানের ওই কার্যালয়ে যান। ওখান থেকে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা এনে বিএনপি নেতাদের জানান। তথ্য পাচার করেন। আপনার বিরুদ্ধে বিদেশে তথ্য পাচারেরও অভিযোগ আছে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, আপনারা চেয়ারপারসনের সঙ্গে কথা বলেন। অবরোধ-হরতালের নামে এসব নাশকতা বন্ধ করতে বলেন। আপনাদের কথা বললে উনি শুনতে বাধ্য। এসব কথার জবাবে তিন নেতা চুপচাপ থাকেন।

গোয়েন্দা কার্যালয়ের একটি সূত্র বলেছে, রাত ১০টা থেকে শুরু হওয়া জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয় রাত ২টার দিকে। এরপর গোয়েন্দা কার্যালয়ে দুই কর্মকর্তার কক্ষে ওই নেতাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। সরবরাহ করা হয় কম্বল ও বালিশ। তবে প্রায় নির্ঘুম তার কাটিয়েছেন তিন নেতা।

এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, অনেকদিন থেকেই বিএনপি-জামায়াতের কিছু নেতার মোবাইল ফোনের কনভারসেশন ট্র্যাক করা হচ্ছিল। এই ট্র্যাকিং ও ভয়েস রেকর্ডে নাশকতার ব্যাপারে অনেক তথ্য মিলেছে। এর মধ্যে লন্ডন থেকে তারেক রহমানেরও বেশকিছু কল রয়েছে। মূলত মোবাইল ফোনের রেকর্ডকৃত এসব কথোপকথনের ভিত্তিতেই তিন নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

কোর্ট রিপোর্টার জানান, খিলগাঁওয়ে পেট্রল মেরে গাড়ি পোড়ানো মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে সোমবার দুপুরে ঢাকা মহানগর হাকিম হাসিবুল হকের আদালতে মোসাদ্দেক আলী ফালুকে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষে এ বিষয়ে শুনানি করেন পিপি আবদুল্লাহ আবু। অন্যদিকে মোসাদ্দেক আলী ফালুর পক্ষে তার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া ও মাসুদ আহমেদ তালুকদার রিমান্ডের বিরোধিতা করে জামিনের আবেদন করেন। উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে বিচারক জামিন নাকচ করে ফালুকে পাঁচ দিন হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন।

৩০ জানুয়ারি রাতে খিলগাঁও ফ্লাইওভারের অদূরে পুরাতন পুলিশ ফাঁড়ির সামনে তুরাগ পরিবহনের একটি বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় বাসের মালিক নজরুল ইসলাম বাদী হেয় খিলগাঁও থানায় এ মামলা করেন। অবরোধের মধ্যে সেদিন রাতে খিলগাঁও ফ্লাইওভারের গোড়ায় পুরাতন পুলিশ ফাঁড়ির সামনে তুরাগ পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয়া হলে কয়েকজন দগ্ধ হন।

মামলায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শামছুর রহমান শিমুল বিশ্বাসসহ ২১ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়।

অন্যদিকে পল্টন থানার একটি মামলায় আগে থেকেই তিন দিনের রিমান্ডে গোয়েন্দা হেফাজতে রয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শনিবার ভোররাতে বারিধারা থেকে আটক হওয়ার পর বাড্ডা থানা এলাকায় গাড়িতে অগ্নিসংযোগের মামলায় রিমান্ডে গোয়েন্দা হেফাজতে আছেন রুহুল কবির রিজভী।

অপর এক মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসনের অপর উপদেষ্টা সামসুজ্জামান দুদুকে সোমবার আরও চার দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। মিরপুর থানায় দায়ের করা একটি মামলায় এর আগেও তিনি দুই দফা রিমান্ডে ছিলেন। রিমান্ড শেষ হওয়ায় সোমবার হাকিম মো. মাহবুবুর রহমানের আদালত তার তৃতীয় দফা রিমান্ড মঞ্জুর করেন।-সূত্র:যুগান্তর।



মন্তব্য চালু নেই